বিশেষ করে বাংলাদেশের গত কয়েক দিনে আমরা অনেক ভিআইপিকে হারিয়েছি। যারা আমাদের দেশ এবং জাতির জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন। বিশেষ করে মন্ত্রী, সচিব, ডাক্তার, পুলিশ, প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারী, স্বাস্থ্যকর্মী ও সাংবাদিক ইত্যাদি।
জাপানের বিশেষজ্ঞদের আলোচনায় একটি বিষয় খুব বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে, যা কিনা বাংলাদেশের কোনো মিডিয়া থেকে এখনও শুনতে পাইনি।
নিচে একটি ছবি থেকে আলোচনা করব, যা জাপানিজ বিশেষজ্ঞরা করোনা নিয়ে আলোচনা করার সময় ব্যবহার করে থাকেন। জাপানিরা এটিকে বলে সান মিচু (মানে তিনটি ঘনত্ব) বিশ্লেষণ।
এ তিনটি ঘনত্ব হচ্ছে- ১. বন্ধ (জাপানিজে বলে মিম্পে, যার মানে হচ্ছে বন্ধ ঘর, অফিস কিংবা কোনো যানবাহন- যেখানে বাইরের বাতাস চলাচল করে না), ২. ভিড় (জাপানিজে বলে মিম্মু, যার মানে অনেক লোকের ভিড়) ও ৩. ঘনিষ্ঠতা (জাপানিজে বলে মিচ্ছেসু যার মানে একে-অপরের কাছাকাছি এসে কথা কিংবা অবস্থান করা)।
এ তিনটি ঘনত্বের প্রত্যেকটি পৃথকভাবে থাকলে তাকে জোন-১, যে কোনো দুটি একত্র হলে জোন-২ এবং তিনটি ঘনত্ব একত্রিত হলে জোন-৩ হিসেবে এখানে দেখা হয়েছে।
জোন-১: জোন-১-এ বলা হয়েছে তিনটি (বন্ধ/ ভিড়/ ঘনিষ্ঠতা) একক ঘনত্বকে। যেমন- বন্ধ কোনো (এসি) ঘরে বসবাস করা, অফিস করা কিংবা কোনো এসি গাড়ি, বাস বা ট্রেনে চলাচল করা; যেখানে সরাসরি বাইরের কোনো বাতাস ভেতরে এবং ভেতরের বাতাস বাইরে বের হতে পারে না।
যেমন- এসি রুমে কিংবা এসি বাহনে দরজা-জানালা বন্ধ থাকে, যেখানে সরাসরি ভেন্টিলেশন হয় না। এসব জায়গায় করোনা ছড়াতে পারে। আবার অনেক লোকের ভিড়ের কারণে একে-অপরের মধ্যে করোনা ছড়াতে পারে।
এছাড়াও অল্প কিংবা দু’জনে কাছাকাছি থেকে স্বাভাবিক কথা বললে কিংবা হাঁচি-কাশি দিলে করোনা ছড়াতে পারে। তাই সারা পৃথিবীতে এখন সামাজিক দূরত্বের কথা বলা হচ্ছে।
জোন-২: যে কোনো দুটি ঘনত্ব একত্রিত হলে জোন-২ হিসেবে বলা হয়েছে। যেমন- অনেক লোকের ভিড় খোলা জায়গায় হলেও একে-অপরে কাছাকাছি এলে যদি দু’জনের কারো করোনা থাকে তাহলে করোনা ছড়াতে পারে।
আবার কাছাকাছি না এসেও যদি বন্ধ রুম কিংবা যানবাহনে কোনো করোনা আক্রান্ত লোক থাকে তার কারণে ওই রুমের সবারই করোনা ছড়ানোর সম্ভাবনা থাকে। জোন-১ থেকে জোন-২-এ থাকা মানুষগুলোর মাঝে করোনা ছড়ানোর আশঙ্কা বেশি।
জোন-৩: যদি তিনটি জোন একত্রিত হয় তবে তাকে জোন-৩ হিসেবে ধরা হয়। যেমন- একটি এসি করা বদ্ধ রুম কিংবা কোনো যানবাহন যেখানে অনেক লোকের ভিড় থাকে এবং একে-অপরের দূরত্বও থাকে অনেক কম- এটিকে জোন-৩ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
এখানে লক্ষ করা যায়, জাপানের ট্রেনে যেখানে অফিস টাইমে কোনো বগিতে সুই ফেলার জায়গা থাকে না এবং এসির কারণে সব দরজা-জানালা বন্ধ থাকে। তাই এখানে জোন-৩-এ পরিণত হওয়া খুবই স্বাভাবিক।
এছাড়া ইনডোর মিটিং, ইনডোর গানের অনুষ্ঠান ও বার ইত্যাদি জোন-৩-এ পরিণত হয়। এখানে করোনা ছড়ানো খুবই সহজ।
আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাপনে কথা বলার সময় কীভাবে মুখ থেকে থুতু বের হয়- তার একটা গবেষণা করেছে জাপানের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান। একটি ছবিতে তার একটি সহজ তুলনা দেখান হয়েছে। একজন মানুষ সাধারণ গতিতে কথা বলার সময় মাস্ক পরলে এবং না পরলে কী পার্থক্য হয়- তা দেখান হয়েছে।
বাম পাশে নিচের ছোট বক্সের ছবিতে একজন মানুষ মাস্ক ছাড়া কথা বলছে এবং তার মুখের সামনে অনেক ছোট-বড় বিভিন্ন আকারে বিন্দু দেখা যাচ্ছে। এ বিন্দুগুলো হল কথা বলার সময় আমাদের মুখ থেকে বের হওয়া থুতু কণা।
আর ডান পাশে একই লোক একই গতিতে মাস্ক পরে কথা বলার সময় কোনো থুতুর কণা বের হচ্ছে না। এতে করে মাস্ক কীভাবে আমাদের আশপাশের মানুষদের করোনা ছড়ানো থেকে রক্ষা করে, তা দেখান হয়েছে।
যদি কোনো করোনা আক্রান্ত লোক মাস্ক ছাড়া কথা বলে তাহলে সহজেই আশপাশে থাকা লোকেরা করোনায় আক্রান্ত হতে পারে, তাই সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কথা সারা পৃথিবীতে বলা হচ্ছে।
একই সঙ্গে মাস্ক পরলে পাশের লোক থেকে নিজকে রক্ষা করা এবং নিজের থেকে পাশের লোকটিকে রক্ষা করা আরও সহজ হবে।
এ গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, আমাদের কথা বলার সময় কিংবা হাঁচি-কাশি দেয়ার সময় মুখ থেকে যে থুতু কণা বের হয়, সেটি বিভিন্ন আকারের হয়ে থাকে। কথা বলার সময় কিংবা হাঁচি-কাশি দেয়ার সময় মুখ থেকে বের হওয়া থুতুর কণাগুলোর মধ্যে যেটি বড় সাইজের সেটি খুব কাছেই মাটিতে পড়ে যায়।
ক্রমাগত ছোটগুলো বাতাসের চাপে বেশি দূরে যায়, যা কিনা সহজেই আশপাশে থাকা অন্য মানুষের মুখে কিংবা গায়ে লেগে যেতে পারে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, আমাদের কথা বলার সময় কিংবা হাঁচি-কাশি দেয়ার সময় কিছু থুতুর কণা বের হয়, যার সাইজ ১ মিলিমিটারের ১০ হাজার ভাগের ১ ভাগ এবং এ সাইজের থুতু বিন্দুটি কখনই মাটিতে পড়ে না।
আবার এ ১০ হাজার ভাগের ১ ভাগ সাইজের থুতু বিন্দুটিতে ওই লোকের শরীরে থাকা রোগজীবাণু বহন করার ক্ষমতা রাখে। এ ছোট থুতু বিন্দুটি পরিবেশের তাপমাত্রা, আর্দ্রতা ও ঘনত্বের ওপর ভিত্তি করে ওপর থেকেই শুকিয়ে যেতে পারে এবং রোগজীবাণুও মরে যেতে পারে আবার আশপাশে থাকা মানুষের গায়ে লেগে রোগজীবাণু ছড়াতে পারে।
এ গবেষণার ভিত্তিতে গত কয়েক মাস ধরে জাপানের ট্রেন, অফিস, মার্কেট, খাবার হোটেল ও বার ইত্যাদিতে জনসমাগম হয়- এমন স্থানে জানালা খোলা রাখা হচ্ছে যাতে করে ভেন্টিলেশন হয় এবং বাইরের সঙ্গে বাতাস আসা-যাওয়া করতে পারে।
এবার আসি বাংলাদেশের ভিআইপিদের করোনা আক্রান্তের কারণের সঙ্গে এ গবেষণার কী সম্পর্ক আছে? যে কোনো দেশের ভিআইপি মানেই প্রতিদিন তার সঙ্গে অনেক লোকের সাক্ষাৎ।
সেটি হতে পারে বাইরে, হতে পারে তার চেম্বারে, হতে পারে কোনো ফাইভ স্টার হোটেলে আবার হতে পারে তার নিজ বিলাসবহুল বাসভবনে। আর এ ভিআইপিদের ক্ষেত্রে ইনডোর মিটিং যেখানেই হোক না কেন, বেশিরভাগ স্থানেই এসি লাগানো থাকে, যেখানে বাইরের সঙ্গে ভেন্টিলেশন হয় না বা বাতাসের সরাসরি যাওয়া-আসা করার কোনো সুযোগ থাকে না।
বাংলাদেশের আবহাওয়া গরম হওয়ায় এসি রুমে ভেন্টিলেশন অনেকটাই অসম্ভব। তাই ভিআইপিদের রুমে যদি কখনও কোনো করোনা আক্রান্ত লোক প্রবেশ করে এবং তার কথা বা হাঁচি-কাশি থেকে ১০ হাজার ভাগের ১ ভাগ সাইজের কোনো থুতু বিন্দু বের হয়, তাতে সামাজিক দূরত্ব বজায় থাকলেও সংক্রমিত হওয়ার অনেক বেশি আশঙ্কা থাকে।
কারণ ওই রুমের এসির বাতাসের সঙ্গে থুতু বিন্দু সারা রুমে ঘুরতে থাকবে এবং কোনো এক সময় ভিআইপির শরীরেও লেগে যাবে। সেখান থেকেই হতে পারে করোনার সংক্রমণ।
তাই আমাদের দেশের উচ্চ পর্যায়ের ভিআইপিরা অনেকেই করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন এবং এর প্রতিকার না নিলে পরবর্তী সময়ে আরও হতে পারে। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রতিদিন এসি (বন্ধ) রুমে মিটিং করে থাকেন, এসি যানবাহনে চলাচল করে থাকেন যেখানে বাইরের বাতাসের প্রবাহ কথা নয়।
তাই বাংলাদেশের দায়িত্বপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর এ বিষয়ে সতর্ক হয়ে নিজ নিজ রুম কিংবা যানবাহনের ভেন্টিলেশনের দিকে বিশেষভাবে খেয়াল রাখার অনুরোধ রইল। তাতে করে একটু হলেও বাংলাদেশের ভিআইপিদের করোনা থেকে কিছুটা রক্ষা করা যেতে পারে।
এ জন্য যারা এসি রুমে থেকে মিটিং, অফিস কিংবা কাজ করেন, যেখানে প্রতিদিন বিভিন্ন লোকের আসা-যাওয়া হয় ওইসব রুমে বেশিরভাগ সময় জানালা খুলে হাওয়া পরিবর্তন (ভেন্টিলেশন) করুন।
বিশেষ করে মিটিং কিংবা বাইরের লোকের আগমন হলে জানালা খুলে দিন এবং মাস্ক পরে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন।
এতে করে আমাদের কথা বা হাঁচি-কাশি থেকে বের হওয়া থুতুর বিন্দুগুলো বাতাসের মাধ্যমে বাইরে চলে যাবে আর একে-অপরকে করোনা থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা করা যাবে।
অনেকেই মাস্কের ধরন কিংবা গুণগত মান নিয়ে অনেক কথা বলে থাকেন; কিন্তু এ গবেষণায় দেখান হয়েছে, সাধারণ কাপড়ের মাস্ক থেকে শুরু করে যে কোনো ধরনের মাস্কই আমাদের মুখ থেকে বের হওয়া থুতু বিন্দু আশপাশের মানুষের কাছে ছড়াতে বাধা প্রদান করে।
এ জন্য জাপান সরকার প্রতিটি পরিবারের জন্য দুটি করে কাপড়ের মাস্ক সবার বাসায় পৌঁছে দিয়েছে এবং দিচ্ছে। কারণ এ মাস্ক ধুয়ে বারবার ব্যবহার করা যাবে। অনেকেই এন-৯৫ মাস্কের কথা বলে থাকেন- অবশ্যই ভালো মাস্ক, ভালো কাজ করবে।
সাধারণ মাস্কও আপনার-আমার নিরাপত্তার জন্য জরুরি ভূমিকা রাখতে পারবে। তাই যে কোনো মাস্কেরই বিশেষ উপকারিতা আছে। তাই আসুন সবাই নিজের এবং আশপাশে সবাইকে বাঁচাতে যে কোনো ধরনের মাস্ক ব্যবহার করি। মানুষ বাঁচলে সমাজ বাঁচবে, সমাজ বাঁচলে দেশ বাঁচবে।
আসুন সবাই মিলে মানুষ, সমাজ এবং আমার সোনার বাংলাদেশকে বাঁচাই।
ড. মোহাম্মদ আখেরুজ্জামান: টোকিও, জাপান
akharuzzaman@yahoo.com