বস্ত্র ও পোশাক খাতের তিন সংগঠন বিজিএমইএ, বিকেএমইএ ও বিটিএমএর পক্ষ থেকে এ চিঠি দেন রুবানা হক। চিঠিতে দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, ব্যবসায় ব্যয় হ্রাস ও রফতানি প্রবৃদ্ধির স্বার্থে ১ জানুয়ারি থেকেই বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনতে সিদ্ধান্ত গ্রহণপূর্বক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদানের অনুরোধ জানানো হয়।
বিকেএমইএর প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বিজিএমইএর চিঠিটি বিকেএমইএ ও বিটিএমএর সঙ্গে আলোচনা করেই দেয়া হয়েছে। বর্তমানে শিল্পে যে ক্রান্তিকাল চলছে, এ অবস্থায় বেশি দিন টিকে থাকা মুশকিল। এখন যত দেরি হবে ততই আরো কঠিন পরিস্থিতির দিকে ধাবিত হব। এ জায়গায় আমাদের রক্ষা করতে হলে অনতিবিলম্বে এক অংকের সুদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা উচিত। এর কোনো বিকল্প নেই। এতে বিনিয়োগ হয়তো দ্রুতই বাড়বে না, কিন্তু আমাদের মৃতপ্রায় অবস্থা থেকে বের হওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। এখন ১৩, ১৪ শতাংশ সুদে আমাদের বোঝা আরো বাড়বে। চার মাস দেরি হওয়া মানে চার মাসে সুদ অনেক বেড়ে যাবে। আমাদের সমস্যা থেকে বের হতে হলে আমাদের নতুন বিনিয়োগ করতে হবে, সম্প্রসারণ করতে হবে, সেক্ষেত্রে ব্যাংকঋণেরও প্রয়োজন হবে, এ সময়ে তাই চার মাস দেরিতে আরো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে। এর আগেও বিলম্ব হয়েছে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে, এখন যখন রাজি হলেনই তখন আর দেরি কেন?
বিটিএমএ সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকনও বলেন, বিজিএমইএ যে চিঠিটি আমাদের পক্ষে পাঠিয়েছে, সেটির সঙ্গে একমত পোষণ করছি। আমরাও পৃথকভাবে আজ একটা চিঠি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কাছে পাঠাব, যেন ১ তারিখ থেকে সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়।
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার জন্য দেশের সব ব্যবসায়ী সংগঠন দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছে। দেশের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসা পরিচালন ব্যয় কমানো, বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও প্রতিযোগিতা সক্ষমতা অর্জনের লক্ষ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীও। ঘোষণা ছিল, ২০২০ সালের প্রথম দিন থেকেই উৎপাদনমুখী শিল্পের জন্য ব্যাংকঋণের সুদহার হবে সিঙ্গেল ডিজিট। এ নিয়ে বেশ তোড়জোড় ছিল অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের। কিন্তু গত সোমবার বেসরকারি ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) সঙ্গে বৈঠক শেষে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন তিন মাস পেছানোর ঘোষণা দেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। সেই সঙ্গে আমানতের সুদহারও ছয় শতাংশে নামিয়ে আনা হবে বলেও জানান তিনি।
বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী বলেন, আমরা কথা দিয়েছিলাম, ১ জানুয়ারি থেকে আমানত ও ঋণের সুদহার ৬ ও ৯ শতাংশ বাস্তবায়ন করব। কিন্তু এখনো আমরা এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করতে পারিনি। প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে কিছু দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। আমাদের প্রস্তাবগুলো ঠিক রেখেই তিনি কিছু সংশোধনী দিয়েছেন। বিষয়গুলো সমন্বয় করতে সময় দারকার। আগে আমরা বলেছিলাম, এক অংকের সুদহার শুধু উৎপাদনমুখী শিল্পে হবে। কিন্তু এখন এটি সব ধরনের ঋণের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। শুধু ক্রেডিট ও ডেবিট কার্ড এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হবে। নতুন ও পুরনো সব ধরনের ঋণের ক্ষেত্রেই এটি কার্যকর হবে। ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও এমডিরা বলেছেন, সুদহারবিষয়ক নির্দেশনা বাস্তবায়নে তিন মাস সময় দরকার। এজন্য আগামী ১ এপ্রিল থেকে এটি বাস্তবায়ন হবে।
তবে অর্থমন্ত্রীর এ ঘোষণা পুনর্বিবেচনার অনুরোধ জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, বর্তমানে দেশের বস্ত্র ও তৈরি পোশাক শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো নিজ নিজ অবস্থান টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে তাদের পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধিসহ নানাবিধ সংকটপূর্ণ পরিস্থিতি মোকাবেলা করে চলছে। এমন পরিস্থিতি থেকে বস্ত্র ও তৈরি পোশাক খাতকে উত্তরণে সহযোগিতার জন্য ৯ শতাংশ হারে বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণের সুদহার জানুয়ারি থেকেই কার্যকর করা দরকার।
ব্যাংকিং খাত, সুদহার ও শিল্প খাতের সমস্যাগুলো গভীরে গিয়ে সমাধানের পরামর্শ দিয়েছেন এফবিসিসিআই সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম।তিনি বলেন, ওভারঅল ব্যাংকিং সেক্টরে কস্ট অব বিজনেস কমানোর জন্য এক অংকের কথা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছিলাম। চেয়েছিলাম সমস্যাগুলো গভীরে গিয়ে সমাধান হোক। এজন্য গত বছরের জানুয়ারি থেকে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি কয়েকবার। কী পদক্ষেপ নেয়া হয় তার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আমরা মনে করি, অ্যাডহক বেসিসে কোনো সিদ্ধান্ত দিয়ে এ সমস্যার সমাধান হবে না। সমস্যার গভীরে গিয়ে টেকসই সমাধানের আশা করছিলাম। প্রথমে বলা হলো ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ হবে। তারপর বলা হলো ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের কিছু খাতে ৯ শতাংশ। তারপর বলা হলো, জানুয়ারির ১ না এপ্রিলের ১ থেকে ক্রেডিট কার্ড ছাড়া সব খাতে ৯ শতাংশ। তিনদিনে তিন রকম কথা যেহেতু এসেছে, বর্তমানে যেটা বলা হলো সেটাকেও আমরা স্বাগত জানাই, কিন্তু সাবধানতার সঙ্গে। দেখি কী হয়!
প্রসঙ্গত, গত ২৪ ডিসেম্বর অনুুষ্ঠিত বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় দেশের ব্যাংকিং খাতের বিষয়ে বেশকিছু নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়, যার মধ্যে ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে উৎপাদনমুখী শিল্পে ব্যাংকঋণের সুদহার এক অংকে নামিয়ে আনার বিষয়টিও ছিল। এছাড়া ঋণ-আমানতের অনুপাতের (এডি রেশিও) সর্বোচ্চ সীমা ১ শতাংশ বাড়ানো, সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ অর্থ বাধ্যতামূলকভাবে বেসরকারি ব্যাংকে রাখা, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মীদের গ্র্যাচুইটি ও প্রভিডেন্ট ফান্ডের অর্থ ছাড়া অন্য যেকোনো উৎসের টাকা মেয়াদি আমানত (এফডিআর) হিসেবে না রাখার বিধান প্রণয়ন এবং প্রায় বিনা সুদে সরকারি আমানতের অর্থ ব্যাংকগুলোয় রাখার বিষয়ে সরকারকে পরামর্শ প্রদানের সিদ্ধান্তও হয়েছিল ওই সভায়। সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো ডিসেম্বরের মধ্যেই প্রজ্ঞাপন আকারে জারি করার কথা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতিনির্ধারকদের পুনর্বিবেচনার সিদ্ধান্তে তা আটকে যায়।
রফতানিকারকদের সংগঠন এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, রফতানির কস্ট কমানোর জন্য সবাই দ্রুত বাস্তবায়ন চাইছেন, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বাস্তবতাও ভেবে দেখতে হবে। একটা দেশে আর্থিক খাত দুর্বল হলে ব্যবসা শক্তিশালী হতে পারবে না। শক্তিশালী হতে হলে সবাইকেই একসঙ্গে হতে হবে। ব্যাংকও বড় খাত, তাই হয়তো ভেবেচিন্তেই সংশ্লিষ্টরা সময় পিছিয়েছেন। ৬-৯ অনেক দিন ধরেই শুনছি, কিন্তু বাস্তবায়ন হয়নি। আমি মনে করি, এপ্রিলের ঘোষণা বাস্তবতা ভেবেই দেয়া হয়েছে। তবে এটা ঠিক যে এক অংকের সুদহার যত দ্রুত বাস্তবায়ন হবে, আমাদের সক্ষমতা তত দ্রুতই বাড়বে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।