বাংলাদেশী কর্মীদের আতঙ্ক নিয়ে লেবানন দূতাবাস বলছে, লেবাননে সৌদি ও ইরানপন্থীদের উত্তেজনা, স্থানীয় রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিদেশী বিনিয়োগ না থাকায় এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এছাড়া ডলার সংকটে কর্মীদের বেতন-ভাতা দিতে পারছে না দেশটির বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। যে কারণে আতঙ্ক কিছুটা বেড়েছে। শুধু বাংলাদেশীদের মধ্যে নয়, লেবাননে কর্মরত সব প্রবাসী কর্মীর মধ্যে এ আতঙ্ক বিরাজ করছে।
শুধু লেবানন নয়, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবেও কর্মসংস্থান হারানোর আতঙ্ক বাড়ছে প্রবাসীদের মধ্যে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশী আছে সৌদি আরবে। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য বলছে, প্রায় ২১ লাখ বাংলাদেশী সৌদি আরবে কর্মরত আছেন। ব্যাপকমাত্রায় সৌদীকরণের ফলে এমনিতেই দেশটি থেকে নিয়মিত ফেরত আসছেন বাংলাদেশী কর্মীরা। সম্প্রতি ইরান-মার্কিন টানাপড়েনেও যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশ সৌদি আরবে বাংলাদেশী কর্মীদের মধ্যে কর্মসংস্থান হারানোর আতঙ্ক আরো বেড়ে গেছে।
দাম্মামে বসবাসরত রানা রহমান নামে এক প্রবাসী বাংলাদেশী বলেন, কয়েক মাস আগে সৌদির বৃহৎ তেল স্থাপনা আরামকোয় ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের হামলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এতে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে সৌদি নাগরিক থেকে শুরু করে বহু প্রবাসী। সৌদির বৃহৎ তেল কোম্পানিগুলো নিয়ন্ত্রণ করে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন-ইরান উত্তেজনার ফলে হুথিরা যদি আবারো এ ধরনের হামলা চালায়, তাহলে এখানকার অনেক কোম্পানি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। কাজ হারাতে পারে বহু প্রবাসী।
এদিকে রিয়াদে বসবাসরত বেশ কয়েকজন প্রবাসী জানান, ইয়েমেনের সঙ্গে সৌদির যুদ্ধ চলমান। ইয়েমেনে এ হুথি বিদ্রোহীদের প্রতি ইরানের সমর্থন রয়েছে। তাই ইরানে হামলা হলে আমেরিকার মিত্র দেশ হিসেবে সৌদির ওপর হামলা চালাতে পারে হুথিরা, যার প্রভাব পড়বে প্রবাসীদের কর্মসংস্থানে।
সহসাই মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে মনে করেন না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ। তিনি বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের (ইরান-মার্কিন উত্তেজনা) এ ঘটনার দুটো দিক। একটি হলো সেটা কতদূর গড়াবে। যদি সামরিক কোনো হস্তক্ষেপ হয়, তাহলে আরো ঝামেলা হবে। তবে মনে হচ্ছে না, সেটা হতে যাচ্ছে।
তবে চলমান অস্থিরতার একটা প্রভাব পড়তে পারে জানিয়ে তিনি বলেন, যেভাবে আমেরিকার রাজনীতি চলছে এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে যে রাজনীতি তাতে বোঝা যাচ্ছে, খুব তাড়াতাড়ি সবকিছুর সমাধান হবে না। এ কারণে আমাদের বিকল্প শ্রমবাজার নিয়ে আরো চিন্তাভাবনা করা উচিত।
মধ্যপ্রাচ্যের দ্বিতীয় বৃহৎ শ্রমবাজার সংযুক্ত আরব আমিরাত। দেশটিতে সাড়ে সাত লাখের মতো প্রবাসী রয়েছেন। আবুধাবিতে ব্যবসা করেন এসএম আলাউদ্দীন। তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, আমরা লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছি এখানে। মার্কিন-ইরান উত্তেজনায় যদি কোনো যুদ্ধ শুরু হয়, তাহলে আমাদের ব্যাপক ক্ষতির মধ্যে পড়তে হবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম মিত্র দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত। দেশটিতে প্রায় পাঁচ হাজার সৈন্য রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সেনা উপস্থিতি থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের সব ধরনের কর্মকাণ্ডে সমর্থন দিয়ে আসছে দেশটি। এ কারণে সম্প্রতি ইরান সৌদি আরবের পাশাপাশি সংযুক্ত আরব আমিরাতেও হামলার হুমকি দিয়েছে।
আবুধাবিতে বসবাসরত আরেক বাংলাদেশী বলেন, আমরা অনেক ভয়ের মধ্যে আছি। মনে হচ্ছে দেশে চলে যাই। কিন্তু ভিসা জটিলতার কারণে এ মুহূর্তে কিছুই করতে পারছি না।
প্রবাসীদের এমন উদ্বেগে সংযুক্ত আরব আমিরাতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ডা. ইমরান আহমদের কাছে জানতে চাইলে তিনি কোনো ধরনের মন্তব্য করতে রাজি হননি।
লেবানন, সৌদি আরব ও আরব আমিরাতের প্রবাসীরা আতঙ্কের কথা জানালেও উপসাগরীয় দেশ কাতারে বসবাসরত বাংলাদেশী শ্রমিকরা জানিয়েছেন ভিন্ন কথা। তারা জানান, এখানে কোনো ধরনের সমস্যা নেই। আমরা স্বাভাবিকভাবেই কাজ করে যাচ্ছি।
রাজধানী দোহার নাজমায় কর্মরত নির্মাণ শ্রমিক আরজু মিয়া ও সাদ্দাম হোসেন জানান, কাতারে আমরা কোনো ধরনের সমস্যা দেখছি না। ভালোভাবেই কাজ করে যাচ্ছি।
জানতে চাইলে কাতারে বাংলাদেশ দূতাবাসের কাউন্সেলর (শ্রম) ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আপাতত কাতারে তেমন কোনো প্রভাব নেই। কাতার ও ইরান বন্ধু দেশ। তাছাড়া ইরান বলেছে, দুবাই ও ইসরায়েলের সঙ্গে তাদের বিরোধ। সুতরাং আপাতত কোনো ঝামেলা আমরা দেখছি না। তাছাড়া বাংলাদেশ দূতাবাস বিষয়টি সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করছে।
বিএমইটির তথ্যমতে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ২৮ লাখের বেশি বাংলাদেশী রয়েছেন। যার মধ্যে সৌদি আরবে কর্মরত আছেন ২১ লাখ। সৌদি আরবের পর সংযুক্ত আরব আমিরাত হচ্ছে বাংলাদেশীদের জন্য দ্বিতীয় বৃহত্তম চাকরির বাজার। ২০০৭ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে ১৬ লাখ বাংলাদেশী সংযুক্ত আরব আমিরাতে গেছেন। ২০১২ সালের শেষদিকে বাংলাদেশী শ্রমিকদের জন্য বিধিনিষেধ আরোপ করে আমিরাত সরকার। কাতারে বর্তমানে প্রায় চার লাখ বাংলাদেশী অভিবাসী কর্মরত আছেন। ইরাক ২০০৯ সাল থেকে গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত ৭৫ হাজার ৭৪৮ জন বাংলাদেশী কাজের জন্য গেছেন। গত বছর জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ইরাকে মোট কর্মী গেছেন ৯ হাজার ২৬৬ জন। আগস্টের পর থেকে দেশটিতে জনশক্তি রফতানি বন্ধ রয়েছে। সুত্র-বনিক বার্তা