সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, এর আগে ২০১৯ সালে টিকিটিং সেবা পরিচালনা ও আইসিটি অবকাঠামাে নির্মানে একটি টেন্ডারের মাধ্যমে সার্ভিস প্রােভাইডার নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু করে রেল। কিন্তু টেন্ডারে বেশ কিছু দুর্বলতা ও মূল্যায়নে অসাদুপায় সহ বিভিন্ন কারসাজির প্রমান পায় সিপিটিইউ’র রিভিউ প্যানেল। টেন্ডার সংশ্লিষ্ট রেল কর্মকর্তাদের সরাসরি যােগসাজস, জালিয়াতি ও কারসাজির অভিযােগ উত্থাপন করে সেটি বাতিল করার সুপারিশ করে সিপিটিইউ। কিন্তু সেটা আমলে না নিয়ে রেল তড়িঘড়ি করে তাদের পছন্দসই প্রতিষ্ঠান সহজ-সিনেসিস-ভিনসেন জেভি’র সাথে চুক্তি করতে উদ্যত হলে ব্যাপারটি গড়ায় আদালতে। আদালতের দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষ করে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠান সহজের নেতৃত্বে গঠিত সহজ-সিনেসিস-ভিনসেন জেভি’র সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করে রেল।
জানা যায়, সহজের মাধ্যমে টিকিটিং ব্যবস্থা কাউন্টারে ২৫ তারিখে এবং অনলাইনে ২৬শে মার্চ থেকে চালু করার কথা থাকলেও ৭৭টি স্টেশনের অর্ধেকের বেশি স্টেশনে চালু করতে পারেনি সহজ। আর অনলাইনে ২৬ তারিখ সকাল ৮টায় চালুর কথা থাকলেও সারাদিন চেষ্টা করেও সাইটে ঢোকা যায়নি। এর আগে ২০ থেকে ২৫শে মার্চ পর্যন্ত হাতে লেখা টিকিটি দিয়েছে রেল। তাতে দীর্ঘ লাইন আর ধীরগতির কারনে ভােগান্তিতে পড়েছে যাত্রীরা। উপচে পড়া ভিড়ে লােকারণ্য হয়ে ওঠে দেশের প্রায় সকল স্টেশন।
আরও জানা যায়, চুক্তি অনুযায়ী নতুন অপারেটর সহজ প্রথম দিন থেকেই টিকিটিং প্রক্রিয়া সচল রাখার কথা। এর আগে একই প্রেক্ষাপটে বিদায়ী অপারেটরও দ্বায়িত্ব নেয়ার প্রথম দিন থেকেই টিকিটিং ব্যবস্থা সচল রাখে। দীর্ঘ ৫ দিন হাতে লিখে টিকিট ইস্যু করার মত সিদ্ধান্ত এর আগে কখনাে নেয়নি রেল। এছাড়া টেন্ডারে অপারেটরের নিজস্ব সচল ও পূর্ণাঙ্গ রেল টিকিটিং সিস্টেম থাকা এবং টিকিটিং সিস্টেমের মাধ্যমে বছরে অন্তত ৫০ লক্ষ টিকিট বিক্রির শর্ত থাকলেও রেলের নির্বাচিত অপারেটর সহজ-সিনেসিস-ভিনসেন্ট জেভি'র সেটি নেই। এমনকি টেন্ডারের মূল্যায়ন চলাকালে কমিটির নিকট সেই সিস্টেমের পূর্ণাঙ্গ ডেমােনস্ট্রেশনের শর্ত থাকলেও মানা হয়নি সেটি।
সহজ পরিচালিত বাংলাদেশ রেলওয়ের নতুন ই-টিকিট ওয়েব সাইটের মাধ্যমে ইতিমধ্যে টিকিট কেটে অনেকেই পড়েছেন বিপাকে। মুল্য পরিশোধ করে গত ২২ মার্চ অনেকে টিকিট পেলেও সেটির বৈধতা নিয়ে দেখা গেছে নানান প্রশ্ন। কারন বাংলাদশ রেলওয়ের পূর্ব ঘােষনা অনুযায়ী ২১-২৫ মার্চ পর্যন্ত স্টেশনের কাউন্টার থেকে হাতে ইস্যু করা হয়েছে শতভাগ টিকিট।
এ নিয়েও অনেকে সােচ্চার হয়েছেন সামাজিক যােগাযােগ মাধ্যমে। এছাড়া সহজের সিস্টেম সহ সেটিতে প্রিন্ট করা কয়েকটি টিকিট পর্যালােচনা করে দেখা যায়, মূলত বাসের টিকিটিং সিস্টেমকে রেল টিকিটিং সিস্টেম হিসেবে চালিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টায় থেকে গেছে অনেক গলদ। টিকিটিং সিস্টেমের ধীরগতির কারনে একটি টিকিটি ইস্যু করতে লাগছে ৫ মিনিটের বেশী অথচ আগে সেটি ১০ সেকেন্ডেই প্রিন্ট হত। এছাড়া ভুল বা বাড়তি ভাড়া প্রিন্ট করছে সিস্টেমটি। এতে হয়রানীর শিকার হচ্ছেন যাত্রীরা। কোন কোন টিকিটে ইংরেজীতে রূপশা এক্সপ্রেস লেখা থাকলেও বাংলায় লেখা সুন্দরবন এক্সপ্রেস।
এছাড়া বুকিং কাউন্টার থেকে জানা যায় সিস্টেমে ২৬ তারিখের টিকিট কাটলেও প্রিন্ট হয়ে আসছে ৩০ তারিখের টিকিট। এই ধরনের হাস্যকর ও অপরিপক্ক সিস্টেম দিয়ে কিভাবে রেলওয়ের এত ব্যাপক টিকিটিং অপারেশন চালানাে সম্ভব, এনিয়ে শংকায় রেলকর্মীরা।
এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, আরাে ১৮ মাস লাগবে তাদের এই অ্যাপ সহ অনলাইন ও কাউন্টার সিস্টেম পুরােপুরি তৈরী করতে। অথচ পুর্বের অপারেটর মাত্র একদিনে সচল করেছিল সবকটি স্টেশন। আর মাত্র ২৮ দিনে প্রস্তুত করে চালু করে রেলসেবী অ্যাপ। যেটি দিয়ে বিগত ২০ তারিখ পর্যন্ত নির্বিঘ্নে সেবা পেয়েছে জনগণ।
তারা বলছেন, এখন সফটওয়ার তৈরী করছেন তারা, ১৮ মাস পর শেষ হবে সেই কাজ। অথচ টেন্ডারের শর্ত অনুযায়ী তাদের নিজস্ব রেল টিকিটিং সিস্টেম থাকার কথা। থাকার কথা এই ধরনের বৃহৎ পরিসরে কাউন্টার আর অনলাইন টিকিটিং পরিচালনার অভিজ্ঞতা। এছাড়াও সহজের রেল টিকিটিং পরিচালনা করার কোন অ্যাপ নেই। অথচ টেন্ডার মূল্যায়ন কমিটির নিকট কার্যকর একটি অ্যাপ ও অনলাইন সফটওয়ার প্রদর্শন করেই তবে কাজ পাওয়ার কথা তাদের।
বাংলাদেশ রেলওয়ের ই টিকিটিং সিস্টেমের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে দেখা যায়, টিকিটিং সিস্টেমে সাইবার হামলার কারনে সাইট ডাউন হওয়ার দাবি করে সহজ-সিনেসিস-ভিনসেন জেভি। যদিও ভুল ভাড়া, অপ্রত্যাশিত গন্তব্য আর অসংলগ্ন তারিখে সংক্রান্ত সফটওয়ারের ভুলগুলি কিভাবে সাইবার হামলার মূল, সেটি নিয়ে স্পষ্ট করা হয়নি সেখানে। তদুপরি সাইবার হামলার শিকার হলে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ রেগুলেটরি কমিশনের বক্তব্যও কিংবা সে বিষয়ে কোন প্রমান সেখানে দেয়া হয়নি। এছাড়া সরকারী সেবা প্রদানকারী সাইটসমূহে যে সকল সাইবার সিকিউরিটি ব্যবস্থা থাকার দরকার, সেগুলো নিশ্চিত না করা হলে ভবিষ্যতে দেশের সংবেদনশীল তথ্য বিদেশে পাচার হওয়ার আশংকা উড়িয়ে দেয়া যায় না।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, সহজের নিজস্ব কোন ডেটা সেন্টার নেই। নেই দক্ষ আইটি এক্সপার্ট। তারা স্বল্প খরচে নিম্নমানের একটি বাস টিকিটিং সিস্টেম কাস্টমাইজ করে তাদের নামে চালিয়ে দিয়েছে। এছাড়া ডাটা সেন্টার, ফায়ারওয়াল, সাইবার সিকিউরিটি ইকুইপমেন্ট সহ কেনি আইটি অবকাঠামাে না থাকায় কানাডার মন্ট্রিলে অ্যামাজন ওয়ব সার্ভারের একটি সন্ত্রা ভার্চুয়াল মেশিনে তাদের এই সিস্টেমটি হােস্ট করেছে। তাতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের ব্যক্তিগত তথ্য সহ এনআইডি ও রাষ্ট্রীয় সংবেদনশীল তথ্য বিদেশে পাচার হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
বর্তমানে রেলের আসনসংখ্যার ৫০ ভাগ টিকিট কাউন্টারে ও বাকী ৫০ ভাগ অনলাইনে অ্যাপের মাধ্যমে বিক্রী হয়। প্রতিদিন শুধু ঢাকা স্টেশন থেকেই ২০টির বেশী ট্রেন ছাড়ে। টিকিট বিক্রীর জন্য রেলের একমাত্র ভরসা কেন্দ্রীয় ভাবে নিয়ন্ত্রিত অনলাইন টিকিটিং সিস্টেম যা ৭৭টি স্টেশনে নেটওয়ার্কের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। বর্তমানে সহজ যে সকল টেশনে কম্পিউটারাইজড কাউন্টার চালু করতে পারেনি এবং চালু স্টেশনগুলোতে টিকিটিংয়ের ধীরগতি সহ টিকিটের দামের গরমিলের কারনে অধিকাংশ আসনই খালি যাচ্ছে। সেখানে যাত্রীরা উঠে পড়ছেন টিকিট ছাড়াই। এতে কয়েকশত কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে রেল। এছাড়াও মিলছে না কাউন্টারের বুকিং কর্মচারীর হিসাব।
অপরদিকে চট্টগ্রাম স্টেশন সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, প্রায় প্রতিটি কাউন্টারে এক থেকে দেড় লক্ষ টাকা গরমিলের কারনে দুই দিনে লােকসান হয়েছে কয়েক লক্ষ টাকা। এই রাজস্ব ক্ষতির বিষয়টি শেষ পর্যন্ত রেল কিভাবে সুরাহা করবে। রেলের নির্বাচিত অপারেটর সহজ এতগুলি স্টেশনে নেটওয়ার্ক সংযােগ দিয়ে তাদের নিজস্ব টিকিটিং সিস্টেমটি অনলাইন টিকিটিং সহ কতদিন নাগাদ সঠিকভাবে চালু করতে পারে, সেটি এখনাে নিশ্চত না। তাতে কালােবাজারী আর টিকিট বিহীন যাত্রী ও আসন ফাকা নিয়ে চলার কারনে আরাে কয়েক হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ক্ষতির সম্ভবনা রয়েছে। সব মিলিয়ে যাত্রী ভােগান্তি লাঘব সহ টিকিটিং সেবা দেশের মানুষের দোরগোড়ায় পৌছে দিতে রেলের নিজ সক্ষমতা বৃদ্ধি সহ স্থায়ী অবকাঠামাে নির্মান, নিজস্ব জনবল তৈরী ও পূর্বের অপারেটরের ন্যায় অভিজ্ঞ ও সৎ অপারেটর নিয়োগের উপর জোর দেওয়া দরকার।