দেশের আইন অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৬৫ বছর। সে হিসেবে বর্তমান গভর্নর ফজলে কবিরের মেয়াদ শেষ হবে আগামী ৩ জুলাই। এর মধ্যেই নতুন গভর্নর নিয়োগ দিতে হবে সরকারকে। তবে নতুন কাউকে গভর্নর পদে নিয়োগ না দিয়ে ফজলে কবিরকেই বহাল রাখার বিষয়টি ভাবছে সরকার।
এ ব্যাপারে তারা বলছেন, করোনাভাইরাসের তাণ্ডবে বিধ্বস্ত অর্থনীতিকে টেনে তোলার মূল দায়িত্ব পড়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঘাড়ে। নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে নিজ দায়িত্ব পালনের চেষ্টাও করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ অবস্থায় গভর্নরের মতো নীতিনির্ধারণী ও গুরুত্বপূর্ণ পদে পরিবর্তন আনার ঝুঁকি না নেয়াই ভালো।
বহাল রাখার বিষয়টি প্রায় নিশ্চিত। এক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের চাকরির ৬৭ বছরের বয়সসীমাকে বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে।
প্রতিনিয়ত অসংখ্য মানুষের জীবন সংহারের পাশাপাশি নভেল করোনাভাইরাস পাল্টে দিচ্ছে পৃথিবীর রীতিনীতিও। এক মাসের বেশি সময় ধরে গৃহবন্দি সময় পার করছে বিশ্বের অন্তত ৩০০ কোটি মানুষ। বহু দেশে জারি করা হয়েছে জরুরি পরিস্থিতি। এরই মধ্যে পেছানো হয়েছে শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। বিশ্বের অনেক দেশই অনুসরণ করতে বাধ্য হচ্ছে শ্রীলংকার পথ। কথা উঠেছে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নির্বাচন পেছানোরও। বিশ্বের অনেক প্রতিষ্ঠানই তাদের শীর্ষ নির্বাহীর মেয়াদ বাড়িয়ে দিয়ে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর পদেও বিকল্প ভাবতে নারাজ নীতিনির্ধারকরা।
রিজার্ভ চুরির ঘটনায় ২০১৬ সালের ১৫ মার্চ পদত্যাগে বাধ্য হন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান। ওই দিনই গভর্নর পদে চার বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পান অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ফজলে কবির। পরে ২০ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের ১১তম গভর্নর হিসেবে যোগ দেন তিনি। সে হিসেবে চলতি বছরের ২০ মার্চ চার বছরের চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল। তবে তার আগেই ১৬ ফেব্রুয়ারি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করে ফজলে কবিরের মেয়াদ তার বয়স ৬৫ বছর পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত বাড়ায়। আগামী ৩ জুলাই তার বয়স ৬৫ বছর পূর্ণ হবে।
১৯৭২ সালে জারি করা রাষ্ট্রপতির ১২৭ নম্বর আদেশে গঠিত হয় বাংলাদেশ ব্যাংক। বিভিন্ন সময়ে সংশোধিত ও পরিমার্জিত হওয়া বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডারকে ২০০৩ সালের ১০ মার্চ বিধিবদ্ধ করা হয়। ওই সময় অর্ডারটির ১০ বিধির ৫ উপবিধিতে সংযুক্ত করা হয় গভর্নরের মেয়াদ ও সর্বোচ্চ বয়সসীমা। এতে বলা হয়, গভর্নরের মেয়াদ হবে চার বছর। চার বছর মেয়াদ শেষে একই ব্যক্তিকে পুনরায় গভর্নর পদে নিয়োগ দেয়া যাবে। তবে নিয়োগকৃত ব্যক্তির বয়স ৬৫ বছরের বেশি হবে না।
একই ব্যক্তি যাতে দীর্ঘ সময় ধরে গভর্নর পদে না থাকতে পারেন, এজন্য ওই সময় বয়সসীমা বেঁধে দেয়া হয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের সবচেয়ে দীর্ঘকালীন গভর্নর ছিলেন এম নুরুল ইসলাম। ১৯৭৬ সালের ১৩ জুলাই থেকে ১৯৮৭ সালের ১২ এপ্রিল পর্যন্ত টানা ১১ বছর গভর্নর ছিলেন তিনি। এরপর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রায় সাত বছর গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ড. আতিউর রহমান।
২০০৫ সালের ১ মে থেকে ২০০৯ সালের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত চার বছর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। গভর্নরের বয়স ও মেয়াদ নির্ধারণ করে দেয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ২০০৩ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার সংশোধনের মাধ্যমে গভর্নরের সর্বোচ্চ বয়স ও মেয়াদ নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছিল। তার আগে বাংলাদেশ ব্যাংকে দায়িত্ব পালনকারী অনেক গভর্নরের বয়স ৬৫ বছরের বেশি ছিল। কেন এটি করা হয়েছে, তা আমি জানি না। তবে বিশ্বের উল্লেখযোগ্য কোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের বয়স নির্ধারণ করা নেই। তবে সরকার যদি বর্তমান গভর্নরের মেয়াদ বাড়াতে চায়, তবে আইন সংশোধন করতে হবে।
বাংলাদেশে গভর্নর পদে নিয়োজিত ব্যক্তির বয়সসীমা নির্ধারণ করে দেয়া হলেও প্রতিবেশী কোনো দেশে এমনটি নেই। বিশ্বের বৃহৎ অর্থনীতির দেশগুলোয়ও গভর্নর পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে বয়সসীমা নির্ধারণ করা হয়নি। রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া অ্যাক্ট, ১৯৩৪-এর অধীনে পরিচালিত হয় ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এই আইনে বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় সরকার গভর্নর নিয়োগ দেবে। গভর্নরের মেয়াদ হবে পাঁচ বছর এবং নবায়ন করা যাবে। এক্ষেত্রে কোনো বয়সসীমা উল্লেখ করা হয়নি।
একইভাবে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান, সেন্ট্রাল ব্যাংক অব শ্রীলংকা, ব্যাংক অব ইংল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর পদেও নিয়োগের বয়সসীমা বেঁধে দেয়া হয়নি। এসব দেশে খ্যাতিমান ব্যাংকার কিংবা অর্থনীতিবিদদের যোগ্যতার ভিত্তিতেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর নিয়োগ দেয়া হয়।