গত অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারির তুলনায় চলতি অর্থবছরের একই সময়ে রোজানির্ভর পণ্যের আমদানির এলসি খোলা গড়ে কমেছে ১৫ শতাংশ।
আমদানি কমেছে ১৩ শতাংশ। তবে দেশে উৎপাদিত পণ্যের সরবরাহ রয়েছে স্বাভাবিক। তারপরও রোজা উপলক্ষ্যে ইতোমধ্যে সব ধরনের পণ্যের দাম বিদ্যুৎ গতিতে বেড়ে গেছে। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছে নিম্ন ও মধ্য আয়ের ভোক্তারা।
সূত্র জানায়, গত বছরের মার্চ থেকে ডলার সংকট দেখা দেয়। মে মাসে তা প্রকট আকার ধারণ করে। ওই সময় থেকে বিলাসী পণ্যসহ ভোগ্যপণ্যের আমদানির এলসি খোলা কমে যায়। জুলাই থেকে এসব পণ্যের আমদানিও কমে যায়। এর মধ্যে ডলার সংকট আরও প্রকট হয়। এ সময়ে ব্যাংকগুলো ডলারের সংস্থান ছাড়া এলসি খোলা বন্ধ করে দেয়। কিন্তু ভোগ্যপণ্যের আমদানিকারকরা নিজস্ব উদ্যোগে ডলারের সংস্থান করতে না পারায় তারা এলসি খুলতে পারছিল না। এ ধারা এখনো অব্যাহত রয়েছে। যে কারণে ভোগ্যপণ্যসহ রোজানির্ভর অনেক পণ্যের এলসি খোলা কমে যায়। এলসি খোলার পর পণ্যটি দেশে আসতে কমপক্ষে এক থেকে তিন মাস সময় লাগে। ফলে নভেম্বর থেকে মধ্য ফেব্রুয়ারি পর্র্যন্ত যেসব পণ্যের এলসি খোলা হয়েছে সেগুলো এখন বাজারে আছে। এরপর যেসব পণ্যের এলসি খোলা হয়েছে সেগুলো এখনো বাজারে আসেনি। রোজা শুরুর পর সেগুলো বাজারে আসতে পারে।
সূত্র জানায়, রোজার পণ্যের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে-চিনি, দুধ, ছোলা, ডাল, ভোজ্যতেল, ফল, মসলা, পেঁয়াজ। এর মধ্যে এবার পেঁয়াজের উৎপাদন ভালো হয়েছে। যে কারণে সরবরাহও স্বাভাবিক রয়েছে। তারপরও কৃষকদের পেঁয়াজের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে আমদানি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এর প্রভাবে দাম বাড়তে শুরু করেছে। দেশে উৎপাদন ভালো হওয়ায় ও ডলার সংকটের কারণে পেঁয়াজের আমদানি কমেছে। চিনি, দুধ, ছোলা, ডাল, ভোজ্যতেল, ফল, মসলার মধ্যে বেশিরভাগই আমদানিনির্ভর। ডলার সংকটে এগুলোর আমদানিও কমেছে। অন্যান্য পণ্যের মধ্যে শসা, বেগুনসহ সবজির উৎপাদন দেশে ভালো হয়েছে। তারপরও এগুলোর দাম বেড়েছে।
গত নভেম্বর থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রোজানির্ভর পণ্যের আমদানি বাড়াতে ডলারের সরবরাহ বাড়িয়েছে। ফলে বেশ কিছু অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের এলসি খোলা বেড়েছে। এতে আমদানিও বাড়ছে। তবে বৈশ্বিক মন্দার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের সরবরাহ কম। যে কারণে আমদানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, এবার আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম, ডলারের দাম বৃদ্ধি ও ব্যবসায়ীদের মাত্রাতিরিক্ত মুনাফা করার প্রবণতায় বাড়ছে পণ্যের দাম। গত এক বছরে ডলারের দাম বেড়েছে ২৬ শতাংশ। তবে আমদানিকারকরা জানান, তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া ১০৭ টাকা করে ডলার পাচ্ছেন না। এলসি খুলতে গেলে ১২০ টাকা করে ডলার কিনতে হয়। এতে দামও বাড়ছে।
এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংক যেসব ডলার দিচ্ছে সেগুলো ১০৭ টাকার নিচে থাকে। বাণিজ্যিকভাবে আমদানি করতে গেলে ডলারের দাম কিছুটা বেশি পড়ে।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, আন্তর্জাতিক বাজারের গত জুলাইয়ের তুলনায় নভেম্বর থেকে এখন পর্র্যন্ত প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম গড়ে ২০ থেকে ৫০ শতাংশ কমেছে। কোনো কোনো পণ্যের দাম আরও কমেছে। একই সঙ্গে জ্বালানি তেলের দাম কমার কারণে জাহাজ ভাড়াও কমেছে। গত ছয় মাসের ব্যবধানে জাহাজ ভাড়া ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্র্যন্ত কমেছে। এতে পণ্যের আমদানি খরচও কমেছে। তারপরও দেশের বাজারে পণ্যের দাম কমেনি। উলটো আরও বেড়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, গত অর্থবছরের জুলাই ফেব্রুয়ারির তুলনায় চলতি অর্থবছরের একই সময়ে চিনির এলসি খোলা সাড়ে ৭ শতাংশ ও আমদানি কমেছে সাড়ে ২০ শতাংশ। দুধ ও দুগ্ধ জাতীয় পণ্যের এলসি ১৫ শতাংশ কমেছে। কিন্তু আমদানি বেড়েছে সোয়া ৩ শতাংশ। সব ধরনের ফলের এলসি ৩৮ শতাংশ ও আমদানি কমেছে সোয়া ৩৮ শতাংশ।
ছোলা ও ডালের এলসি খোলা বেড়েছে ২০ শতাংশ, আমদানি কমেছে ১২ শতাংশের বেশি। পেঁয়াজের এলসি ২১ শতাংশ ও আমদানি ২৮ শতাংশ কমেছে। মসলার এলসি ২১ শতাংশ ও আমদানি ২৮ শতাংশ কমেছে। পরিশোধিত ভোজ্যতেলের আমদানি সাড়ে ৮০ শতাংশ ও এলসি খোলা ২৬ শতাংশ বেড়েছে। অপরিশোধিত ভোজ্যতেলের এলসি কমেছে ১৫ শতাংশ ও আমদানি বেড়েছে ৫২ শতাংশ। এর আমদানি ও এলসি খোলা বাড়লেও আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেশি হওয়ার কারণে গত বছরের তুলনায় এবার পরিমাণে কম আমদানি হয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, আলোচ্য সময়ের ব্যবধানে এবার অপরিশোধিত চিনির আমদানি কম হয়েছে ২ লাখ ৮ হাজার টন। পরিশোধিত চিনির আমদানি কমেছে ২৬ হাজার টন। অপরিশোধিত ভোজ্যতেলের আমদানি কম হয়েছে ১ লাখ ৩৩ টন। ছোলা আমদানি কম হয়েছে ১৪ হাজার টন। তবে ডালের আমদানি বেড়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে এর দাম বেশি বাড়েনি। ফলে পরিমাণে আমদানিও বেড়েছে। ডলার সাশ্রয় করতে ফল আমদানিতে কড়া বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। এ কারণে আমদানি করা ফলের সরবরাহ কম। এর মধ্যে রোজায় সবচেয়ে বেশি চাহিদা থাকে খেজুরের। এবার খেজুর আমদানি কম হয়েছে।