মঙ্গলবার (৩০ মে) বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রগতির জন্য জ্ঞান (প্রজ্ঞা) থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
প্রজ্ঞা জানায়, তামাক চাষ কৃষকের স্বাস্থ্য, মাটির স্বাস্থ্য এবং সার্বিকভাবে গোটা জনস্বাস্থ্য ও পৃথিবীর স্বাস্থ্যের ক্ষতি সাধন করে। দীর্ঘমেয়াদে বৈশ্বিক প্রতিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং খাদ্য সংকট সৃষ্টিতেও ভূমিকা রাখে তামাক।
প্রজ্ঞা বলছে, বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান খাদ্য সংকটের পেছনে সংঘাত-যুদ্ধ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং কোভিড-১৯ মহামারির অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাবের পাশাপাশি তামাক চাষের একটি প্রভাব রয়েছে। বর্তমানে পৃথিবীর ১২৫টিরও বেশি দেশের প্রায় ৪ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয় এবং শীর্ষ তামাক উৎপাদনকারী দেশগুলোর বেশিরভাগই নিম্ন ও মধ্যম আয়ভুক্ত দেশ। পৃথিবীব্যাপী উৎকৃষ্ট মানের জমি ক্রমবর্ধমানহারে তামাক চাষে ব্যবহৃত হওয়ায় খাদ্য- ফসলের জমি ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। এসব জমি খাদ্য-ফসল ফলানোর কাজে ব্যবহার করা গেলে, লাখ লাখ মানুষের খাদ্যের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি খাদ্য নিরাপত্তার সংকট মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা সম্ভব। তামাক শ্রম-নির্ভর ফসল। তামাক চাষের শুরু থেকে বিক্রি পর্যন্ত প্রায় ৯ মাস সময় লাগে। ফলে এই জমিতে অন্য খাদ্য-শস্য চাষ করা কঠিন হয়ে পড়ে। তামাক চাষ যেহেতু মাটির উর্বরতা হ্রাস করে, তাই এই জমিতে অন্যান্য ফসল উৎপাদনের ক্ষমতাও কমতে থাকে এবং একই জমিতে পরপর দুই বা ততোধিক ফসল উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হয়।
প্রজ্ঞার দেওয়া তথ্য বলছে, তামাক চাষ টেকসই খাদ্য নিরপত্তার জন্য হুমকি। বাংলাদেশে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ খুবই কম, মাত্র ৩ কোটি ৭৬ লাখ ৭ হাজার একর। অথচ তামাক চাষে ব্যবহৃত মোট জমির পরিমাণের দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩তম। বিশ্বের মোট তামাকের ১ দশমিক ৩ শতাংশই উৎপাদিত হয় বাংলাদেশে। তামাক চাষের কারণে খাদ্য-ফসলের জমি ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। বাংলাদেশে রবি মৌসুমের প্রধান খাদ্য ফসলগুলোর মধ্যে বোরো, গম এবং আলু অন্যতম এবং এ মৌসুমেই তামাক চাষ হয়। এক একর জমিতে তামাক চাষ মানেই সেখানে খাদ্যশস্য উৎপাদিত না হওয়া।
তামাক চাষ পরিবেশ ও জীব বৈচিত্র্যের জন্যও হুমকি। টোব্যাকো অ্যাটলাসের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রায় ৩১ শতাংশ বন নিধনের পেছনে তামাক চাষ দায়ী। গবেষণায় দেখা গেছে, কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলার তিনটি উপজেলায় তামাকপাতা শুকানোর (কিউরিং) কাজে এক বছরেই প্রায় ৮৫ হাজার মেট্রিক টন জ্বালানি কাঠ ব্যবহৃত হয়েছে। স্থানীয় বন থেকে এসব কাঠ সংগ্রহ করায় পাহাড়গুলো বৃক্ষহীন হয়ে পড়ছে এবং সেখানকার অধিবাসীরা আকস্মিক বন্যা ও ভূমিধ্বসের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। এছাড়া, তামাক চাষে ব্যবহৃত অতিরিক্ত কীটনাশক ও সার বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে আশপাশের জলাশয়ে মিশে মৎস্য উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, তামাক চাষে ব্যবহৃত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক হালদা নদীর পানিতে মিশে যাওয়ায় কারণে বাংলাদেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন কেন্দ্রটি হুমকির মুখে পড়েছে।
সর্বশেষ ‘কৃষি পরিসংখ্যান বর্ষগ্রন্থ-২০২১’ এর তথ্যানুযায়ী— বাংলাদেশে তামাক চাষে ব্যবহৃত মোট জমির পরিমাণ ৯৯ লাখ ৬২৪ একর। ২০২১ মৌসুমে বোরো, গম এবং আলুর একরপ্রতি গড় উৎপাদন ছিল যথাক্রমে ১ হাজার ৬৮১ কেজি, ১ হাজার ৩৩৫ কেজি এবং ৮ হাজার ৫৩৮ কেজি। তামাকের পরিবর্তে এই জমিতে বোরো চাষ করা হলে ১ লাখ ৬৭ হাজার ৪২৮ মেট্রিক টন বোরো, গম এবং আলু চাষ করা হলে যথাক্রমে ১ লাখ ৩২ হাজার ৯৬৬ মেট্রিক টন গম এবং ৮ লাখ ৫০ হাজার ৩৮৭ মেট্রিক টন আলু উৎপাদন করা সম্ভব হতো। জলবায়ু পরিবর্তন, যুদ্ধ এবং নানাবিধ বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ কারণে বাংলাদেশের জন্য খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি ক্রমশ অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এমতাবস্থায় তামাকের মতো একটি জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ বিধ্বংসী ফসল উৎপাদনের বিপরীতে এই বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য হারানোর ক্ষতি কোনোভাবেই জন্য গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
প্রজ্ঞা আরও জানিয়েছে, তামাক চাষের ক্ষতি আড়াল করতে কোম্পানিগুলো তথাকথিত সামাজিক দায়বদ্ধতামূলক কর্মসূচিকে (সিএসআর) প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞা’র (প্রগতির জন্য জ্ঞান) নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের বলেন, ‘তামাক কোম্পানির সিএসআর কার্যক্রম বন্ধসহ একটি খসড়া সংশোধনী কেবিনেটের অনুমোদনের জন্য পাঠিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। খসড়াটি যত দ্রুত চূড়ান্ত হবে, তামাকমুক্ত বাংলাদেশ অর্জনের পথ ততই ত্বরান্বিত হবে।’
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ বিশ্বের নবম বৃহত্তম তামাক ব্যবহারকারী দেশ। দেশের ৩৫.৩ শতাংশ প্রাপ্ত বয়স্ক জনগোষ্ঠী তামাক ব্যবহার করেন। তামাক ব্যবহারজনিত রোগে বছরে ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। ‘গ্লোবাল বারডেন অব ডিজিজ স্টাডি, ২০১৯’ এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে মৃত্যু ও পঙ্গুত্বের প্রধান চারটি কারণের একটি হচ্ছে তামাক। তামাক ব্যবহারের অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ বছরে ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা।