মহামারি করোনাভাইরাসের ধকল কাটিয়ে বিশ্ব অর্থনীতি চাঙ্গা হওয়ার কথা থাকলেও বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। যুদ্ধের প্রভাব বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও কিছুটা পড়েছে। করোনা মহামারির সময়েও যেখানে শির উঁচু ছিল দেশের শেয়ারবাজারের, সেখানে নিয়ন্ত্রক সংস্থার বিনিয়োগবান্ধব সিদ্ধান্তেও পুঁজিবাজারে যেন স্বস্তি ফিরছে না।
২০২০ সালের ১৭ মে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদের ডিন অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম। তাঁর দায়িত্বগ্রহণের পর দেশের পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। যেখানে দৈনিক লেনদেন ১০০ কোটি টাকা ছিল সেখানে শিবলী রুবাইয়াতের দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রায় তিন হাজার কোটি টাকাও লেনদেন হয়েছে শেয়ারবাজারে।
জানা গেছে, শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম বিএসইসির দায়িত্ব গ্রহণের সময়ে প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) ১শ’ থেকে ২শ’ কোটি টাকার ঘরে ছিল লেনদেন। তবে তাঁর দায়িত্ব গ্রহণের পর করোনা মহারির মধ্যেও যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছিল শেয়ারবাজার। ২০২১ সালের ৯ আগস্ট ডিএসইতে দুই হাজার ৯৩৯ কোটি ৪৫ লাখ টাকার শেয়ার ও ইউনিট কেনাবেচা হয়েছিল। এটি পুঁজিবাজারের ইতিহাসে ডিএসইতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ লেনদেন। ২০২১ সালের ৭ অক্টোবর পর্যন্ত শেয়ারবাজারে ২ হাজার কোটি টাকা লেনদেনের চিত্র ছিল নিয়মিত। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক ৭ হাজার পয়েন্টের গন্ডি পেরিয়েছে বর্তমান কমিশনের সময়েই। এ সূচক ২০২০ সালের মার্চেও ছিল চার হাজারের ঘরে।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপের চেষ্টায় ধীরে ধীরে কমতে থাকে লেনদেন। ফজলে কবির বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর থাকাকালীন ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা নিয়ে বিএসইসির সঙ্গে মতানৈক্য সৃষ্টি হয়। ফলে অস্বস্তি শুরু হয় সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে, কমতে থাকে লেনদেন।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এই আতঙ্ককে পুঁজি করে একটি গোষ্ঠীও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন গুজব ছড়িয়ে দেয় সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে। অথচ সাম্প্রতিক সময়ে বিনিয়োগবান্ধব বেশকিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। এর মধ্যে- বন্ড মার্কেট চালু, পুনরায় ফ্লোর প্রাইস চালু, স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ড গঠন, আইপিওতে লটারি সিস্টেম বাতিল, এক্সপোজার লিমিটের সংজ্ঞা পরিবর্তন, কারসাজির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ অন্যতম।
জানা গেছে, বন্ধ হয়ে যাওয়া কোম্পানিগুলোকে পুনরায় চালুর উদ্যোগ নেয় পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা। এমারেল্ড ওয়েল, আলহাজ টেক্সটাইল, সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইল, ফ্যামিলি টেক্সটাইলের মতো কোম্পানিগুলোকে পুনরায় উৎপাদনে ফেরাতে সক্ষম হয়েছে বিএসইসি। বর্তমান কমিশন দায়িত্ব গ্রহণের পর ২৮টি কোম্পানির বোর্ড পুনর্গঠন করা হয়েছে, যার মধ্যে ২০টি কোম্পানি বর্তমানে তাদের কাজ চালু করেছে।
বর্তমান কমিশনের যুগান্তকারী ভূমিকা অদাবীকৃত লভ্যাংশ দিয়ে স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ড গঠন। বিনিয়োগকারীদের জন্য ঘোষিত যে লভ্যাংশ অলস পড়ে ছিল, সেসব অদাবিকৃত লভ্যাংশ দিয়ে ‘ক্যাপিটাল মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ড’ গঠন করেছে বিএসইসি। এরই মধ্যে এই তহবিল শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ শুরু করেছে। বাজারে যাত্রা শুরু করেছে একটি মিউচ্যুয়াল ফান্ড।
চলতি বছরের ৪ আগস্ট শেয়ারবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা (এক্সপোজার লিমিট) বাজার মূল্যের পরিবর্তে ক্রয় মূল্যে গণনা করার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে পরিবর্তন হয়ে যায় এক্সপোজার লিমিটের সংজ্ঞা।
ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা বাজার দরের পরিবর্তে ক্রয় মূলে গণনা করতে বিএসইসি চেয়ারম্যানের ভূমিকা ছিল অতুলনীয়। আব্দুর রউফ তালুকদার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব পাওয়ার পর এক্সপোজার লিমিটের সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনা হয়।
গত মাসে দেশের শেয়ারবাজারে প্রথমবারের মতো সরকারি সিকিউরিটিজ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পুঁজিবাজারে সরকারি সিকিউরিটিজ চালু হওয়ায় একদিনেই বাজার মূলধন বৃদ্ধি পায় আড়াই লাখ কোটি টাকা। এ টাকা বাজারে যোগ হওয়ায় গভীরতা বেড়েছে শেয়ারবাজারের।
লটারিব্যবস্থা তুলে দিয়ে আইপিওতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে কমিশন। আইপিও শিকারিরা নিয়মবহির্ভূতভাবে ১০০টি বা তার বেশি অ্যাকাউন্ট রাখতেন। লটারিতে শেয়ার পেয়ে লাভে বিক্রি করে দিয়ে দেশের শেয়ারবাজার থেকে টাকা বের করে নিয়ে যেতেন। এমন অবস্থায় আইপিওতে শেয়ার পেতে হলে সেকেন্ডারি মার্কেটে বিনিয়োগ থাকতে হবে এমন শর্ত জুড়ে দেয় বিএসইসি। ফলে প্রকৃত বিনিয়োগকারীরা এখন শেয়ার পাচ্ছেন।
২০২০ সালে দেশে করোনা মহামারি শুরু হলে শেয়ারবাজারে দরপতন শুরু হয়। অব্যাহত দরপতন ঠেকাতে ১৯ মার্চ চালু করা হয় ফ্লোর প্রাইস। এরপরে পর্যায়ক্রমে ৩ ধাপে বর্তমান কমিশন ফ্লোর প্রাইস তুলে নিয়েছিল। প্রথম দফায় ২০২১ সালের ৭ এপ্রিল ৬৬টি কোম্পানি থেকে ফ্লোর প্রাইসের নির্দেশনা প্রত্যাহার করে নেয় কমিশন। তবে টানা দরপতনের মুখে চলতি বছরের ২৮ জুলাই পুঁজিবাজারে ফের ফ্লোর প্রাইস চালু করে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন।
বিভিন্ন সময় শেয়ার নিয়ে কারসাজি করা ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে বিএসইসি। কারসাজি করলে সাজা পেতেই হবে এমন কঠোর বার্তা দিচ্ছে কমিশন।
বাজারে গুজব ছড়িয়ে আতঙ্ক সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দেখা গেছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ভিত্তিক গ্রুপ ‘বিডি স্টক ডিসকাশনের’ মডারেটর মো. আবু রমিমের বিরুদ্ধে শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা দায়ের করেছে বিএসইসি। শেয়ারবাজারে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরী ও বিনিয়োগকারীদের প্রতারিত করার উদ্দেশ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপপ্রচার চালানোর দায়ে এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল।
জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. রেজাউল করিম অর্থসংবাদকে বলেন, অর্থনীতি নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বিভিন্ন ধরণের গুজব ছড়ানো হচ্ছে। বৈশ্বিক মন্দার পরিস্থিতি বাংলাদেশেও পড়বে- বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এমন ধারণা আছে। যদিও আমাদের অর্থনীতি তুলনামূলক ভালোই আছে, এবং আমরা আশা করছি আরও ভালো হবে। তারল্য সংকট আছে বিষয়টি এমন নয়।
তিনি বলেন, যারা বিভিন্ন সময় সেল করেছে, তাঁরা এখন বাই মুডে নেই। তাদেরকে শেয়ার ক্রয়ে উৎসাহিত করতে কমিশন কাজ করছে। পলিসি লেভেলে কোন সাপোর্ট দেওয়া যায় কি না সেটিও চেষ্টা করছি। কোনভাবে যেন ফোর্সসেল না আসে কমিশন সেটিও দেখছে। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী যারা আছে, ব্যাংক এবং ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি, তাদের বন্ড ইস্যু করতে দিচ্ছি। আশা করি আগামীতে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বাড়বে। ব্যাংকগুলোর পারপেচ্যুয়াল বন্ড, সাববন্ড অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। তাদের সাথে মিটিং করে ক্যাপিটাল মার্কেটে বিনিয়োগে উৎসাহিত করা হবে।
বিএসইসির মুখপাত্র আরও বলেন, মিউচ্যুয়াল ফান্ড পরিচালনা করে এমন অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিগুলোকেও বর্তমান পরিস্থিতিতে পুঁজিবাজারকে সাপোর্ট দেওয়ার জন্য উৎসাহিত করছি। এছাড়াও ক্যাপিটাল মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ড (সিএমএসফ) থেকে আইসিবিকে ভালো পরিমাণের অর্থ দেওয়া হয়েছে বাজারে বিনিয়োগ করার জন্য। সিএমএসএফ থেকে আরও একটি মিউচ্যুয়াল ফান্ড করা যায় কি না সেটিও পর্যালোচনা চলছে। আমরা আশা করছি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজারের স্বার্থে পজিটিভ ভূমিকা পালন করবেন। আশা করছি বিজয়ের মাসে (ডিসেম্বরে) সূচক ও লেনদেন তথা বাজার ঊর্ধ্বমূখী থাকবে।
ডিএসই ব্রোকার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) প্রেসিডেন্ট রিচার্ড ডি’ রোজারিও মনে করেন, বিনিয়োগবান্ধব সবকিছুই বিএসইসি করেছে। তাঁর মতে, বৈশ্বিক পরিস্থিতির প্রভাবই বাংলাদেশের শেয়ারবাজারের বর্তমান অবস্থার জন্য দায়ী। তিনি অর্থসংবাদকে বলেন, বৈশ্বিক অবস্থা, অর্থনীতির কারণে মানুষ অস্থির হয়ে গেছে। এতগুলো শেয়ার ফ্লোর প্রাইসে পড়ে থাকলে লেনদেন কিভাবে হবে? সে তুলনায় লেনদেন ঠিকই আছে। বৈশ্বিক অর্থনীতি স্বাভাবিক হলে আমাদের ক্যাপিটাল মার্কেটও স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
অর্থসংবাদ/ওয়ালিদ