বুধবার (২৯ জুলাই) কমিশন সভা করে এসব সিদ্ধান্ত নিয়েছে অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলামের নেতৃত্বাধীন কমিশন। ঈদের আগে অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধে নিয়ন্ত্রক সংস্থার এমন ভূমিকার প্রশংসা করছেন সাধারন বিনিয়োগকারী সহ শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টরা।
তারা বলছেন, শেয়ারবাজারের মূল সমস্যা সুশাসনের অভাব। গত এক যুগে ধরে শেয়ারবাজারে সুশাসনের বড় অভাব ছিল। তবে অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম বিএসইসির চেয়ারম্যান হয়ে আসার পর বেশকিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছেন। এর মধ্যে অন্যতম অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধে একের পর এক পদক্ষেপ গ্রহণ করা। নিয়ন্ত্রক সংস্থার এই ভূমিকা অব্যাহত থাকলে শেয়ারবাজারে সুশাসন ফিরে আসবে। শিগগির বাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরবে। যার ফলে ধীরে ধীরে বাজার চাঙ্গা হচ্ছে। বাজারে প্রতিনিয়ত লেনদেন বাড়ছে। দীর্ঘদিন পড়ে হলেও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা ফিরতে শুরু করেছে। এর মধ্যে চলতি বছরের মুদ্রানীতিতেও পুঁজিবাজারকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
কোটি টাকা জরিমানা
আইন লঙ্ঘন করায় সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইল এবং তুং হাই নিটিং অ্যান্ড ডাইংয়ের প্রত্যেক পরিচালককে (স্বতন্ত্র পরিচালক ব্যতীত) ১ কোটি টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে।যদিও কোম্পানিটির মালিকপক্ষ দেশে নেই।
কোম্পানি দুটি ২০১৭ সালের আগস্ট থেকে ২০১৮ সালের আগস্ট পর্যন্ত সময়ে বিধি মোতাবেক মাসিক ভিত্তিতে শেয়ারহোল্ডিং প্রতিবেদন দাখিল করেনি। এ সময় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে চিঠি দেয়া হলেও তার কোনো উত্তর দেয়নি কোম্পানি দুটি। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ কর্তৃক কোম্পানির কারখানা পরিদর্শনে গিয়ে তা তালাবন্ধ পায়।
এমনকি বিএসইসি থেকে কোম্পানি দুটির পরিচালকদের শুনানিতে ডাকা হলেও তারা উপস্থিত হননি। এ কারণে কোম্পানি দুটির পরিচালকদের বড় অঙ্কের এই জরিমানা করার সিন্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
ঘোষণা ছাড়া শেয়ার বিক্রি করায় ১৪ কোটি টাকা জরিমানা
ঘোষণা ছাড়াই শেয়ার বিক্রি করায় সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, পরিচালক এবং বাংলাদেশ সু ইন্ডাস্ট্রিজকে ১৪ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
বিএসইসি জানিয়েছে, রুখসানা মোর্শেদ, শারমিন আক্তার লাভলি এবং বাংলাদেশ সুজ ইন্ডাস্ট্রিজ যথাক্রমে সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও পরিচালক থাকা অবস্থায় পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই ৭৯ লাখ ৪ হাজার, ৩০ লাখ ৩২ হাজার ৪০টি এবং ১২ লাখ ৯৯ হাজার ৪৮০টি শেয়ার বিক্রি করেন। এ বিক্রয়ের মাধ্যমে তারা যথাক্রমে ৬.৯৮ কোটি, ৩.৬১ কোটি এবং ১.৫৯ কোটি টাকা মুনাফা করেন। তাদের বিক্রয়ের সময় প্রায় কাছাকাছি ছিল এবং পূর্ব ঘোষণা ছাড়া শেয়ার বিক্রয়ের পরেই কোম্পানিটির পরিচালনা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়, যা এখনও বন্ধ অবস্থায় আছে।
এ অপরাধের জন্য সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুখসানা মোর্শেদকে ৮ কোটি টাকা, পরিচালক শারমিন আক্তার লাভলিকে ৪ কোটি টাকা এবং বাংলাদেশ সুজ ইন্ডাস্ট্রিজকে ২ কোটি টাকা জরিমানা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
কেনাকাটায় অনিয়ম : কোম্পানি, নিরীক্ষক ও ইস্যু ম্যানেজারকে জরিমানা
প্রাথমিক গণপ্রস্তাবে (আইপিও) আসার সময় কোম্পানি পরিচালকের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান থেকে মেশিনারিজ কেনার তথ্য আড়াল করে পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত কোম্পানি বিবিএস ক্যাবলস। এমনকি বিষয়টি গোপন করে নিরীক্ষক ও দুই ইস্যু ম্যানেজার ‘ডিউ ডিলিগেন্স সার্টিফিকেট’ দেয়।
এ অনিয়মের কারণে বিবিএস কেবলসের প্রত্যেক পরিচালককে (স্বতন্ত্র পরিচালক ব্যতীত) ৫ লাখ টাকা করে জরিমানা করার সিন্ধান্ত নেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে নিরীক্ষক আহমেদ জাকির অ্যান্ড কোং এবং আইপিওর ইস্যু ম্যানেজার বানকো ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ও আইসিবি ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্টকে ৫ লাখ টাকা করে জরিমানা করার সিন্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
বিএসইসি জানিয়েছে, ২০১৬ সালে তালিকাভুক্ত হওয়া বিবিএস কেবলস ২০১০-২০১৬ সালে কোম্পানির পরিচালক আশরাফ আলী খানের মালিকানাধীন গোমতী ট্রেডার্সের কাছ থেকে ৫৭ কোটি ৬৭ লাখ টাকা মূল্যের মেশিনারিজ কেনে, যা মোট কেনা মেশিনারিজের ৭৯ শতাংশ। নিয়ম অনুসারে এই ধরণের লেনদেনের তথ্য রিলেটেড পার্টি লেনদেন হিসেবে উল্লেখ করতে হয়। কিন্তু বিবিএস কেবলসের আইপিও প্রসপেক্টাসে রিলেটেড পার্টি ইনফরমেশন হিসেবে এই তথ্য উল্লেখ করা হয়নি।
এক ব্রোকারকে জরিমানা, ৮ টিকে সতর্ক
বিনিয়োগকারীদের টাকা নিজ ব্যবহারের জন্য অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়ায় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ লিমিটেডের ট্রেক হোল্ডার সালতা ক্যাপিটালকে ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
কনস্যুলেটেড কাস্টমারস অ্যাকাউন্টে ঘাটতি, নিজ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাকে ঋণ সুবিধা প্রদান এবং ক্যাশ অ্যাকাউন্টে মার্জিন সুবিধা প্রদান করায় হাবিবুর রহমান সিকিউরিটিজকে সতর্ক করা হয়েছে।
ডিএসইর প্রভাবশালী সদস্য এবং জাতীয় সংসদের সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান কাজী ফিরোজ রশিদ সিকিউরিটিজ লিমিটেড কনস্যুলেটেড কাস্টমারস অ্যাকাউন্টে ঘাটতি, নিজ প্রতিষ্ঠানের অনুমোদিত প্রতিনিধির নামে বিও হিসাব খোলা, নিজ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের মার্জিন সুবিধান প্রদান, একটি বিও হিসাবে ৫ লাখ টাকার বেশি নগদ গ্রহণ এবং ক্যাশ অ্যাকাউন্টে মার্জিন সুবিধা প্রদানের মতো অপরাধ করেছে। এ কারণে এই ব্রোকারেজ হাউসটিকে সতর্ক করা হয়েছে।
এদিকে নেট ক্যাপিটাল ব্যালেন্স’ রিপোর্ট সময়মত দাখিল না করায় সিনহা সিকিউরিটিজ, ফখরুল ইসলাম সিকিউরিটিজ, এএনএফ ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি, কমার্স ব্যাংক সিকিউরিটিজ অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, পিএইচপি স্টক অ্যান্ড সিকিউরিটিজ এবং বেনকো সিকিউরিটিজকে সতর্ক করা হয়েছে।
আইসিবিকে সতর্ক
আইডিএলসি ফাইন্যান্সের রাইট শেয়ার বিনিয়োগকারীদের স্বাক্ষর ব্যতীত রিনান্সিয়েশন করে আইসিবির নিজস্ব পোর্টফলিও অ্যাকাউন্টে ক্রয় করার অপরাধে সরকারি এই প্রতিষ্ঠানটিকে সতর্ক করেছে বিএসইসি।
ব্রোকারদের নিবন্ধন নবায়নে ছাড়
মহামারি করোনাভাইরাসের প্রেক্ষিতে স্টক ডিলার, স্টক ব্রোকার ও অনুমোদিত প্রতিনিধিদের নিবন্ধন সনদ নবায়নের জন্য আবেদন জমার সীমা ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) এবং চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) আবেদনের প্রেক্ষিতে এ ছাড় দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।
বিএসইসির এসব পদক্ষেপর বিষয়ে ডিএসইর এক সদস্য বলেন, শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলামের নেতৃত্বাধীন কমিশন দায়িত্ব নেয়ার পর বেশকিছু সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছে। বিশেষ করে অনিয়কারীদের বিরুদ্ধে বিএসইসির জরিমানার সিদ্ধান্তগুলো প্রশংসার দাবি রাখে। বিএসইসির এই ভূমিকা অব্যাহত থাকলে শেয়ারবাজারে আবার সুদিন ফিরে আসবে। ইতোমধ্যে বাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরতে শুরু করেছে। যার ফলে লেনদেন বাড়ছে, সূচকেও ইতিবাচক প্রভাব দেখা যাচ্ছে।
বিনিয়োগকারী মনির হোসেন বলেন, গত এক যুগে ধরে শেয়ারবাজারে কোনো ধরনের সুশাসন ছিল না। কারসাজিকারীরা এক প্রকার নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রশ্রয়ে একের পর এক অনিয়ম করে গেছে। দুই-এক সময় কারসাজি চক্রকে ছোটখাটো জরিমানা করে তাদের অনিয়ম করার ক্ষেত্রে আরও উৎসাহ দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। তবে বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নিয়ে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার আভাস দিচ্ছে। কমিশন তাদের এ অবস্থান ধরে রাখতে পারলে শেয়ারবাজারে সুদিন ফিরতে বেশি সময় লাগবে না।
বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলামের নেতৃত্বাধীন কমিশন যে পুঁজিবাজার ও বিনিয়োগকারী বান্ধব তা তারা কাজের মাধ্যমে বুঝিয়ে দিচ্ছেন। আমরা চাই অনিয়মকারী যত শক্তিশালীই হোক তার বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। কারসাজি চক্রকে আর্থিক জরিমানার পাশাপাশি আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এটা করা গেলে বাজারে সুশাসন ও আস্থা ফিরে আসবে।