অপরদিকে আমদানি করতে না পারায় বেসরকারি মালিকরাও ফার্নেস অয়েলের জন্য বিপিসির সঙ্গে যোগযোগ করছে। বিপিসি বলছে, হঠাৎ ফার্নেস অয়েলের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় তাদের মজুত ফুরিয়ে আসছে। তাদের হাতে এই মুহূর্তে ৭ জুন পর্যন্ত ২৯ হাজার ৯৮০ মেট্রিক টন ফার্নেস অয়েল মজুত আছে। প্রতিদিন গড়ে ৩ হাজার মেট্রিক টন চাহিদা ধরলে এই মজুত দিয়ে ১০ দিন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চলবে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এ অবস্থায় লোডশেডিং আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
দেশে এই মুহূর্তে ফার্নেস অয়েল থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে কমপক্ষে ৬ হাজার মেগাওয়াট।
চলমান এই সংকটের কারণে ফার্নেস অয়েলভিত্তিক প্রায় সব বিদ্যুৎকেন্দ্র সচল রয়েছে। বিপিসি বলছে, এ অবস্থায় ১০ দিন পর কমপক্ষে ৩ হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে যাবে। এতে লোডশেডিংয়ের মাত্রা আরও দ্বিগুণ বাড়বে।
বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকরা বলেছেন, পিডিবির কাছে তাদের বিদ্যুৎ বিক্রির বকেয়া বিল ১৮ হাজার কোটি টাকা। তারা চরম তারল্য সংকটে পড়েছেন। পাশাপাশি আছে ডলার সংকট। জ্বালানির জন্য তাদেরও ভরসা এখন বিপিসি। কিন্তু বিপিসি বলছে, ২৫ জুনের আগে নতুন করে আর তেল আসছে না। শিডিউল অনুযায়ী ২০ জুন ফার্নেস অয়েলবাহী জাহাজ চট্টগ্রামে আসার কথা রয়েছে।
বিপিসি জানিয়েছে, এতদিন তারা শুধু সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য পিডিবির কাছে ফার্নেস ওয়েল বিক্রি করত। বেসরকারি মালিকরা নিজেরা ফার্নেস অয়েল আমদানি করতেন। কিন্তু চলমান ডলার সংকটে আমদানি কমিয়ে দিয়েছেন। ২০ জুন জাহাজ এলেও সবকিছু ঠিকঠাক করে বিদ্যুৎকেন্দ্র পর্যন্ত পৌঁছাতে আরও ৪-৫ দিন লাগবে।
বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রোডিউসারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইপিপিএ) সাবেক সভাপতি ইমরান করিম বলেন, ফার্নেস অয়েলের মজুত কমে আসার বিষয়টি সত্য। এ মুহূর্তে তাদের চরম তারল্য সংকট রয়েছে। ফার্নেস অয়েল আমদানি করার মতো সামর্থ্য নেই অধিকাংশ মালিকের। পিডিবির কাছে বকেয়া ১৮ হাজার কোটি টাকা। পর্যাপ্ত ডলারও নেই। তিনি বলেন, সরকার যদি রেশনিং করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে, তাহলে বেসরকারিভাবে আমদানি করা ফার্নেস অয়েলের যে মজুত রয়েছে, তা দিয়ে ৩০ জুন পর্যন্ত চলবে। আর যদি চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে হয়, তাহলে এই মজুত দিয়ে সর্বোচ্চ ১০-১২ দিন চলবে। বেসরকারি উদ্যোগে নতুন জাহাজ আসার কথা রয়েছে জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে।
বিপিসির সূত্র জানিয়েছে, ফার্নেস অয়েল ছাড়াও অন্যান্য ধরনের জ্বালানি আমদানিতে এলসি খোলার সমস্যার কারণে সেগুলোর মজুতও হ্রাস পাচ্ছে। ব্যাংকগুলোয় ডলারের দাম বাজার দরের চেয়ে কম হওয়ায় তারা ঘোষিত দরে বিপিসির জন্য আমদানির এলসি খুলতে অনীহা প্রকাশ করছে। চলমান ডলার সংকটকালে সরকার নির্ধারিত হারে অন্য ব্যাংকগুলো যাতে বিপিসিকে বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে সহায়তা করে, এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তাও চাওয়া হয়েছে।
চলতি বছর সরকারি-বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ফার্নেস অয়েল সরবরাহের জন্য বিপিসিকে ৭ লাখ ৬৫ হাজার টনের চাহিদা দেয় পিডিবি। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ৫৩ হাজার ৫০০ টনের বিপরীতে ৬৯ হাজার ৮৯৭ টন এবং ফেব্রুয়ারিতে ৪৩ হাজার ৩০০ টনের বিপরীতে ৫৪ হাজার ৪০৬ মেট্রিক টন ফার্নেস অয়েল নেয় পিডিবি। দুই মাসেই নেয় ২৭ হাজার ৫০৩ টন বেশি। পরে ২৩ মার্চ পিডিবিকে নতুন করে চিঠি দিয়ে আগের দুই মাসের সরবরাহ করা চাহিদার অবশিষ্ট ৬ লাখ ৪০ হাজার টনের পাশাপাশি অতিরিক্ত আরও ২ লাখ ৮০ হাজার টনসহ ৯ লাখ ২০ হাজার টন ফার্নেস অয়েলের চাহিদা দেয় পিডিবি। এর মধ্যে এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সাত মাসে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের (আইপিপি) জন্য ২ লাখ ৮০ হাজার টন ফার্নেস অয়েল সরবরাহের চাহিদা দেওয়া হয়।
এতে আইপিপিগুলোর জন্য এপ্রিলে ৭৫ হাজার টন, মেতে ৫৫ হাজার, জুনে ৫৫ হাজার, জুলাইয়ে ৪৫ হাজার, আগস্টে ১৫ হাজার, সেপ্টেম্বরে ২০ হাজার এবং অক্টোবরে ১৫ হাজার টন ফার্নেস অয়েলের চাহিদা দেওয়া হয়। পাশাপাশি এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য ৬ লাখ ৪০ হাজার টন ফার্নেস অয়েল সরবরাহের জন্য বিপিসিকে অনুরোধ করে পিডিবি।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সঙ্গে পিডিবির চুক্তি অনুযায়ী নিজেদের আমদানির পাশাপাশি ১০-২০ শতাংশ ফার্নেস অয়েল বিপিসি থেকে নিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করেন তারা। ওই শর্ত অনুযায়ী ১০ শতাংশ ফার্নেস অয়েল বিপিসি থেকে সরবরাহ করার প্রয়োজন হয়। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রেক্ষাপট, বাংলাদেশে বিদেশি মুদ্রার সংকট এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো এলসি খুলতে অনীহায় বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো নিজ দায়িত্বে ফার্নেস অয়েল আমদানি করতে পারছে না। তাই বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জ্বালানি সংকটের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করে এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মাসওয়ারি চাহিদা অনুযায়ী ফার্নেস অয়েল সরবরাহের জন্য বিপিসিকে অনুরোধ করা হয় চিঠিতে।
অন্যদিকে আমদানি সুবিধা নিয়ে ২০১৪ সাল থেকে ফার্নেস অয়েল আমদানি শুরু করে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো। এরপর আইপিপিগুলোয় ফার্নেস অয়েল সরবরাহ বন্ধ করে দেয় বিপিসি। আইপিপিগুলোকে ফার্নেস অয়েল আমদানির সুযোগ দেওয়া হলেও শর্ত ছিল ১০-২০ শতাংশ ফার্নেস অয়েল বিপিসি থেকে নিতে হবে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম কম থাকলে চুক্তির শর্ত মোতাবেক চাহিদার ১০-২০ শতাংশ জ্বালানি বিপিসি থেকে নেওয়ার কথা থাকলেও নিত না। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম বেড়ে গেলে আইপিপিগুলো সেই শর্ত কাজে লাগিয়ে বিপিসি থেকে ফার্নেস অয়েল নেওয়া শুরু করে। বর্তমানে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় এলসি খুলতে ব্যর্থ হয়ে পিডিবির মাধ্যমে বিপিসির দ্বারস্থ হচ্ছে আইপিপিগুলো।
দেশের বিদ্যুৎ খাতের বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইপিপিএ) সভাপতি ফয়সাল করিম খান বলেন, আইপিপিগুলো অর্থসংকটে রয়েছে। পিডিবির কাছে ছয় মাসের বিল বকেয়া পড়েছে। ১৮ হাজার কোটি টাকার মতো বকেয়া হয়েছে। ব্যাংক ইনস্টলমেন্টগুলো নিয়মিত দিতে পারছে না আইপিপিগুলো। এতে জ্বালানি আমদানি ও খুচরা যন্ত্রাংশ সংগ্রহেও হিমশিম খেতে হচ্ছে। তিনি আইপিপিগুলোর জন্য দ্রুত অর্থছাড়ের দাবি জানান। তিনি বলেন, ফার্নেস অয়েল আমদানি এখন চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিকে এলসি খোলার জন্য আইপিপিগুলোর হাতে নগদ টাকা নেই। আবার এলসি খুললেও এসব এলসি নিষ্পত্তির জন্য পর্যাপ্ত ডলার পাওয়া যাচ্ছে না।’
জানা যায়, মার্চে পিডিবি চাহিদা দিলেও সে অনুযায়ী ফার্নেস অয়েল সরবরাহ দিতে ব্যর্থ হয়েছে বিপিসি। এ নিয়ে বিপিসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যেও অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে জুনের শুরুতে ফার্নেস অয়েল আমদানির কোনো চালান দেশে আসছে না। এতে ফার্নেস অয়েলের মজুতও আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। এ নিয়ে বিপিসির কেউ মুখ খুলছেন না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিপিসির একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এপ্রিলে ১ লাখ ৪০ হাজার টন এবং মেতে ১ লাখ ৩০ হাজার টন ফার্নেস অয়েলের চাহিদা ছিল পিডিবির। এর মধ্যে মেতেও ৭৬ হাজার টনের মতো সরবরাহ দিতে পেরেছে বিপিসি। চলতি জুনে ১ লাখ ২০ হাজার এবং জুলাইয়েও ১ লাখ ১০ হাজার টন ফার্নেস অয়েলের চাহিদা রয়েছে পিডিবির। কিন্তু সে অনুযায়ী ফার্নেস অয়েল দিতে পারবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে বিপিসির।