কিন্তু দিন যত যাচ্ছে, শওকত হাসানের বিরুদ্ধে বের হয়ে আসছে নানা ধরনের প্রতারণার তথ্য। নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী বানিয়ে চাঁদা দাবি করারও অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। বর্তমানে ৬০ কোটি টাকা চাঁদা দাবির মামলায় কারাগারে শওকত হাসান।
জামালপুরের ইসলামপুরে জন্ম নেওয়া শওকত হাসানের বিরুদ্ধে স্থানীয় অনেকের জমি জবরদখল করাসহ নানা অপরাধের অভিযোগ আছে। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ প্রশাসনের একাধিক দপ্তরে জমা পড়েছে বিভিন্ন অভিযোগ।
কীভাবে এত বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছেন বঙ্গলীগের প্রেসিডেন্ট, তা তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ইতোমধ্যে শওকতের সম্পত্তির বিবরণ চেয়েছে।
দল ভাঙিয়ে চাঁদাবাজির অভিযোগ
শওকতের হাত ধরে ২০১৫ সালে আত্মপ্রকাশ ঘটা ‘বাংলাদেশ জাতীয় বঙ্গলীগ’ নামের দলটির এখনো নিবন্ধন নেই। যাত্রা শুরুর অনুষ্ঠানে শওকত হাসান জানিয়েছিলেন, সরকারের সত্যিকার উন্নয়নমূলক কাজের সহায়ক ভূমিকা রাখতে দল গঠন করা হয়েছে। তারা দেশের দারিদ্র্য বিমোচনে নতুন ধারার রাজনীতি প্রবর্তন করতে চায়।
কিন্তু শুরু থেকে রাজনৈতিক কর্মসূচি তো দূরে থাক নিজেদের নেতাকর্মীদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন শওকত হাসান, এমন অভিযোগ উঠেছে। ঋণ দেওয়ার লোভ দেখিয়ে হাজার হাজার নারী-পুরুষকে নতুন এই রাজনৈতিক দলের সদস্য করা হয়। তাদের কাছ থেকে দৈনিক, সাপ্তাহিক ভিত্তিতে আদায় করা হয় চাঁদার টাকা। শ্রীমঙ্গলে তাদের দুই সদস্য পুলিশের হাতে আটকও হয়েছিল। এ নিয়ে ২০১৫ সালের অক্টোবরে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছিল।
ছিলেন সিপাহি, পরিচয় দেন মেজর!
বঙ্গলীগের প্রেসিডেন্ট দাবিদার শওকত হাসান সেনাবাহিনীতে সিপাহী পদে চাকরি করতেন। পরে মার্শাল কোর্টের বিচারে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। কিন্তু তিনি পরিচয় দিয়ে বেড়ান ‘অবসরপ্রাপ্ত মেজর’ হিসেবে।
রাজধানীর মিরপুরে আরামবাগ হাউজিংয়ের ই-ব্লকের ৭ নম্বর সড়কের ১৪-ই নম্বরে নিজের ভবনে ডেসকো থেকে বিদ্যুৎ সংযোগ নেওয়ার আবেদনেও নিজেকে মেজর (অব.) হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। তার নামে নেওয়া দুটি মিটারের বিলে নাম ও ঠিকানার স্থলে মেজর (অব.) শওকত হাসান মিয়া লেখা দেখা গেছে।
চাঁদা দাবির মামলায় গ্রেপ্তার
গুলশানের বারিধারায় ‘জামালপুর টুইন টাওয়ার’টি শওকত হাসানের। ২০১০ সাল থেকে ভবনটির কয়েকটি ফ্লোর ভাড়া নিয়ে শিক্ষাকার্যক্রম চালিয়ে আসছিল ইউআইটিএস কর্তৃপক্ষ। চুক্তি অনুযায়ী এককালীন ১০ বছরের ভাড়াসহ যাবতীয় পাওনা পরিশোধ করে ইউআইটিএস। তারা নিজস্ব ক্যাম্পাসে আসবাবপত্রসহ অন্যান্য মালামাল স্থানান্তর করতে গেলে গত বছরের ৩ নভেম্বর শওকত হাসানের নির্দেশে তার ভাড়াটিয়া বাহিনী মালামাল সরানোর কাজে নিয়োজিত কর্মীদের বাধা দেন এবং প্রাণনাশের হুমকি দেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
পরে শওকত হাসান মূল বাড়ি ভাড়া চুক্তি গোপন করে ইউআইটিএসের বোর্ড অব ট্রাস্টিজ ও পিএইচপি ফ্যামিলির চেয়ারম্যান সূফী মোহাম্মদ মিজানুর রহমানের স্বাক্ষর নকল করে একটি জাল চুক্তি সরবরাহ করে প্রায় ৬০ কোটি টাকা দাবি করেন। আবার হুমকিও দিতে থাকেন। পরে গুলশান থানায় এ ব্যাপারে জিডি করা হয়।
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে শওকত হাসান মিয়া উল্টো ইউআইটিএস বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান সূফী মোহাম্মদ মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে, আর ইউআইটিএস কর্তৃপক্ষ শওকতের বিরুদ্ধে ঢাকার সিএমএম আদালতে সিআর মামলা করে। আদালত দুটি মামলার প্রাথমিক শুনানি শেষে ঘটনা যাচাইয়ের জন্য পিবিআইকে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। পিবিআইয়ের তদন্তে ইউআইটিএস উপাচার্যকে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে চাঁদা দাবির সত্যতা পাওয়া যায়।
পরে চাঁদা দাবির এ ঘটনায় গত ২ জানুয়ারি রাজধানীর ভাটারা থানায় শওকতকে প্রধান আসামি করে মামলা করেন ইউআইটিএস উপাচার্যের ব্যক্তিগত সহকারী মো. মোস্তফা কামাল। এ মামলায় গত ৮ জানুয়ারি উচ্চ আদালত থেকে আগাম জামিন নিয়ে লাপাত্তা হয়ে যান শওকত হাসান। আদালত তাকে ছয় সপ্তাহের জামিন দিয়েছিলেন। কিন্তু জামিনের মেয়াদ শেষ হলেও নির্ধারিত দিনে নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করেননি বঙ্গলীগের প্রেসিডেন্ট।
পরে গত ২৭ জুলাই ঢাকা মহানগর হাকিম বাকী বিল্লাহর আদালতে আত্মসমর্পণ করেন শওকত। আসামি ও বাদীপক্ষের শুনানি শেষে শওকতের জামিন নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন আদালত।
জামিন আবেদনেও প্রতারণা!
গত ২৭ জুলাই আত্মসমর্পণের সময় গুরুতর অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে জামিনের আবেদন করেন শওকত হাসান। অসুস্থতার সমর্থনে কোনো ডকুমেন্ট দেখাতে না পারায় ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বাকী বিল্লাহ জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠান। পরে গত ১২ আগস্ট তিনি আইনজীবীর মাধ্যমে পশ্চিম রামপুরার ডেলটা স্পেশালাইজড হসপিটালের প্যাডে দেওয়া এক ‘চিকিৎসা সনদ’ব্যবহার করে আদালতে জামিন আবেদন করেন। ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট শারাফুজ্জামান আনসারীর আদালত সেদিনই তাকে জামিন দেন। কিন্তু যে চিকিৎসা সনদ দেখিয়ে শওকত হাসান জামিন পান, সেটি জাল বলে অভিযোগ ওঠে। সনদপত্রে তার অপারেশন হয়েছিল বলা হলেও আসলে এ ধরনের কিছুই হয়নি বলে অভিযোগ।