সোমবার (২০ মার্চ) প্রকাশিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ২০২২ সালের ডিসেম্বরভিত্তিক হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূল্যস্ফীতির চাপে সাধারণ মানুষ সংসারের ব্যয় মেটাতে পারছে না। ছোট ছোট প্রতিষ্ঠান ব্যবসা করতে পারছে না। এমন অবস্থায় ব্যাংকে টাকা জমানো তো দূরের কথা, অনেকে আগের জমানো অর্থ তুলে ব্যয় মেটাচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতেও এক শ্রেণির মানুষের আয় বেড়েছে। এরা হচ্ছে বিত্তশালী বা বড় প্রতিষ্ঠান। এটাকেই দেশে বৈষম্য বাড়ার বহিঃপ্রকাশ বলছেন অর্থনীতিবিদরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্য বলছে, ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতে মোট আমানতকারীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১৩ কোটি ৬২ লাখ ৪৯ হাজার ৭৬৪টি। যেখানে জমা ছিল ১৫ লাখ ৮৮ হাজার ১০ কোটি টাকা। এর মধ্যে এক কোটি টাকার বেশি আমানত রয়েছে এমন ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা রয়েছে এক লাখ ৯ হাজার ৯৪৬টি। কোটি টাকার ওপরে এসব হিসাবে জমা আছে ৬ লাখ ৭৭ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেশের ব্যাংকগুলোতে ২০২১ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে কোটিপতি হিসাব বেড়েছে ৭ হাজার ৯৭০টি। দুই বছরে বেড়েছে ১৬ হাজার ৫৬টি এবং তিন বছরে বেড়েছে ২৬ হাজার ১০৭টি হিসাব।
২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে মোট আমানতকারীর সংখ্যা ছিল ১২ কোটি ৪৮ লাখ ৯৬ হাজার ৯৩৪টি। যেখানে জমা ছিল ১৫ লাখ ১২ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা। এর মধ্যে কোটি টাকার বেশি এক লাখ এক হাজার ৯৭৬টি হিসাবে জমা ছিল ৬ লাখ ৫৩ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকা।
তার আগের বছর ২০২০ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংকগুলোতে কোটি টাকার বেশি আমানতের হিসাবের সংখ্যা ছিল ৯৩ হাজার ৮৯০টি। কোটি টাকার ব্যাংক হিসাবগুলোতে জমা ছিল ৫ লাখ ৯৫ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা। ওই সময় মোট আমানতের স্থিতি ছিল ১৩ লাখ ৭৯ হাজার ১৫০ কোটি টাকা।
২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে মোট আমানতকারীর সংখ্যা ছিল ১০ কোটি ৬৫ লাখ ৯৫ হাজার ২১১টি। এর মধ্যে কোটি টাকার বেশি হিসাবের সংখ্যা ছিল ৮৩ হাজার ৮৩৯টি।
করোনা মহামারির পর মূল্যস্ফীতি বেড়েছে, কিন্তু মানুষের আয় বাড়েনি। এতে করে নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে হিমশিম থেকে হচ্ছে। এই সময়েও দেশের একটি শ্রেণির মানুষের আয় বেড়ে যাচ্ছে। এরা হচ্ছে বিত্তবান ও বড় বড় প্রতিষ্ঠান। তাদের আয় আগেও বেশি ছিল এখন আরও বেড়েছে
অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেশের ব্যাংকগুলোতে ২০২১ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে কোটিপতি হিসাব বেড়েছে ৭ হাজার ৯৭০টি। দুই বছরে বেড়েছে ১৬ হাজার ৫৬টি এবং তিন বছরে বেড়েছে ২৬ হাজার ১০৭টি হিসাব।
এ অবস্থায় দেশের উন্নয়ন একটি গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে, যা বৈষম্য বাড়ার বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, করোনা মহামারির পর মূল্যস্ফীতি বেড়েছে, কিন্তু মানুষের আয় বাড়েনি। এতে করে নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে হিমশিম থেকে হচ্ছে। এই সময়েও দেশের একটি শ্রেণির মানুষের আয় বেড়ে যাচ্ছে। এরা হচ্ছে বিত্তবান ও বড় বড় প্রতিষ্ঠান। তাদের আয় আগেও বেশি ছিল এখন আরও বেড়েছে। এর মানে উন্নয়ন একটি গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে। এটাই অর্থনৈতিক বৈষম্য। যে কারণে দেশের কোটি টাকার আমানতকারীর সংখ্যা বাড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ১০টি ক্যাটাগরিতে কোটি টাকার আমানতকারীদের হিসাব করেছে। ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত তথ্য অনুযায়ী, এক কোটি এক টাকা থেকে পাঁচ কোটি টাকার আমানতকারীর হিসাব সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮৭ হাজার ১৬৭টি। যাদের হিসাবে জমা টাকার পরিমাণ এক লাখ ৮০ হাজার ৬৯০ কোটি টাকা। পাঁচ কোটি থেকে ১০ কোটির মধ্যে রয়েছে ১১ হাজার ৯৪৫টি হিসাব। তাদের হিসাবে জমার পরিমাণ ৮৪ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা।
এছাড়া ১০ কোটি এক টাকা থেকে ১৫ কোটির টাকার হিসাব রয়েছে তিন হাজার ৮৪৫টি, ১৫ কোটি এক টাকা থেকে ২০ কোটির মধ্যে ১৮৩৩টি, ২০ কোটি এক টাকা থেকে ২৫ কোটির মধ্যে এক হাজার ১৪৩টি, ২৫ কোটি এক টাকা থেকে ৩০ কোটির মধ্যে হিসাব রয়েছে ৮৮৭টি, ৩০ কোটি এক টাকা থেকে ৩৫ কোটি টাকার মধ্যে ৪৭২টি এবং ৩৫ কোটি এক টাকা থেকে ৪০ কোটির মধ্যে রয়েছে ৩১৫ আমানতকারীর হিসাব। ৪০ কোটি এক টাকা থেকে ৫০ কোটি টাকার হিসাব সংখ্যা ৫৭৭টি। এছাড়া ৫০ কোটি টাকার বেশি আমানত রাখা হিসাবের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৭৬২টি। এসব হিসাবে জমার পরিমাণ দুই লাখ ২৯ হাজার ৭৯৬ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে দেশে কোটিপতি আমানতকারী ছিল ৫ জন, ১৯৭৫ সালে তা ৪৭ জনে উন্নীত হয়। ১৯৮০ সালে কোটিপতি হিসাবধারীর সংখ্যা ছিল ৯৮টি। এরপর ১৯৯০ সালে ৯৪৩টি, ১৯৯৬ সালে ২ হাজার ৫৯৪টি, ২০০১ সালে ৫ হাজার ১৬২টি, ২০০৬ সালে ৮ হাজার ৮৮৭টি এবং ২০০৮ সালে ছিল ১৯ হাজার ১৬৩টি। ২০২০ সালের ডিসেম্বর শেষে তা একলাফে বেড়ে দাঁড়ায় ৯৩ হাজার ৮৯০টিতে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে বেড়ে কোটিপতি হিসাব দাঁড়ায় এক লাখ এক হাজার ৯৭৬টিতে।