দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)। প্রায় হাজার কোটি টাকার শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয় নিয়মিত। একসময় এ লেনদেন প্রায় তিন হাজার কোটিও ছিল। তবে সাম্প্রতিক সময়ে গুজবসহ অন্যান্য ইস্যুতে অস্বস্তিতে আছে বিনিয়োগকারীরা। এর মধ্যে বিনিয়োগকারীদের ভোগাচ্ছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ওয়েবসাইট। ওয়েবসাইট অচল হওয়ায় একাধিকবার লেনদেন বন্ধ রাখতে হয়েছে ডিএসইকে, ভুগতে হয়েছে বিনিয়োগকারীদের।
শুধু ওয়েবসাইটের সমস্যা নয়, ট্রেডিং প্লাটফর্মে ভুল তথ্য দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে ডিএসইর। এসব কারণে প্রধান শেয়ারবাজারের আইটি বিভাগের কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। রোববার (৩১ অক্টোবর) ডিএসইর চিফ টেকনোলজি অফিসারকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)
জানা গেছে, গত সপ্তাহের শেষদিন (বৃহস্পতিবার) প্রায় ৭০টি প্রতিষ্ঠান লভ্যাংশ ঘোষণা করে। নিয়ম অনুযায়ী, লভ্যাংশ ঘোষণার পরের কার্যদিবসে কোম্পানিগুলোর প্রাইস লিমিট ওপেন থাকে। ফলে শেয়ারদরের কোন সার্কিট ব্রেকার (সীমা) থাকে না। রোববার (৩০ অক্টোবর) লভ্যাংশ ঘোষণা করা কোম্পানিগুলোর সার্কিট ব্রেকার তুলতে গিয়ে সব প্রতিষ্ঠানের সার্কিট ব্রেকার তুলে দেওয়া হয়। ফলে সকাল সাড়ে ৯টায় লেনদেন চালু হয়নি।
সার্কিট ব্রেকার সংক্রান্ত ভুলের কারণে গতকাল একাধিকবার ঘোষণা দিয়েও লেনদেন চালু করতে কয়েকবার ব্যর্থ হয় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ। রোববার সকাল ১০টা ১৯ মিনিটে ডিএসই ওয়েবসাইটে ঘোষণা দেওয়া হয় সাড়ে ১০টা থেকে লেনদেন চালু হবে। তবে এ ঘোষণা কার্যকর করতে পারেনি প্রধান শেয়ারবাজার কর্তৃপক্ষ। এরপর ১০টা ৪৫ মিনিটের দিকে পুনরায় ঘোষণা দেওয়া হয় ১১টা থেকে চালু হবে ডিএসইর লেনদেন।
এর আগে গত ২৪ অক্টোবরও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের লেনদেন বেলা ১০টা ৫৮ মিনিটে বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে দুপুর ২টা ১০ মিনিটে লেনদেন চালু করা হয়। ট্রেডিং আওয়ারের (লেনদেনের সময়) নির্দিষ্ট সময় দুপুর ২টা পর্যন্ত হলেও সেদিন আড়াইটা পর্যন্ত মাত্র ২০ মিনিটের জন্য লেনদেন চালু করে ডিএসই। সেদিনের ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে শেয়ারবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
গত বছরের ১৮ জুলাইও কারিগরি ত্রুটির কারণে লেনদেন বন্ধ হওয়ার ঘটনা ঘটে ডিএসইতে। ওইদিন সকাল ১০টায় লেনদেন শুরুর ১ ঘণ্টা ৯ মিনিট পর বেলা ১১টা ৯ মিনিটে লেনদেন বন্ধ হয়ে যায়। ত্রুটি সারিয়ে ওইদিন ফের লেনদেন শুরু হয় বেলা ১টায়।
শুধু লেনদেন বন্ধের ঘটনা নয়, ট্রেডিং প্লাটফর্মের সঙ্গে ডিএসইর ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যের বিস্তর ফারাক দেখা গেছে। গত ২৪ অক্টোবর লেনদেন পুনরায় চালুর পর দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত চালু থাকে। ওইদিন ৩৩৪ কোটি ৭৬ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে- এমন তথ্য দেয় ডিএসই। তবে এ তথ্যের সঙ্গে মেলেনি ট্রেডিং প্লাটফর্মে দেওয়া তথ্য।
সংশ্লিষ্ট সূত্র অর্থসংবাদকে জানায়, ট্রেডিং প্লাটফর্মে ২৪ অক্টোবর ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের লেনদেনের পরিমাণ দেখানো হয়েছে ৫৫৪ কোটি টাকা। যা ডিএসইর ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যের চেয়ে ২১৯ কোটি ২৯ লাখ টাকা বেশি।
এছাড়াও মেট্রো স্পিনিং মিলসের মোট ১ লাখ ৪৩ হাজার ৮৭২টি শেয়ার লেনদেন হয়েছে বলে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। অপরদিকে ট্রেডিং প্লাটফর্মে মেট্রো স্পিনিংয়ের শেয়ার লেনদেনের সংখ্যা দেখানো হয় ২ লাখ ১৯ হাজার ৩৫৫টি। তবে কোম্পানিটির শেয়ারদর উভয় প্লাটফর্মে ৪৪ টাকা ৮০ পয়সা দেখানো হয়েছিল।
এদিকে ডিএসইতে অস্বাভাবিক শেয়ারদর বসানোর ঘটনাও ঘটেছে। অর্থসংবাদের কাছে আসা একটি ছবিতে দেখা যায়, মেঘনা কনডেন্সড মিল্কের শেয়ারের দর বসানো হয়েছে প্রথমে ৪২ টাকা। পরবর্তীতে একই শেয়ারের দর কয়েকধাপ পেরিয়ে ৪ হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত বসানো হয়েছে। যদিও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অস্বাভাবিক দর বসানো হলেও শেষ পর্যন্ত স্বাভাবিক দরেই লেনদেন হয় শেয়ার।
এসব বিষয়ে জানার জন্য যোগাযোগের চেষ্টা করা হয় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এম. সাইফুর রহমান মজুমদারের সঙ্গে। তবে একাধিকবার তাঁর ব্যবহৃত মুঠোফোনে কল দিয়েও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের লেনদেনসহ অন্যান্য ত্রুটি নিয়ে কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও শেয়ারবাজার বিশ্লেষক আল আমিনের সঙ্গে। তিনি অর্থসংবাদকে বলেন, ডিএসই’র সক্ষমতা নিয়ে দীর্ঘদিন কথা হচ্ছে। আইটি বিভাগের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য তারা বাইরে থেকে সফটওয়্যার আনার চিন্তাভাবনাও করেছিল। গতকাল সার্কিট ব্রেকার সংক্রান্ত সমস্যার কারণে লেনদেন বন্ধ ছিল। বিষয়টি ডিএসই আগে চিন্তা করলে লেনদেনে সমস্যা থাকতো না। এজন্য আমরা ডিএসই’র দায়িত্বে অবহেলার কথা বলতে পারি। কারণ সিএসই কিন্তু ঠিকভাবেই সার্কিট ব্রেকার সংক্রান্ত বিষয়টি নিয়ে কাজ করেছে। ফলে তাদের লেনদেনও ঠিকভাবে হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আগেরবার লেনদেন বন্ধ নিয়ে বিএসইসি একটি তদন্ত কমিটি করেছে। ডিএসই হয়তো সমস্যাগুলোর কথা কমিটিকে জানিয়েছে, এসব সমস্যার সমাধান করা হয়তো দীর্ঘ প্রক্রিয়া। সবাই সমন্বিত সিদ্ধান্তে আসলে হয়তো আমরা এসব বিষয়ে জানতে পারবো।
অস্বাভাবিক শেয়ারদর বসানোর বিষয়ে শেয়ারবাজারের এই বিশ্লেষক বলেন, অনেকে অনেক সময় অস্বাভাবিক দর বসিয়ে রাখে। সাধারণত যেদিন সার্কিট ব্রেকার থাকে না, সেদিন অনেককেই এরকম অস্বাভাবিক দর বসিয়ে রাখতে দেখা যায়। তবে মনে হয় না অস্বাভাবিক দরে লেনদেন হয়। লেনদেন হয় স্বাভাবিক দরেই।
তিনি বলেন, সাধারণত এসব নিয়ে কাউকে অফিসিয়ালি অভিযোগ করতে দেখিনি। স্ক্রিনশট নিয়ে রেখে কেউ ডিএসইতে অভিযোগ করলে হয়তো তারা ব্যবস্থা নিবে। অস্বাভাবিক দরে কারা ট্রেড করছে, কেন ট্রেড করছে তা হয়তো খতিয়ে দেখবে। তবে অস্বাভাবিক শেয়ারদর বসানোও অযৌক্তিক।
বাংলাদেশ বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মিজান-উর-রশিদ চৌধুরী অর্থসংবাদকে বলেন, ডিএসইর আইটি বিভাগ দেখার দায়িত্ব তাদের নিজেদের। তিন হাজার ২০০ কোটি টাকা খরচ করে তারা নতুন সার্ভার এনেছে, তাতে আমাদের কি লাভ হয়েছে। নতুন সার্ভারের বরাদ্দকে কেন্দ্র করে তাঁরা এমডিকে পদত্যাগে বাধ্য করেছে।
বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সভাপতির অভিযোগ, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালনা পর্ষদে যারা আছে, তাদের একটি অংশ কোন এমডিকে টিকতে দেয় না।
ট্রেডিং প্লাটফর্ম ও ডিএসইর ওয়েবসাইটে তথ্যের ফারাক নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখন তো সব সফটওয়্যারের মাধ্যমে অটোমেটিক হয়। তাহলে এখন কেন দুই জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন তথ্য দেখাবে।