বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অস্বাভাবিকভাবে লোকসানি প্রতিষ্ঠানের শেয়ারদর বৃদ্ধির পেছনে অবশ্যই কারসাজি চক্রের হাত রয়েছে। বিএসইসির উচিৎ বিষয়টি খতিয়ে দেখা এবং জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনা। গত কয়েকদিন ধরে দুর্বল এবং লোকসানি কোম্পানিগুলোর শেয়ার নিয়ে একটি চক্র কৃত্রিম সংকট তৈরী করে দরবৃদ্ধি করছে। এতে দীর্ঘমেয়াদে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ক্ষতির সম্ভাবনা বেশি। ডিএসইও বিনিয়োগকারীদের সম্প্রতি এ বিষয়ে সতর্ক করেছে। কোম্পানির পক্ষ থেকেও বিনিয়োগকারীদের জানানো হয়েছে কোন কারণ ছাড়াই বাড়ছে শেয়ারদর।
জানা গেছে, গত ১৮ এপ্রিল লোকসানি জুট স্পিনার্সের শেয়ারদর ছিল ২১৪ টাকা ৪০ পয়সা। ২৫ মে শেয়ারটি সর্বশেষ লেনদেন হয় ৪৪৫ টাকা ৯০ পয়সায়। মাত্র ২২ কার্যদিবসের ব্যবধানে কোম্পানিটির শেয়ারদর ২৩১ টাকা ৫০ পয়সা বেড়েছে। শতাংশ হিসেবে কোম্পানিটির শেয়ারের দর বৃদ্ধি পরিমাণ ১০৭ দশমিক ৯৭ শতাংশ।
জুট স্পিনার্সের শেয়ারদর বৃদ্ধিকে অস্বাভাবিক মনে করে প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ। গত ১৫ই মে ডিএসই জানায়, জুট স্পিনার্সের অস্বাভাবিক শেয়ারদর বৃদ্ধির কারণ জানতে চাওয়া হয়। তবে কোম্পানিটি ডিএসইকে জানিয়েছে, শেয়ারদর বৃদ্ধির পেছনে কোনো অপ্রকাশিত মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নেই। অর্থাৎ কোন কারণ ছাড়াই কোম্পানিটির শেয়ারদর বাড়ছে।
জানা গেছে, চার দশক আগে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হলেও বিনিয়োগকারীদের কোন লভ্যাংশ দেয়নি জুট স্পিনার্স। গত এক দশক ধরে কোম্পানিটি আয় করতে পারেনি। সর্বশেষ আয় করেছে ২০১২ সালে। ওই বছর কোম্পানিটি শেয়ারপ্রতি ২ টাকা ০৬ পয়সা আয় করলেও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কোন লভ্যাংশ দেয়নি। ২০১২ সালের পর থেকে জুট স্পিনার্স আর আয় করতে পারেনি। প্রতি বছর লোকসান দিয়ে যাচ্ছে কোম্পানিটি। বছরপ্রতি ৮ কোটি টাকা লোকসান দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। দীর্ঘদিন ধরে কোম্পানিটির উৎপাদনও বন্ধ রয়েছে। যার ফলে এ কোম্পানির শেয়ারহোল্ডাররা রয়েছে অনিশ্চয়তার মধ্যে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের তথ্য বলছে, ২০১৩ সালে জুট স্পিনার্সের শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে ৪৮ টাকা ১৪ পয়সা। এর পরের দুই বছরে লোকসান কমে কোম্পানিটির। ২০১৪ সালে ৪৩ টাকা ৬৪ পয়সা এবং ২০১৫ সালে ১৯ টাকা ৬৯ পয়সা করে শেয়ারপ্রতি লোকসান হয় প্রতিষ্ঠানটির। ২০১৬ সালে ফের লোকসান বাড়ে জুট স্পিনার্সের। ওই বছর কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি লোকসান হয় ৪২ টাকা ১০ পয়সা। ২০২১ সালে লোকসানের (শেয়ার প্রতি) পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৪৪ টাকা ৫৯ পয়সায়। ২০২২ সালে আরও বেশি লোকসান হয় প্রতিষ্ঠানটির। সর্বশেষ বছরে কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি লোকসান হয়েচে ৪৪ টাকা ৮২ পয়সা।
এদিকে লোকসানি জুট স্পিনার্সের পরিশোধিত মূলধনের তুলনায় ঋণের পরিমাণ ২৩ গুণ বেশি। জানা গেছে, ১৯৮৪ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া কোম্পানিটির পরিশোধিত মূলধন ১ কোটি ৭০ লাখ টাকা। অপরদিকে কোম্পানির ঋণ রয়েছে ৪০ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে স্বল্প মেয়াদি ঋণ ৩১ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। বাকি ৮ কোটি ৯১ লাখ টাকা দীর্ঘমেয়াদি ঋণ।
ঋণে জর্জরিত জুট স্পিনার্সের সম্পদের মূল্যও ঋণাত্মক। ২০২২ সালের আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি সম্পদ মূল্য (এনএভিপিএস) নেগেটিভ ৪৩৮ টাকা ৪২ পয়সা।
জুট স্পিনার্সের নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠান শফিক বসাক অ্যান্ড কোম্পানির ২০১৬ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জুট স্পিনার্সের কার্যক্রম চালিয়ে নেয়া ঝুঁকিপূর্ণ। ধারাবাহিক লোকসানের কারণে পূঞ্জীভূত লোকসান বেড়ে যাওয়ায় এ মতামত দেয় নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠান।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জুট স্পিনার্সের কোম্পানি সচিব এ.টি.এম মোস্তফা অর্থসংবাদকে বলেন, কোম্পানির শেয়ারদর বৃদ্ধির পেছনে অপ্রকাশিত কোন মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নেই। কোম্পানির যে লোকসান আছে সেটি কাটিয়ে উঠতেই ৫০ বছর লাগবে। প্রতিবছর এখন গড়ে ৮ কোটি টাকা করে লোকসান হচ্ছে, লাভ হলেও তো আর বছরে ৮ কোটি টাকা হবে না। প্রতি বছর যে ৮ কোটি টাকা লোকসান হয়, তাঁর মধ্যে ৬ কোটি টাকাই ব্যাংকের সুদ। কোম্পানির অফিস বন্ধ রাখলেও এই ৬ কোটি টাকা ব্যাংকে দিতে হবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. রেজাউল করিম অর্থসংবাদকে বলেন, বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীদের সাবধানতা অবলম্বন করা উচিৎ। যেসব কোম্পানির মৌলভিত্তি দুর্বল, সেসব কোম্পানি থেকে তো লভ্যাংশ পাওয়ার সম্ভাবনা কম। সম্প্রতি দুর্বল কোম্পানিগুলোর শেয়ারদর মুভমেন্ট হচ্ছে। কমিশন এসব বিষয়ে নজর রাখছে, কয়েকটি কোম্পানির বিষয়ে ডিএসইকে তদন্ত করতে বলা হয়েছে।
তিনি বলেন, বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীদেরই সচেতন থাকতে হবে। কারণ কমিশন কোন কারসাজির বিষয়ে তদন্ত করে শাস্তির আওতায় আনতে যে সময় লাগে, ওই সময়ের মধ্যেই অনেক বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হন।