ব্যাংকিং ও আর্থিক খাত বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আর্থিক, ব্যাংকিং ও প্রশাসনিক সব জায়গাতেই দক্ষ নেতৃত্ব দেওয়ার মতো গুণাবলি সম্পন্ন তেমন কেউ বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকে নেই। তাই আর্থিক খাত থেকেই দক্ষ ব্যক্তিকে আগামীতে গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেছেন দেশের অর্থনীতি বিশ্লেষকরা।
বর্তমান গভর্নর প্রথম মেয়াদে ২০১৬ সালের ১৬ মার্চ এ পদে নিয়োগ পান। পরবর্তীতে তিন দফায় মোট ৬ বছর ৩ মাস গভর্নর হিসেবে ইতিহাসের পাতায় থাকছেন ফজলে কবির। তাকে এ পদে রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার বিলও পাস করতে হয়েছে সংসদে। তবে ফজলে কবিরের সময়ে আর্থিক খাতে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি চিত্র উঠে এসেছে বিভিন্ন সময়ে। এর মধ্যে অর্থপাচার ছিল অন্যতম। ফলে তিনি আর গভর্নর পদে থাকছেন না বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে।
সম্প্রতি পিকে হালদারের অর্থপাচারের বিষয়টি দেশজুড়ে আলোচিত হয়। এই পিকে হালদার বিভিন্ন সময় পিপলস্ লিজিং, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, ফাস ফাইন্যান্স, রিলায়েন্স ফাইন্যান্সসহ বেশ কয়েকটি ননব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা আত্মসাত করেছেন। এসব টাকা পরে বিদেশে পাচার করেছেন পিকে। এসব ঘটনায় নীরব ছিল বর্তমান গভর্নর ফজলে কবির ও বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ২২ মে পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসে (পিএলএফএস) সংঘটিত ‘অনিয়ম, দুর্নীতি ও অর্থপাচারের’ ঘটনায় ‘নীরব ভূমিকার’ অভিযোগ তুলে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের পদত্যাগ দাবি করেছেন সাধারণ আমানতকারীরা।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, অর্থপাচার রোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তেমন কোন কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। ফলে দেশ থেকে অবাধে অর্থপাচার হচ্ছে।
সম্প্রতি মার্কিন ডলারের বিপরীতে কমতে থাকে টাকার মান। ডলারের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় বড় ধাক্বা আসে দেশের অর্থনীতিতে। আমদানিতে খরচ বেড়ে যাওয়ায় এর প্রভাব পড়ে মানুষের জীবনযাত্রায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ বলে মনে করেন অর্থনীতি সংশ্লিষ্টরা। ফলে গভর্নর ফজলে কবিরের অদক্ষতা স্পস্ট হয়ে উঠেছে।
এছাড়াও দেশের পুঁজিবাজারের সাম্প্রতিক সময়ের পতনের কারণ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর ফজলে কবিরের আচরণ প্রশ্নবিদ্ধ বলে মনে করেন শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে- বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক আচরণের কারণে শেয়ারবাজারে বড় পতন হয়েছে। বিশেষ করে শেয়ারবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আচরণ ছিল দেশের শেয়ারবাজারের বিরুদ্ধে। যার কারণে বেশ কয়েকবার বড় পতন দেখেছে দেশের শেয়ারবাজার। যদিও অর্থ মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ ও পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কৌশলের কারণে এসব পতন স্থায়ী হয়নি। তবে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা মনে করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের পদটিতে পরিবর্তন আসলে দেশের শেয়ারবাজারসহ অর্থনীতির অন্যান্য খাতগুলো শক্তিশালী হবে। ফলে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হবে বাংলাদেশ।
সূত্র জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত গভর্নরের পদের জন্য চার জন আলোচনায় রয়েছে। তারা হলেন- অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব আব্দুর রউফ তালুকদার, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য সচিব ও সাবেক এনবিআর চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান, পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম এবং অর্থবিভাগের সাবেক সচিব ও সাবেক হিসাব মহানিয়ন্ত্রক (সিজিএ) মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব আব্দুর রউফ তালুকদার খুব শিগগিরই চাকরি থেকে অবসর নিচ্ছেন। অর্থ মন্ত্রণালয়ে সিনিয়র সচিব থাকাকালেই দেশে করোনাভাইরাস মহামারি শুরু হয়। কভিড-১৯ উপলক্ষে প্রণোদনা প্যাকেজ তৈরি, বাস্তবায়ন ও সামষ্টিক অর্থনীতিতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে সক্ষমতা দেখিয়েছেন আব্দুর রউফ তালুকদার। এছাড়াও পদাধিকার বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য তিনি। ফলে পরবর্তী গভর্নর হিসেবে তার নাম আলোচনায় রয়েছে।
পরবর্তী গভর্নর হওয়ার দৌঁড়ে নেতৃত্বের গুণাবলীসহ বিভিন্ন কারণে এগিয়ে আছেন শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম। বিএসইসি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই দেশের শেয়ারবাজার ইতিবাচক ধারায় চলছে। সূচক সাত হাজার অতিক্রম করেছে। করোনা মহামারির সময়েও পুঁজিবাজার ভালো অবস্থানে ছিল। মাঝে মধ্যে সিন্ডিকেটের প্রভাব বাড়লেও শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম তা দক্ষ হাতেই নিয়ন্ত্রণ করেছেন। ফলে বাজার নেতিবাচক জায়গায় বেশিদিন থাকেনি। ফলে শেয়ারবাজার নিয়ে সরকার স্বস্তির জায়গায় রয়েছে।
অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম গভর্নর হওয়ার দৌঁড়ে এগিয়ে থাকার আরও বেশকিছু কারণ রয়েছে। তিনি শেয়ারবাজারের উন্নয়নে বেশ কিছু যুগান্তকারী উদ্যোগ নিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। শেয়ারবাজারের ইতিহাসে এত পরিবর্তন কোন কমিশনের আমলে দেখা যায়নি। তার মধ্যে দেশের শেয়ারবাজার সহ অর্থনীতিকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরতে দেশের বাহিরে রোড শো করা, অনিয়ম রোধ করতে বিভিন্ন কোম্পানির পর্ষদে পরিবর্তন আনা, দীর্ঘ দিন ধরে শেয়ার হোল্ডারদের ডিভিডেন্ড না দেয়া ওটিসিতে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সচল করা সহ এক গুচ্ছ উদ্যোগ নেয়া। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি গত এক যুগেও এমন ডায়নামিক নেতৃত্ব গুনাবলী সম্পন্ন চেয়ারম্যান পায়নি। ফলে আর্থিক ও প্রশাসনিক দিক দিয়ে তিনি শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছেন। একই সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হওয়ায় একটি মহলে তার পরিচিতি রয়েছে।
সূত্র জানিয়েছে, পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার দায়িত্বে থাকলেও অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম ক্ষমতাসীন সরকারের অর্থনীতি-সংক্রান্ত বিভিন্ন নীতিনির্ধারণী সভায় উপস্থিত থাকেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরবর্তী গভর্নর হিসেবে তাকে নিয়েই আশাবাদী অনেকে।
এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর হওয়ার তালিকায় আছেন এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব মো. নজিবুর রহমানও । এনবিআরের চেয়ারম্যান থাকাকালীন পদাধিকার বলে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ছিলেন। এনবিআরের চেয়ারম্যান পদ থেকে অবসরে যাওয়ার পরও দীর্ঘদিন তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্ষদে ছিলেন। তার প্রশাসনিক দক্ষতায় সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে সুপরিচিত। নজিবুর রহমানও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরবর্তী গভর্নর হতে পারেন বলে সুত্র জানিয়েছে।
এছাড়াও অর্থবিভাগের সাবেক সচিব ও সাবেক হিসাব মহানিয়ন্ত্রক (সিজিএ) মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরীও আছেন গভর্নর হওয়ার তালিকায়। মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী বিশ্বব্যাংক ও ডিএফআইডির অর্থায়নকৃত বিভিন্ন প্রকল্পে পরামর্শকের দায়িত্ব পালন করেন। সোনালী ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত এমডি ও কৃষি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। এছাড়াও বাংলাদেশের আর্থিক খাত সংস্কার ও এর প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনা খাতে ই-গভর্ন্যান্স বাস্তবায়নে অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি ‘জনপ্রশাসন পদক ২০১৭’ পান মুসলিম চৌধুরী।