বৈশ্বিক করোনা মহামারীতে কোয়ারেন্টাইনের এই সময়ে সারাবিশ্বের মানুষ যখন ঘরবন্দী তখন প্রকৃতি যেন স্বমহিমায় উদ্ভাসিত। করোনা ভাইরাসের তান্ডবে বিপর্যস্ত ইতালিতে দেখা গেছে নজরকাড়া পরিবর্তন। ইতালির উপকূল ও ভেনিস খাল থেকে দূরে চলে যাওয়া প্রাণীকূল আবার ফিরে আসতে শুরু করেছে সেখানে। ইতালির বন্দরে ডলফিন লাফ দিচ্ছে। টুইট করা একটা ছবিতে দেখা গেছে একটি শুকুর শহরের রাস্তার মাঝে চলে এসেছে। রোমের ঝর্ণায় আবার হাঁস এসেছে। ভেনিসের পানি এখন পরিস্কার এবং তাতে মাছ দেখা যাচ্ছে। কমে গেছে বায়ুদূষণ। কোয়ারিন্টাইনের এই সময়টা যেন বহুকাল আগের সেই পৃথিবীটার মতো।যেখানে জনসংখ্যা ছিলো সীমিত এবং প্রকৃতিতে ছিলো মানুষের সুনিয়ন্ত্রিত বিচরণ।
১৯৮৭ সালের ১১ জুলাই বিশ্বে মোট জনসংখ্যা পাঁচশো কোটিতে উন্নীত হয়। বিষয়টা বিবেচনায় নিয়ে টঘউচ এর গভর্ন্যান্স কাউন্সিলে বছরের এই দিনটিকে বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত হয়। বর্তমানে বিশ্বে মোট জনসংখ্যা ৭৭৮ কোটিরও বেশি। এই সংখ্যা প্রতি সেকেন্ডে পরিবর্তন হচ্ছে। প্রতিদিন জন্ম নিচ্ছে ২,৫১,১৬৪ জন নতুন শিশু। বিশ্বে গত বছরে ১.০৭% মানুষ বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রথম স্থানে রয়েছে চীন। চীনের জনসংখ্যা ১৪০ কোটি, দ্বিতীয় স্থানে ভারত লোকসংখ্যা ১৩৫ কোটি, তৃতীয় স্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্র লোকসংখ্যা ৩৩ কোটি। ২০১৮ সালে শীর্ষে ১০ জনবহুল দেশের তালিকায় ৮ম স্থানে বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্রের আদমশুমারীর তথ্য মতে বিরাটকার পৃথিবীর এক ক্ষুদ্র ভূ-খন্ডের নাম বাংলাদেশ। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের দেশে জনসংখ্যা ১৫ কোটিরও বেশি। দেশটির প্রধান সমস্যা অতিরিক্ত জনসংখ্যা। প্রতিবছর ৩০ লাখ নতুন মুখ যোগ হচ্ছে। এভাবে বাড়তে থাকলে ২০৫০ সালে লোকসংখ্যা হবে ২৫ কোটিরও বেশি।
রাস্তায় নামলে যানজটে রাস্তা ফাঁকা নেই, বাসে উঠলে বসার সিট নেই, ডাক্তারের কাছে গেলে সিরিয়াল নেই, ইন্টারভিউ দিতে গেলে পর্যাপ্ত পদ খালি নেই। এসবই একটি দেশের জনসংখ্যা বিস্ফোরনের লক্ষণ।বর্তমানে বাংলাদেশে যে একটা জনসংখ্যা বিস্ফোরণ চলছে তা চারদিকে তাকালেই বুঝা যায়। বাংলাদেশে প্রতি সেকেন্ডে জন্ম নিচ্ছে ৯ জন শিশু। আমাদের দেশে যে এখেেনা একটি বড় অংশের মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে বাস করছে। তার অন্যতম প্রধান একটি কারণ হলো অতিরিক্ত জনসংখ্যা। বাংলাদেশে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১ হাজার ২৬৫ জন লোক বাস করে (চীনে ১৫০, ভারতে ৪৫০)। মধ্যম আয়ের স্বপ্ন দেখা বাংলাদেশ এখনো ৪ কোটি লোক দারিদ্র সীমার নিচে বাস করছে। অতি দরিদ্র মানুষের সংখ্যাও দুই কোটির কাছাকাছি। জীবন ধারণের নূন্যতম সুযোগ সুবিধা থেকে যারা বঞ্চিত। নীতিনির্ধারকেরা চীন ও জাপান এক সন্তান নীতি থেকে সরে এসেছে বলে যে যুক্তি দেখাচ্ছে সেটি জনাধিক্যের চাপে প্রায় ন্যুব্জ বাংলাদেশের জন্য মোটেই প্রযোজ্য নয়।
দেশজুড়ে বাল্যবিবাহ, শিক্ষার অভাব, সচেতনতার অভাব, বহু বিবাহ, দারিদ্র, সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কার, চিত্তবিনোদনের অভাব, জন্ম নিয়ন্ত্রন সম্পর্কে অজ্ঞতা, সঠিক সময়ে জন্মনিয়ন্ত্রন সামগ্রীর প্রাপ্তির অভাব, অধিক জনসংখ্যার কুফল সম্পর্কে অজ্ঞতা, জনসংখ্যা বৃদ্ধি সম্পর্কে নীতিনির্ধারকগণের বার বার পরিকল্পনা,ধর্মীয় কারণে অনেকেই বিশ্বাস করেন, সৃষ্টিকর্তা যেহেতু আমাদের সৃষ্টি করেছেন তাই খাবারের ব্যবস্থাও তিনি করবেন। তাই তারা অধিক সন্তান জন্ম দেয়ার খারাপ দিক সম্পর্কে কখনো ভাবেন না। আবার আমার দেখা অনেক উচ্চ শিক্ষিত পরিবার যারা সমাজের এলিট পার্সন বলে পরিচিত তাদেরও অনেক পরিবারে দেখা যায় দুই সন্তান মেয়ে হলে তৃতীয় সন্তানের জন্ম দিচ্ছেন। তাদের মনে ঐকান্তিক ইচ্ছে তৃতীয় সন্তানটি যেন ছেলে হয়। কিন্তু খুব কমই দেখা যাচ্ছে কিংবা নেই বললেই চলে যে, প্রথম দুই সন্তান ছেলে হলে আবার তারা তৃতীয় সন্তান জন্ম দিচ্ছেন। এর থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, এখনও আমাদের সমাজের অধীকাংশই জেন্ডার বৈষম্যে বিশ্বাসী,ছেলে সন্তানকে বংশের বাতি/প্রদীপ বলে ভ্রান্ত বিশ্বাস মনে পোষণ করে। ফলে পরিবারও দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়।
অতিরিক্ত ৩০ লক্ষ মানুষ দেশের জনসংখ্যার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। এর ফলে দেশে আবাসন সমস্যা, খাদ্যাভাব, পুষ্টিহীনতা, বেকারত্ব, মাথাপিছু আয়ের স্বল্পতা, জীবনযাত্রার মান নিম্নমুখী, সড়ক দুর্ঘটনা, যানযট, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, জীববৈচিত্র ধ্বংস, জমির খন্ড-বিখন্ডতা বৃদ্ধি পেয়েছে। অতিরিক্ত মানুষের বাসস্থানের চাহিদা মেটাতে বন উজাড় হচ্ছে এবং অধিক উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহারে জমির উর্বরতকা নষ্ট হচ্ছে ও পরিবেশ দূষণ প্রকট হয়ে দেখা দিচ্ছে।
অতিরিক্ত জনসংখ্যা যে বাংলােেদশের জন্য অত্যন্ত গুরুতর সমস্যা তা সর্বস্তরের জনগণকে উপলব্ধি করতে হবে। প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাংলাদেশে ১ হাজার ১২৫ জন মানুষ বাস করে। ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে শুরু করে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতির জীবনের সর্বক্ষেত্রে নানামুখী সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে এবং সে সব সমস্যা দিন দিন যেন বেড়ে চলছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এসব জনসংখ্যা আরও তীব্র রূপ ধারণ করছে। বৈজ্ঞনিকভাবে যখন জনসংখ্যা কোন ভৌগলিক সীমা ধারণ ক্ষমতার তুলনায় বেশি হয়ে যায়, এবং প্রাকৃতিকভাবে পরিবেশের ক্ষতিপূরণের চেয়ে দ্রুত পরিবেশের ক্ষতি সাধন করে, ধীরে ধীরে তা পরিবেশগত ও সামাজিক পতনের দিকে পরিচালিত করে। যা আমরা এখন অনেকটাই করোনা মহামারী থেকে উপলব্ধি করতে পারছি।তাই আমাদের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের দিকে বিশেষভাবে মনোযোগী হওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন।
একবিংশ শতাব্দীর দরজায় দাঁড়িয়ে জনসংখ্যা বিস্ফোরণের এই পাগলা ঘোড়ার লাগাম টানা বেশ জরুরি। জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি সম্প্রতি বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। ২০৪০ থেকে ২০৫০ সালের মধ্যে জনসংখ্যা ৮ থেকে ১০.৫ বিলিয়নে পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, বর্তমান প্রেক্ষিতে পৃথিবীর ধারণক্ষমতা ৪ থেকে ১৬ বিলিয়নের মধ্যে। ধরিত্রী মাতার অতিরিক্ত জনসংখ্যা পরিবেশের উপর, জীববৈচিত্রের উপর কতোটা বিরূপ প্রভাব বিস্তার করছে তা বৈশ্বিক করোনা মহামারী আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে নভেল করোনা কোন ভাইরাস নয়, আমরাই যেন প্রকৃতির ভাইরাস হয়ে বিরাজ করছি।
বৈশ্বিক করোনা পরিস্থিতিতে এই ২/৩ মাসের হোম কোয়ারিন্টিন সহ প্রকৃতিতে মানুষের নিয়ন্ত্রিত বিচরণে বিশ্ব জলবাযু তথা জীববৈচিত্র্য যেন প্রাণ খুঁজে পেয়েছে। নিজ বাংলাদেশকেই উদাহরন হিসেবে ধরা যাক। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিশ্বের বায়ুমান যাচাই সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম থেকে সরে ২৫তমতে গিয়ে দাঁড়িয়েছে যা জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারী ২০২০ সময়েও ৩০০ এর উপরে ছিল। যা শুধু অস্বাস্থ্যকরই নয় ছিলো দুর্যোগের পর্যায়ে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করতেন। এমনটা সম্ভব হয়েছে কেবল লকডাউনের কারনে যানবাহন কম, ইটভাটা বন্ধ, কনস্ট্রাকসন কাজ বন্ধ থাকায়।ধরিত্রী মাতাকে বাচাঁতে, এই জীব বৈচিত্র্য কে বাঁচাতে আমাদের এগিয়ে আসতে হবে। সর্বস্তরের মানুষকে আন্তরিকতা নিয়ে নিজ অবস্থানে থেকে ভূমিকা পালন করতে হবে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমাতে পারলেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সেই ক্ষুধা মুক্ত, দারিদ্রমুক্ত, সুখী-সমৃদ্ধি-স্বনির্ভর সেনার বাংলা গড়ার পথ সুগম হবে। এক্ষেত্রে স্মরণযোগ্য ম্যালথাসের সেই আমোঘ ভবিষ্যদ্বানী কোন দেশে জনাধিক্য দিখা দিলে সে দেশ যদি তা নিয়ন্ত্রন করতে ব্যর্থ হয় তবে দুর্ভিক্ষ, মহামারী, প্লাবন ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিবে যা হয়ত জনসংখ্যাকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করবে। ম্যালথাসের এই বানী বর্তমান বিশ্ব করোনা মহামারীতে হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করতে পারছে।
অতিরিক্ত জনসংখ্যার অতিরিক্ত চাহিদা। আর প্রকৃতির বুকে তাদের অবাধ বিচরণে ধরিত্রি মাতা যখন হাপিয়ে উঠেছে, জীববৈচিত্র্য রক্ষার আলোচনায় মানুষের অতি প্রয়োজনীয়তা বাঁধ সাধছিলো। তখন ম্যালথাসের ভবিষ্যদ্বানী অনুযায়ী ধরিত্রি মাতাকে রক্ষার দায়িত্ব তুলে নিলো কোভিড-১৯ নামক অতিক্ষুদ্র একটি ভাইরাস। কোভিড-১৯ এর তান্ডবে সারাবিশ্বের মানুষ যখন দিশেহারা, শক্তিমান রাষ্ট্রগুলো যখন অসহায় তখন প্রকৃতি যেন আপন মনে হাসছে। নিজের রূপের পসরা সাজিয়ে বসছে। প্রকৃতির এমন রূপের মহিমা পৃথিবীর মানুষ যেনো দেখেনি কত যুগ, কত কাল! এই বাস্তবতা থেকে নতুন করে শিখতে শুরু করছে মানুষ। তারা উপলব্ধি করতে শিখছে যে, ধরিত্রী মাতার পরিবারে থাকবে নিয়ন্ত্রিত জনসংখ্যা আর ধরিত্রি মাতার বুকে হবে তাদের সুনিয়ন্ত্রিত বিচরণ।
তবে এই শিক্ষা করোনার পরও থাকবে কিনা সেটাই আজকের প্রতিপাদ্য বিষয়।আমরা শুধৃ করোনা কালিন সময়ে নয় সারাবছর সমুদ্র উপকূলে ডলফিনের অবাধ বিচরন আর বালুকাময় তটে Ipomoea pescaprae (বীচমর্নিং গ্লোরি ফুল)এর মন মাতানো হাসি দেখতে চাই। তাই সর্বাগ্রে প্রয়োজন জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রনে পৃথিবীর সকল দেশের মানুষ ও সরকার প্রধানদের গুরুত্বপূর্ণ কিছু মৌলিক সিদ্ধান্তে ঐক্যমত্যে পৌঁছানো এবং তা প্রত্যেককে কঠোরভাবে মেনে চলা। তবেই আমরা কোভিড-১৯ সহ যেকোন মহামারী ও প্রাকৃতিক দুর্যোগকে জয় করে জীববৈচিত্র্যময় এক সমতার পৃথিবী গড়ে তুলতে পারবো।
মোসা. সেলিনা আকতার
সহকারী অধ্যাপক
উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ,পটুয়াখালী সরকারি কলেজ,পটুয়াখালী