শেয়ারদর ইতিহাসের সর্বনিম্নে, ক্রেডিট সুইসের লেনদেন স্থগিত

শেয়ারদর ইতিহাসের সর্বনিম্নে, ক্রেডিট সুইসের লেনদেন স্থগিত
যুক্তরাষ্ট্রের দুই বড় ব্যাংকের পতনের ধাক্কা লেগেছে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক ব্যাংক ক্রেডিট সুইসের শেয়ারে। সুইজারল্যান্ডের বৃহৎ বেসরকারি ব্যাংকটির শেয়ারমূল্য এখন ইতিহাসের সর্বনিম্নে। বুধবার (১৫ মার্চ) এই ব্যাংকের শেয়ারদর পতনের মাত্রা এতটা-ই তীব্র ছিল যে, এক পর্যায়ে ব্যাংকটির শেয়ার লেনদেন স্থগিত করে দিতে হয়।

গতকাল একদিনে ব্যাংকটির শেয়ারদর কমেছে ৩০ শতাংশ। আগের দিন ২০২১ ও ২০২২ সালের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশের পর থেকেই পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীরা মুখ ঘুরিয়ে নেন ব্যাংকটি থেকে। আবার বিদ্যমান বিনিয়োগকারীরাও অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন নতুন করে মূলধনের জোগান দিতে।

অন্যদিকে ক্রেডিট সুইসের ইস্যুকৃত বন্ডের বাজারে ক্রেডিট ডিফল্ট সোয়াপের (এক ধরনের বীমা, যা কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইস্যুকৃত বন্ড বা ঋণপত্রে অঙ্গীকারকৃত অর্থ পরিশোধ করতে না পারার ঝুঁকি থেকে বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা দেয়) চাহিদা এখন রেকর্ড সর্বোচ্চ। অর্থাৎ বাজারের সাধারণ বীমাকারীরাও এখন আশঙ্কা করছেন, ক্রেডিট সুইস ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ বা দেউলিয়া হতে যাচ্ছে।

পরপর দুই বছরের আর্থিক প্রতিবেদনে ব্যালান্স শিটের নানা দুর্বলতা উঠে আসার পর থেকেই বাজারে ক্রেডিট সুইসের শেয়ারের দাম কমতে থাকে। আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরও ৮০০ কোটি ডলারের লোকসান হয়েছে ক্রেডিট সুইসের।

ক্রেডিট সুইসের মতো সুইজারল্যান্ডভিত্তিক ব্যাংকগুলোর সবচেয়ে বড় শক্তি হিসেবে দেখা হয় দেশটির ব্যাংক খাতের গোপনীয়তার আইনকে। সুইজারল্যান্ডের আইন ও সংবিধানে স্থানীয় ব্যাংকগুলোকে যেকোনো পরিস্থিতিতে আমানতকারীদের তথ্য সুরক্ষিত ও গোপন রাখার সর্বোচ্চ ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। ফলে এসব ব্যাংক থেকে আমানতকারীর গোপন তথ্য পাওয়া একেবারেই অসম্ভব। এ কারণেই এখন বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের ধনীদের কাছে বৈধ-অবৈধ পন্থায় অর্জিত অর্থ জমা রাখার জন্য সবচেয়ে আকর্ষণীয় গন্তব্য সুইজারল্যান্ড। তিন শতাধিক বেসরকারি ব্যাংক গড়ে উঠেছে শুধু বিভিন্ন দেশ থেকে আসা গোপন আমানত জমা রাখার উদ্দেশ্য নিয়ে। এসব ব্যাংকের মধ্যে বৃহৎ প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি রয়েছে ক্রেডিট সুইসের। ১৬৬ বছর ধরে ব্যাংকিং কার্যক্রম চালানো প্রতিষ্ঠানটি হয়ে উঠেছে বৈশ্বিক গোপন অর্থ আমানতের সবচেয়ে বড় গন্তব্যগুলোর একটি।

তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সুইস ব্যাংকে অর্থ ফেলে রাখা ছাড়াও বৈধ-অবৈধ পন্থায় উপার্জিত অর্থ অফশোর কোম্পানির মাধ্যমে অন্যত্র সরিয়ে নেয়া ও বিনিয়োগের আরো অনেক পন্থা উদ্ভাবন হয়েছে। উপরন্তু ক্রেডিট সুইসও সাম্প্রতিক সময়ে বড় ধরনের আস্থা ও ভাবমূর্তির সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। বেশ কিছুদিন ধরেই নানা ধরনের নেতিবাচক খবরের শিরোনাম হচ্ছিল ব্যাংকটি। বিগত বছর দুর্দশাগ্রস্ত ছিল ব্যাংকটির অবস্থা। ব্রিটিশ আর্থিক প্রতিষ্ঠান গ্রিনসিলের সঙ্গে সম্পর্কিত তহবিল সরবরাহ ব্যবস্থায় ধস নামে। এতে ১ হাজার কোটি ডলার হারায় ক্রেডিট সুইস। পাশাপাশি আরকেগোস বিনিয়োগ তহবিলে ধস নামায় ৫৫০ কোটি ডলার বাণিজ্যিক ক্ষতির সম্মুখীন হয় সুইস ব্যাংকটি। বছরের শেষ প্রান্তিকে এসে ২০০ কোটি সুইস ফ্রাংক বা ২২০ কোটি ডলার সমপরিমাণ লোকসান গোনে ব্যাংকটি। গত বছর মোট ১৫৭ কোটি ২০ লাখ ফ্রাংক লোকসান করে প্রতিষ্ঠানটি। ২০২০ সালের শেষে ২৭০ কোটি ফ্রাংক মুনাফা পেয়েছিল সুইস ক্রেডিট। এ অবস্থায় বিনিয়োগকারী ও গ্রাহকদের আস্থা ফেরাতে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হচ্ছিল প্রতিষ্ঠানটিকে। এর মধ্যেই আবার আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য প্রকাশ ও সৌদি ন্যাশনাল ব্যাংকের পিঠটান দেয়ার ঘটনায় গতকাল দিনের প্রথম ভাগে শেয়ারদরের পতন হয় ১৭ শতাংশ। দিনশেষে ৩০ শতাংশ কমে ইতিহাসে সর্বনিম্ন দরের রেকর্ড করে ব্যাংকটির শেয়ার।

এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক (এসভিবি) বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকেই বিশ্বব্যাপী ব্যাংক খাত নিয়ে বড় ধরনের উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। এ বিষয়টিই ক্রেডিট সুইস নিয়ে বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকটে আরো অনেক বাড়িয়ে তুলেছে বলে মনে করছেন পুঁজিবাজার পর্যবেক্ষকরা। অর্থনীতিবিদরাও আগেই সতর্ক করে বলেছিলেন, এসভিবির পর ক্রেডিট সুইস হতে পারে পতনের মুখে থাকা পরবর্তী প্রতিষ্ঠান।

সুইস ব্যাংকটির ৯ দশমিক ৮৮ শতাংশের মালিকানা সৌদি আরবের। বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য প্রকাশের পরই ব্যাংকটির সবচেয়ে বড় শেয়ারহোল্ডার ও ঋণদাতা সৌদি ন্যাশনাল ব্যাংক জানিয়ে দেয়, নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা অনুযায়ী তাদের পক্ষে ক্রেডিট সুইসের আর শেয়ার কেনা সম্ভব নয়। তাছাড়া ঝুঁকির মুখে থাকা ব্যাংকটিতে আর বিনিয়োগও করতে চায় না তারা। সবচেয়ে বড় ঋণদাতার কাছ থেকে আর কোনো আর্থিক সহায়তা না পাওয়ার ঘোষণা ক্রেডিট সুইসের শেয়ারদর পতনকে আরো ত্বরান্বিত করে।

মঙ্গলবার রাতেই মার্কিন উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী ও লেখক রবার্ট কিয়োস্কি ফক্স বিজনেসের কাছে ক্রেডিট সুইস নিয়ে আশঙ্কার কথা জানিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমার প্রাক্কলন বলছে, পরবর্তী যে ব্যাংকটি পতনের মুখে পড়তে যাচ্ছে সেটি হলো ক্রেডিট সুইস। এক্ষেত্রে মূল সমস্যা হলো বন্ড মার্কেট, সেখানে ধস নামছে। কারণ পুঁজিবাজারের চেয়ে বন্ডের বাজারের আকার অনেক বড়।’

প্রসঙ্গত, ২০০৮ সালে মার্কিন বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান লেহম্যান ব্রাদার্সের পতনের ব্যাপারেও সবার আগে পূর্বাভাস দিয়েছিলেন কিয়োস্কি। ১৮৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানটি ২০০৮ সালে দেউলিয়া হয়ে যায়। সে সময় লেহম্যান ছিল যুক্তরাষ্ট্রের চতুর্থ বৃহত্তম বিনিয়োগ ব্যাংক।

তবে এসভিবির সঙ্গে ক্রেডিট সুইসের পরিস্থিতি মেলাতে নারাজ ব্যাংকটির সিইও উলরিখ কোয়ের্নার। গতকাল তিনি বলেন, ‘দুটো একেবারেই আলাদা পরিস্থিতি। মূলধনি তহবিল, তারল্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাস্তবে আমরা একেবারেই ভিন্ন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। আবার মানের দিক থেকেও আমরা বেশ ভালো অবস্থায় রয়েছি। গতকালও ব্যাংকে অর্থের প্রবাহ ভালো ছিল। এসভিবির পতনের পর পরিস্থিতি বেশ শান্তও রয়েছে।’

ব্যাংকের তারল্য শক্তিশালী অবস্থায় রয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, ‘নিয়ন্ত্রণ নীতিমালার সব সূচকেই ক্রেডিট সুইস এগিয়ে রয়েছে।’

সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক ক্রেডিট সুইসের শেয়ারদর পতনের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। অন্যদিকে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো পরিস্থিতি কোনদিকে যাচ্ছে তা খতিয়ে দেখছে বলে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র রয়টার্সকে নিশ্চিত করেছে। ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংক (ইসিবি) কর্মকর্তারা এরই মধ্যে ক্রেডিট সুইসের ঋণদাতাদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেছেন। ক্রেডিট সুইসের বাজারমূল্যের পতনের পরিপ্রেক্ষিতে নড়েচড়ে বসেছেন রাজনীতিবিদরাও। এরই মধ্যে ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী এলিজাবেথ বোর্নে জানিয়েছেন, শিগগিরই সুইজারল্যান্ডের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলবেন ফ্রান্সের অর্থমন্ত্রী ব্রুনো লে মেরি।

সুইস ক্রেডিট-সংক্রান্ত আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য এমন সময় প্রকাশ্যে এল যখন যুক্তরাষ্ট্রের এসভিবি ও সিগনেচার ব্যাংক বন্ধ হয়েছে। আর এসব নিয়ে বিশ্বজুড়ে ব্যাংক খাত রীতিমতো আতঙ্কে ভুগছে। সেই আতঙ্ককে আরো তীব্র করে তুলেছে ক্রেডিট সুইস। এ বিষয়ে ওয়েডবুশ সিকিউরিটিজের ইকুইটি ট্রেডিং শাখার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিশেল জেমস বলেন, ‘অত্যন্ত দৃশ্যমান কোনো প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে নেতিবাচক তথ্য আর্থিক খাতে ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে। ক্রেডিট সুইসের ক্ষেত্রেও সেটিই ঘটতে যাচ্ছে।’

সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক ও সিগনেচার ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর আর্থিক খাতে সৃষ্ট টালমাটাল পরিস্থিতিতে এখন ধারণা করা হচ্ছে, মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ (ফেড) সুদহার নিয়ে আগ্রাসী রীতি থেকে বেরিয়ে আসবে। সেক্ষেত্রে এবার ফেড হয় সুদহার অপরিবর্তিত রাখবে অথবা ২৫ বেসিস (দশমিক ২৫ শতাংশ) পয়েন্ট বাড়াবে।

অর্থসংবাদ/এসএম

আর্কাইভ থেকে

আরও পড়ুন

ফু-ওয়াং সিরামিকের লভ্যাংশ অনুমোদন
এক বছরে ডিএসইর বাজার মূলধন বেড়েছে ২০ হাজার কোটি টাকা
ডিএসইতে মোবাইল গ্রাহক-লেনদেন দুটোই কমেছে
বছরজুড়ে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির অনুমোদন পেয়েছে ৯ কোম্পানি
পুঁজিবাজারে লেনদেন বন্ধ আজ
বছরের ব্যবধানে পুঁজিবাজারে লেনদেন বেড়েছে ৪০ শতাংশ
রবিবার পুঁজিবাজার বন্ধ থাকলেও চলবে দাপ্তরিক কার্যক্রম
লোকসানে ৮ খাতের বিনিয়োগকারীরা
সাপ্তাহিক রিটার্নে মুনাফায় ১০ খাতের বিনিয়োগকারীরা
খাতভিত্তিক লেনদেনের শীর্ষে প্রকৌশল খাত