বর্তমানে জ্বর নিয়ে অভিভাবকদের প্রায়ই দু:শ্চিন্তা করতে দেখা দেয়। জ্বর তিন দিনে ভালো না হলে তা মাথাব্যাথার কারণ হয়ে ওঠে। কারণ জ্বরটি যদি টাইফয়েড ও প্যারাটাইফয়েড হয় তবে প্রাণ-সংশয়কারী অসুস্থতা হতে পারে।
শিশুর টাইফয়েড জ্বরের উপসর্গ ও করণীয় নিয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মনজুর হোসেন।
জ্বরের ধরন
জ্বরের তীব্রতা কম থেকে মাঝারি ও উচ্চমাত্রার হতে পারে এবং ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে পারে। জ্বরের উচ্চমাত্রায় শিশুরা সাধারণত দুর্বল ও নিস্তেজ হয়ে পড়ে। বমি, পাতলা পায়খানা বা কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে। কারও কারও কাশির সঙ্গে শ্বাসকষ্টের লক্ষণ থাকতে পারে। জিহ্বা সাদা প্রলেপযুক্ত হয়। দ্বিতীয় সপ্তাহে, শিশুদের ত্বকে ‘রোজ স্পট’ নামে একটি অস্পষ্ট গোলাপি রঙের ফুসকুড়ি কদাচিৎ দেখা যেতে পারে যা চাপ দিলে বিবর্ণ হয়ে ওঠে। তবে এ র্যাশ ফর্সা ত্বকে ভালো বোঝা যায়।
প্যাথোলজিক্যাল পরীক্ষা
শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে টাইফয়েড জ্বর নিশ্চিত হয়ে গেলে, অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসা শুরু করতে হবে। ক্লিনিক্যাল ভিত্তিতে, চিকিৎসক দৃঢ়ভাবে টাইফয়েড সন্দেহ করলে, অ্যান্টিবায়োটিক সাধারণত ব্লাড কালচার রিপোর্ট পাওয়ার আগেই শুরু করা হয়। কারণ, ব্লাডকালচারের রিপোর্ট আসতে কমপক্ষে ৭২ ঘণ্টা সময় লাগে।
তবে মনে রাখতে হবে, অন্যান্য সংক্রমণের মতো ২-৩ দিনের মধ্যে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের মধ্যে দ্রুত হ্রাস করবে না, টাইফয়েড জ্বরে তাপমাত্রা ধীরে ধীরে হ্রাস পায় এবং সঠিক ওষুধ শুরু করার পরেও এক সপ্তাহ পর্যন্ত চলতে পারে।
অনেক ক্ষেত্রে, যদি রোগ নির্ণয় নিশ্চিত না হয়, তাহলে টাইফয়েড জ্বর ছাড়া অন্য কোনো সমস্যা আছে কিনা তা জানার জন্য আরও পরীক্ষার প্রয়োজন হতে পারে।
কখন হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন
টাইফয়েড জ্বরের সব ক্ষেত্রে ভর্তির প্রয়োজন নাও হতে পারে। টাইফয়েড জ্বরের কিছু ক্ষেত্রে, বিশেষ করে যদি হালকা এবং তাড়াতাড়ি শনাক্ত করা হয়, তবে মুখের ওষুধে রোগ ভালো হয়।
টাইফয়েড মূলত অন্ত্রের একটি সংক্রমণ যাতে অন্ত্রনালি ফুলে যায়, তাই মুখে দেওয়া অ্যান্টিবায়োটিক (সিরাপ বা ট্যাবলেট) অনেক সময় ঠিকমতো শোষণ করতে পারে না। তাই কিছু ক্ষেত্রে, ওষুধগুলো সঠিকভাবে শোষিত হয় না এবং কাজ করতে ব্যর্থ হতে পারে। এ ক্ষেত্রে শিরায় অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশন দিতে হবে, সে ক্ষেত্রে অবশ্যই হাসপাতাল বা ক্লিনিকে ভর্তিকরা প্রয়োজন।
যদি শিশু খুব দুর্বল বোধ করে, ঠিকমতো খেতে না পারে অথবা বমি করে, তাহলে ইনজেকশনের মাধ্যমে এবং গ্লুকোজ বা স্যালাইন ইনফিউশনের জন্যও অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়ার জন্য ভর্তির প্রয়োজন হয়।
টাইফয়েড জ্বরের জটিলতায় আক্রান্ত শিশুদেরও সম্পূর্ণ চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হয়।
টাইফয়েড জ্বর সঠিক চিকিৎসা এবং পুনরুদ্ধারের পরেও ৫-১০ শতাংশ রোগীর মধ্যে আবার জ্বর দেখা যায়। একে রিল্যাপস (জবষধঢ়ংব) টাইফয়েড বলে। এটি সাধারণত জ্বরের রেজোলিউশনের বা চলে যাওয়ার ২-৩ সপ্তাহ পরে ঘটে। কদাচিৎ, প্রাথমিক সংক্রমণের কয়েক মাস পরে, চিকিৎসার সময় বা পরে আবার টাইফয়েড হতে পারে। সাধারণত রিল্যাপস টাইফয়েড মূল টাইফয়েডের তুলনায় হালকা হয়। রিল্যাপস টাইফয়েড জ্বরও একই অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসা করা উচিত। খুব কম ক্ষেত্রে, টাইফয়েড জ্বরের একটি দীর্ঘস্থায়ী রিল্যাপিং ফর্ম অনেক মাস ধরে স্থায়ী হতে পারে, বিশেষ করে অ্যান্টিবায়োটিকের অপর্যাপ্ত ডোজ দিয়ে চিকিৎসা করা হলে।
প্রতিরোধ ও প্রতিষেধক
যেখানে পয়ঃনিষ্কাশন বা স্যানিটেশন পরিকাঠামো অপর্যাপ্ত সেখানে টাইফয়েডের বিস্তার রোধ করার জন্য পানি, স্যানিটেশন এবং হাইজিন (WASH)-এর প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। তবে টাইফয়েড জ্বর প্রতিরোধের জন্য এ টিকা বা ভ্যাকসিন অতিরিক্ত সুরক্ষা প্রদান করে।
ফুটানো পানি : যেহেতু টাইফয়েড রোগ পানি ও খাদ্যবাহিত রোগ এবং টাইফয়েড-আক্রান্ত রোগীদের মল বা প্রস্রাবে এ জীবাণু থাকে এবং পানি সরবরাহ ব্যবস্থাকে দূষিত করতে পারে, বিশেষ করে বর্ষাকালে। তাই পান করার আগে পানি ফুটিয়ে পান করতে হবে।
বাসি, খোলা বা কম রান্না করা খাদ্য, কাঁচা শাকসবজি বা দূষিত দুধ এবং দুগ্ধজাত পণ্যও খাওয়া পরিহার করা উচিত।
ষব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা যেমন, টয়লেট শেষে, খাওয়ার বা শিশুকে খাওয়ানোর আগে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া। একইভাবে, ব্যবহারের আগে প্লেট, বাটি, চামচ ইত্যাদি পরিষ্কার সাবান-পানি দিয়ে ধোয়া জরুরি।
টিকা : টাইফয়েড ভ্যাকসিন বা টিকা টাইফয়েড থেকে রক্ষা করে। বর্তমানে দুই ধরনের টাইফয়েড ভ্যাকসিন বাংলাদেশে পাওয়া যায়-টাইফয়েড পলিস্যাকারাইড ভ্যাকসিন এবং টাইফয়েড কনজুগেট ভ্যাকসিন। সাধারণত টাইফয়েড টিকা ২ বছরের বেশি বয়সের শিশুদের জন্য সুপারিশ করা হয়। এটি প্রতি ৩ বছর পরে পুনরাবৃত্তি করতে হবে। বিকল্পভাবে টাইফয়েড কনজুগেট ভ্যাকসিন বা টিসিভি শিশু ৬ মাসের পর থেকে দেয়া যায়।
নির্দেশিকা অনুসারে টিসিভির বুস্টারডোজ দেওয়ার দরকার হয় না। টাইফয়েড টিকা টাইফয়েড প্রতিরোধে সহায়তা করে। টাইফয়েড প্রতিরোধকারী বিভিন্ন ধরনের ভ্যাকসিন রয়েছে-আপনার শিশুর ক্ষেত্রে কোনটি উপযুক্ত তা জানতে আপনাকে সর্বদা আপনার শিশু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।