দেশের শেয়ারবাজারে যেন অস্বস্তি কাটছেই না। সাম্প্রতিক সময়ে লেনদেনের ধীরগতির কারণে হতাশা বেড়েই চলছে। গত সপ্তাহে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) লেনদেনে অংশ নেওয়া ৬৯ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের শেয়ারদরই অপরিবর্তিত ছিল। গত সপ্তাহের তৃতীয় কার্যদিবসে প্রধান শেয়ারাবাজারে লেনদেন নেমে আসে ২০০ কোটি টাকার ঘরে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বলছে, বাজার ভালো করার চেষ্টা করছে বিএসইসি। সংশ্লিষ্টদের মতে, করোনা মহামারির সময়েও দেশের শেয়ারবাজার খুব ভালো অবস্থানে ছিল। তবে বর্তমান শেয়ারবাজারকে কোনভাবেই ভালো বলা যায় না। শেয়ারবাজারের গভীরতা বৃদ্ধি করতে সরকারের পলিসি সাপোর্ট প্রয়োজন বলে মনে করেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।
চলতি বছরের জুলাই মাসের প্রথম কার্যদিবসে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক ‘ডিএসই এক্স’ ছিল ৬ হাজার ৩৫৯ পয়েন্টে। রোববার (১১ ডিসেম্বর) সূচকটি ১২০ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ৬ হাজার ২৩৯ পয়েন্টে। সেসময় ডিএসইতে দৈনিক গড় লেনদেন ছিল ৬০০ কোটি টাকার ঘরে। বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে ২৮ জুলাই শেয়ারবাজারে পুনরায় ফ্লোর প্রাইস চালু করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
বিএসইসির পুনরায় ফ্লোর প্রাইস জারির সিদ্ধান্তে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মনে আস্থার সৃষ্টি হয়। ফলে আগস্টের প্রথম সপ্তাহ থেকে শেয়ারবাজারে লেনদেন বৃদ্ধি পেতে থাকে। আগস্টের শেষ সপ্তাহে ডিএসইতে ডিএসইতে দৈনিক গড় লেনদেন দাঁড়ায় ১ হাজার ৯০০ কোটি টাকায়। গত ২০ সেপ্টেম্বর ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে একদিনেই লেনদেন হয় ২ হাজার ৮৩২ কোটি টাকা। তবে এরপর এক্সচেঞ্জটিতে লেনদেনের পরিমাণ কমতে থাকে।
গত ১০ নভেম্বর ডিএসইতে লেনদেন নেমে আসে ১ হাজার কোটি টাকার নিচে। এরপর আর হাজার কোটির ঘর পার হতে পারেনি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের লেনদেন। এর মধ্যে চলতি ডিসেম্বর মাসের ৬ তারিখ ডিএসইতে লেনদেন হয় মাত্র ২৭১ কোটি টাকার শেয়ার, যা ছিল গত ১৯ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। গত সপ্তাহের পাঁচ কার্যদিবসে ডিএসইতে লেনদেন হয়েছে ১ হাজার ৫৩৭ কোটি টাকা। অথচ সেপ্টেম্বরে এক দিনেই লেনদেন হয়েছিল ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা।
প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) চেয়ারম্যান মো. ইউনুসুর রহমান মনে করেন শেয়ারবাজারের বর্তমান অবস্থা স্বাভাবিক নয়। তবে তাঁর প্রত্যাশা শীঘ্রই শেয়ারবাজার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাবে।
তিনি অর্থসংবাদকে বলেন, বর্তমানে শেয়ারবাজারের ইনডেক্সও ভালো না, বাজারে ভলিউমও কম। সবমিলিয়ে এখন শেয়ারবাজারকে ভালো বলা যায় না। নিঃসন্দেহে শেয়ারবাজারের পরিস্থিতি খারাপ যাচ্ছে।
ডিএসই চেয়ারম্যান বলেন, শেয়ারবাজার অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা, বিশ্ব অর্থনীতির অবস্থা। অভ্যন্তরীন আরও অনেক বিষয় থাকে। সেক্ষেত্রে শেয়ারবাজারকে ভালো করতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা, ব্রোকারেজ হাউজ সবারই ভূমিকা থাকে। আর সবাই ভূমিকা পালনও করছে। হয়তো দেশ এবং বিশ্ব অর্থনীতির সব বিষয় নিয়েই শেয়ারবাজারে অবস্থা খারাপ যাচ্ছে।
তিনি বলেন, করোনা মহামারির সময়েও আমাদের শেয়ারবাজার অনেক ভালো ছিল। গত দুই-তিন মাস যাবত বাজার খারাপ যাচ্ছে। এটাতো অস্বীকার করা যাবে না। তবে আমরা আশা করি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা ফিরে আসবে। শেয়ারবাজারও ভালো হবে।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. রেজাউল করিম অর্থসংবাদকে বলেন, বাজার ভালো করার জন্য বিএসইসি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, যারা শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছে তাদেরকে বাইমুডে ফেরানোর চেষ্টা করছি। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদেরকেও সাপোর্ট দেওয়ার চেষ্টা করছি। ক্যাপিটাল মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ড এবং আইসিবি থেকেও বিনিয়োগ বৃদ্ধির চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরাও বিনিয়োগে আসছে। ডিসেম্বরে বিদেশি বিনিয়োগও আসতে শুরু করেছে। আশা করি আগামীতে শেয়ারবাজার ভালো হবে।
পুঁজিবাজারে ব্রোকারেজ হাউজগুলোর সংগঠন ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) রিচার্ড ডি’ রোজারিও অর্থসংবাদকে বলেন, ফ্লোর প্রাইসের কারণে বেশিরভাগ শেয়ার লেনদেন হচ্ছে না। ফলে ভলিউম অনেক কম। তবে যেসব শেয়ার লেনদেন হচ্ছে সেগুলোর ভলিউম ভালো।
তিনি বলেন, ১০ তারিখকে কেন্দ্র করে একটা আতঙ্ক ছিল, সেটি কেটে গেছে। ফলে আজ বাজারের অবস্থা কিছুটা ভালো হয়েছে।
ব্রোকারেজ হাউজগুলোর আয়ের বিষয়ে ডিবিএ প্রেসিডেন্ট বলেন, ব্রোকারেজ হাউজের আয়ের একমাত্র উৎস কমিশন। এখন ট্রেড কম হচ্ছে, ফলে ব্রোকারেজ হাউজগুলোর আয়ও অনেক কমে গেছে। এমন অনেক ব্রোকারেজ হাউজের খবর আমরা জানি, যারা কর্মীদের বেতন দিচ্ছে নিজেদের পকেট থেকে।
বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) প্রেসিডেন্ট সাইদুর রহমানের মতে শেয়ারবাজার ভালো করতে হলে সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন। তিনি অর্থসংবাদকে বলেন, আমাদের অর্থনীতির তুলনায় পুঁজিবাজার অত্যন্ত ছোট। ক্যাপিটাল মার্কেট এখনো অনেক পিছিয়ে আছে। তবে এখানে গতিশীলতা এবং গভীরতা বৃদ্ধি করার অনেক সুযোগ আছে। সেজন্য দরকার সরকারের পলিসি সাপোর্ট।
শেয়ারবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আল আমিন অর্থসংবাদকে বলেন, শেয়ারবাজারে বর্তমানে তারল্য সংকট নেই। ব্যাংক খাত নিয়ে মিডিয়াসহ বিভিন্ন জায়গায় নেতিবাচক কথাবার্তা হচ্ছে। ফলে এর প্রভাব কিছুটা শেয়ারবাজারেও পড়েছে। এছাড়াও সম্প্রতি কিছুটা রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল, সেটি কেটে গেছে।
তিনি বলেন, শেয়ারবাজার দীর্ঘমেয়াদের বিনিয়োগের জায়গা। এজন্য সাধারণ বিনিয়োগকারীরা যেন বুঝেশুনে বিনিয়োগ করে। যারা মার্জিন নির্ভর তাদেরকে মার্জিন থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করতে হবে। মার্জিন থাকলে হয়তো বিনিয়োগকারীদের সেলপ্রেসারে পড়তে হবে। এছাড়া আর কোন সমস্যা নাই। আশা করা যায় জানুয়ারি থেকে দেশের শেয়ারবাজার ভালো হবে।
বাংলাদেশ বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মিজান-উর-রশিদ চৌধুরী বলেন, ফ্লোর প্রাইসের কারণে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করছে না। তবে তাঁরা কতদিন আর শেয়ার না কিনে থাকতে পারবে। তাদেরকেও শেয়ার কিনতে হবে। মার্কেটও ভালো হবে।
অর্থসংবাদ/ওয়ালিদ