দেশের চাহিদা মিটিয়ে সেটি বিদেশেও রপ্তানির লক্ষ্য রয়েছে। ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠা করা তাদের অত্যন্ত ব্যয়বহুল আধুনিক ল্যাবে কাজ করেন ২৬ বিজ্ঞানী। তবে কানাডায় থাকা ড. কাকন নাগের নেতৃত্বে করোনার টিকা নিয়ে গবেষণাকাজে মূল ভূমিকায় আছেন আট গবেষক।
এর মধ্যে তার স্ত্রী ড. নাজনীন সুলতানাও রয়েছেন। অন্য বিজ্ঞানীরা হলেন- ড. মোহাম্মদ মহিউদ্দিন, ড. আসিফ মাহমুদ, সমির কুমার, মো. জিকরুল ইসলাম, জুয়েল চন্দ্র বাড়ই, মো. মাকসুদুর রহমান খান। প্রতিষ্ঠানের বাকি বিজ্ঞানীরাও নানাভাবে এ গবেষণায় সহযোগিতা করেছেন।
করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে টিকা আবিষ্কারের বিষয়ে গতকাল শনিবার কানাডা থেকে টেলিফোনে সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেন গ্লোবালের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ড. কাকন নাগ। তিনি বলেন, ‘সারাবিশ্বে যখন করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করে তখনই টিকা আবিষ্কারের চিন্তা মাথায় আসে। এর পর আমরা ৯ মার্চ কাজ শুরু করি। যদিও ল্যাবের কাজ শুরু হয় আরও পরে অর্থাৎ মে মাসের শেষ দিকে। দ্রুত সময়ের মধ্যেই কাজটি করতে পেরে বেশ আনন্দিত। এ গবেষণায় সরাসরি যুক্ত আছেন আট বিজ্ঞানী। এ ছাড়াও নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন আরও ১৮ জন। কাজটি করার জন্য প্রত্যেকেই ছিলেন নিবেদিত। বর্তমান পরিস্থিতির কারণে কানাডা থেকেই আমাকে নেতৃত্ব দিতে হয়েছে। যদিও গ্লোবালাইজেশনের (বিশ্বায়নের) যুগ, এখন তো আর ফিজিক্যালি (স্বশারীরে) যাওয়া লাগে না; বরং কানাডায় থাকার কারণে গবেষণাকাজে বেশি সময় দেওয়া গেছে। বাংলাদেশে যখন দিন তখন এখানে রাত। এই দেখেন- এখন এখানে রাত ৩টা বাজে, আমি এখনো কাজ করছি। এটা আমার জন্য একটি বাড়তি সুবিধা। যদিও আমার ২৭ মার্চ বাংলাদেশে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু করোনা ভাইরাস সংক্রমণের কারণে বিমান চলাল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তা সম্ভব হয়নি।’
গবেষক দলের প্রধান ড. নাগ বলেন, ‘আমাদের এখনো একটা ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল বাকি আছে। কেবল অ্যানিমেল (প্রাণী) মডেলে কাজ করেছি। এখনো আমাদের হিউম্যান (মানবদেহে) মডেলে কাজ করতে হবে। হিউম্যান মডেলে কাজ করে ‘ফেস ওয়ান’ একটা স্টাডি আছে এবং ‘ফেস টু’ একটা স্ট্যাডি আছে। ‘ফেস টু’ স্ট্যাডির মধ্যে কয়েকবার ডোজটা দিতে হবে, দিলে অ্যান্টিবডি গ্রো (গড়ে উঠবে) করবে, যে অ্যান্টিবডি করোনা ভাইরাস মেরে ফেলতে পারবে। অর্থাৎ সেটাকে নিউট্রিলাইজ করতে পারবে। আরেকটা প্রি ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করব। এর পর ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে যাব।’
সফলভাবে টিকার কাজটি শেষ করতে সরকারের সব ধরনের সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন এই বিজ্ঞানী, ‘ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য সরকারের ফান্ডিংয়ের প্রয়োজন আছে। আশা করি, সরকারের দিক থেকে সেটা পাওয়া যাবে। কারণ টিকা কোনো লাভজনক ব্যবসা নয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ, যেমন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীনসহ সব দেশই সরকারের সহযোগিতা নিয়েই টিকা আবিষ্কার করছে। এটা কোনো ব্যক্তি উদ্যোগে সম্ভবও নয়। ইতোমধ্যে এ পর্যন্ত আসতেই একটা বড় অঙ্কের টাকা খরচ হয়েছে। বাকি পথ চলতে তো সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন হবে। শেষ ধাপ পর্যন্ত পৌঁছতে আমাদের আরও ৬ থেকে ৭ সপ্তাহ লাগবে। এর পর অনুমোদনের জন্য সরকারের কাছে টিকা তুলে দেব। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যদি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, ঔষধ প্রশানসন অধিদপ্তর ও সিআরও টিকার মান পরীক্ষা করে অনুমোদন দেয় তা হলে ডিসেম্বরেই এটা বাজারে আনা সম্ভব।’
দাম প্রসঙ্গে ড. কাকন নাগ বলেন, ‘আমরা বলতে পারি আমাদের টিকার দাম অন্যদের তুলনায় কম হবে। এটা তো দেওয়া হয় টিকাদান কর্মসূচির মাধ্যমে, চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী নয়। আমি মনে করি, যখন এ টিকা আমরা বাণিজ্যিকীকরণ করতে পারব সরকারই জনগণের জন্য তা ফ্রি করে দেবে। আবার স্বল্প দামেও ব্যবস্থা করে দিতে পারে সরকার। কোনো কোম্পানি তো আর ফ্রিতে টিকা দিতে পারবে না। এটার তো একটা উৎপাদন খরচ আছে। সে ক্ষেত্রে আমাদের পক্ষেও ফ্রিতে দেওয়া সম্ভব হবে না। আমরা একটা কাজ করতে পারি, দেশ ও জনগণের স্বার্থে এ টিকা থেকে কোনো লাভ করব না। তবে উৎপাদন খরচটা তো আমাদের নিতেই হবে। সরকারকেও তা জনগণের স্বার্থে দিতে হবে। আমাদের দেশে এমনিতেও বেশিরভাগ টিকা ফ্রিতেই দেওয়া হয়।’
বাংলাদেশের যে করোনা ভাইরাস রয়েছে, সেটির জিন নকশা অনুযায়ী এ টিকা আবিষ্কার করা হয়েছে বলে জানান ড. কাকন নাগ। তিনি বলেন, ‘করোনা ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স (জিন নকশা) একেক দেশে একেক রকমের হয়ে থাকে, এটা ঠিক। আমাদের যে টিকা তা বাংলাদেশে কাজ করবে। একই ধরনের (জিন নকশা) অন্যকোনো দেশের করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধেও কাজ করবে। জিনোম সিকোয়েন্স স্ক্রিনিং করে টিকা আবিষ্কার করেছি। সব ধরনের করোনা ভাইরাসের জন্যই যেন এটা কার্যকর হয়, সে চেষ্টাও আমাদের থাকবে।’
গাইডলাইনের জন্য দ্রুত সময়ের মধ্যে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হবে জানিয়ে ড. কাকন নাগ বলেন, ‘আমরা এখন ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরে যাব। তাদের একটা গাইডলাইন আছে। সে অনুযায়ীই পরবর্তী ধাপগুলো নিয়ে কাজ করব আমরা। তবে গাইডলাইনগুলো সম্পর্কে আমরাও জানি। তারা ডব্লিউএইচওর একটা গাইডলাইন ফলো করেছে। ওই অনুযায়ী আমাদের এখন যে ডেভেলপমেন্ট ডাটা আছে, সেগুলো ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে তুলে ধরা হবে। যদিও আমরা রেগুলেটরি ওয়েতে আরেকটি স্টাডি করব। ওই ডাটাগুলোসহ ওষুধ প্রশাসনের মাধ্যমে আমরা বিএমআরসিতে (বাংলাদেশ মেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টার) ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য আবেদন করব। তারা সিআরও বা থার্ড পার্টি। তারাই মূলত আমাদের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালটা করে দেবে। বিএমআরসি আমাদের প্রটোকল রিভিউ করে ক্লিয়ারেন্স দিলে ওষুধ প্রশাসনের মাধ্যমে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করব। এর পর টিকা বাণিজ্যিকীকরণের জন্য আবেদন করব। সেই অনুমোদন ফেলেই উৎপাদনে চলে যাব, বাজারে চলে আসবে টিকা।’
এই বিজ্ঞানী আরও জানান, ‘আমাদের টিকা ইনজেকশনের মাধ্যমে সুস্থ মানুষের শরীরে দেওয়া হবে। তবে একজনের শরীরে কতটা টিকা দিতে হবে তা ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের মাধ্যমে জানা যাবে।’ ড. নাগ বলেন, ‘প্রথম ধাপে আমাদের ৫০ থেকে ৭০ লাখ টিকা উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। পর্যায়ক্রমে উৎপাদন আরও বাড়াব। দেশের চাহিদা মিটিয়ে যখন আমরা রপ্তানি করব, তখন আরও বড় পরিসরে টিকা উৎপাদনের চিন্তা করতে পারব।’