আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) শর্তে নতুন পদ্ধতিতে আরোপিত সুদহার গত ১ জুলাই থেকে কার্যকর হয়েছে। ফলে আগের চেয়ে বর্তমানে ব্যাংক ও নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানে গড়ে সুদহার বেড়েছে ১ দশমিক ৭০ শতাংশ। ব্যাংকগুলোতে গড় সুদহার হচ্ছে ১০ দশমিক ১০ শতাংশ এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ১২ দশমিক ৬০ শতাংশ। আগে ব্যাংক ঋণের গড় সুদ ছিল ৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে ১১ শতাংশ। নতুন সুদহার কার্যকর হওয়ার পর গত সপ্তাহে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৈরি এক পর্যালোচনা প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
সুদহারের সার্বিক গতিবিধি কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়মিত পর্যালোচনা করছে। এ লক্ষ্যে প্রতি মাসের ৭ তারিখের মধ্যে ওই মাসের সুদ হারের সার্বিক চিত্র কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পাঠাতে বলা হয়েছে। ব্যাংকগুলোর পাঠানো প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি প্রতিবেদন তৈরি করছে। এতে কোনো ধরনের অসঙ্গতি ধরা পড়লে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সতর্ক করা হবে। নতুন সুদহার ১ জুলাই থেকে কার্যকরের পর গত সপ্তাহেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে বাড়তি সুদহারের প্রতিবেদন পেয়েছে।
এদিকে বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকদেরও ঋণের সুদহার বাড়ানোর বিষয়টি জানানো হচ্ছে। সুদহার বৃদ্ধির কারণে আগের ঋণের কিস্তির পরিমাণে পরিবর্তন আনতে গ্রাহকদের সঙ্গে ব্যাংকগুলো আলোচনা করে নতুন কিস্তি নির্ধারণ করছে। এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সুদ আরোপের পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা হলেও সার্বিকভাবে গ্রাহকরা লাভবান হবেন না। কারণ ট্রেজারি বিলের সুদহার কমবে না, বরং বাড়বে। কারণ সরকার ব্যাংক থেকে বেশি মাত্রায় ঋণ নেবে। এছাড়া ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট রয়েছে। সব মিলে সরকারি ঋণের চাপে বেসরকারি খাতে ঋণের সুদহার আরও বাড়বে। ঋণের সুদের পাশাপাশি ব্যাংকগুলো নামে-বেনামে বিভিন্ন ধরনের ফি, কমিশন ও চার্জ আরোপ করছে। যেগুলোর কারণে প্রকৃত সুদ আরও বেশি।
তিনি আরও বলেন, ঋণের সুদ সরলভাবে হিসাব না করে এর বিপরীতে সব ধরনের ফি, কমিশন, চার্জ ইত্যাদি খরচ ধরে ঋণের বিপরীতে কত সুদ পড়ছে তা হিসাব করা দরকার। তাহলে প্রকৃত চিত্র বোঝা যাবে। এর বাইরে অঘোষিত বা অদৃশ্যমান খরচ তো আছেই। এসব মিলে ঋণের প্রকৃত সুদ ঘোষিত সুদহারের চেয়ে ৩ থেকে ৪ শতাংশ বেশি হবে।
সূত্র জানায়, আইএমএফের শর্তে ঋণের সুদহার বাজারভিত্তিক করা হয়েছে। এখন থেকে ছয় মাস মেয়াদি ট্রেজারি বিলের গড় সুদের হারের সঙ্গে সমন্বয় করে ঋণের সুদ নির্ধারিত হবে। ট্রেজারি বিলের প্রতি মাসের গড় সুদের হার কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের ওয়েব পেইজে প্রকাশ করছে। গত জুনে এ হার দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ১০ শতাংশ। এর সঙ্গে ৩ শতাংশ যোগ করে ব্যাংকগুলো বেশিরভাগ ঋণের সুদহার নির্ধারণ করেছে। এ হিসাবে জুলাইয়ে নতুন সুদহার নির্ধারণ করা হয়েছে ১০ দশমিক ১০ শতাংশ। মেয়াদি, তলবি, শিল্প ও বাণিজ্যিক ঋণের সুদ হার ১০ দশমিক ১০ শতাংশ। আগে এ খাতে সুদ ছিল ৮ থেকে ৯ শতাংশ।
কৃষি ও পল্লি ঋণের ক্ষেত্রে ট্রেজারি বিলের গড় সুদের সঙ্গে সর্বোচ্চ ২ শতাংশ যোগ করে নতুন সুদ নির্ধারিত হয়েছে। আগে এ খাতে সুদ ছিল ৮ শতাংশ। এখন তা বেড়ে হয়েছে ৯ দশমিক ১০ শতাংশ।
কুটির, ক্ষুদ্র, মাঝারি শিল্প, ক্ষুদ্রঋণ, ভোক্তা ঋণ, গাড়ি কেনার ঋণ ও ব্যক্তিগত ঋণের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো ট্রেজারি বিলের সুদের সঙ্গে সর্বোচ্চ ৪ শতাংশ যোগ করে সুদ নির্ধারণ করেছে ১১ দশমিক ১০ শতাংশ। এসব খাতে আগে ঋণের সুদ ছিল ৯ শতাংশ।
ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে ঋণের সুদের হারের বিষয়ে একটি নির্দিষ্ট গাইডলাইন দেওয়া হলেও আমানতের ব্যাপারে কিছুই বলা হয়নি। আগে থেকেই ঋণ ও আমানতের সুদের হারের মধ্যকার ব্যবধান সর্বোচ্চ ৪ শতাংশের নিচে রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। গত বছরের জুলাইয়ে ঋণ ও আমানতের সুদহারের ব্যবধান ছিল ৩ দশমিক ১২ শতাংশ। গত মে মাসে তা কমে ২ দশমিক ৯০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ঋণের সুদ হার বাড়ার কারণে আমানতের সুদহারও কিছুটা বাড়বে। আমানতের সুদহার ৭ শতাংশ থেকে বেড়ে এখন ৭ দশমিক ৩০ শতাংশ হয়েছে। ব্যাংকগুলো ইতোমধ্যে আমানতের সুদহার বাড়িয়ে বিভিন্ন সঞ্চয় প্রকল্প ঘোষণা করছে। কোনো কোনো ব্যাংক ৯ শতাংশ সুদেও আমানত নিচ্ছে।
এদিকে নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ বা বিনিয়োগে সুদের পাশাপাশি আমানতের সুদহারও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ট্রেজারি বিলের গড় সুদের হারের সঙ্গে আমানতের ক্ষেত্রে ২ শতাংশ যোগ করা যাবে। ফলে আমানতের সুদের হার হবে ৯ দশমিক ১০ শতাংশ । তবে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান এর চেয়ে বেশি সুদে আমানত নিচ্ছে। গত জুন পর্যন্ত আমানতের সর্বোচ্চ সুদ হার ছিল ৭ শতাংশ।
বিনিয়োগ বা ঋণের সুদের ক্ষেত্রে ট্রেজারি বিলের গড় সুদের হারের সঙ্গে ৫ শতাংশ যোগ করা যাবে। এ হিসাবে সুদ হবে ১২ দশমিক ১০ শতাংশ। আগে এ খাতে সর্বোচ্চ সুদ ছিল ১১ শতাংশ। কৃষি ও পল্লি ঋণের ক্ষেত্রেও একই সুদহার প্রযোজ্য।
এছাড়া কুটির, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র, মাঝারি, ব্যক্তিগত ঋণ, গাড়ি কেনার ঋণ ও ভোক্তা ঋণের বিপরীতে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বাড়তি খরচ মেটাতে আরও ৬ শতাংশ সুদ যোগ করছে। ফলে এ খাতে সুদের হার বেড়ে হয়েছে ১৩ দশমিক ১০ শতাংশ।
ক্রেডিট কার্ডের বিপরীতে গ্রাহকদের নেওয়া ঋণ ও কার্ড ব্যবহার করে কেনাকাটার সুদহার আগের মতো ২০ শতাংশে অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।
সূত্র জানায়, ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকট ও সরকারের বাড়তি ঋণ দেওয়ার কারণে ট্রেজারি বিলের সুদের হার বাড়তে পারে। গত ছয় মাস এর সুদের হার বাড়তি থাকলেও গত মে মাসের তুলনায় জুনে সামান্য কমেছে। ট্রেজারি বিলের সুদের হার গড়ে গত জানুয়ারিতে ছিল ৬ দশমিক ৬৯ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে তা বেড়ে ৭ দশমিক ০৪ শতাংশে ওঠে। মার্চে আরও সামান্য বেড়ে ৭ দশমিক ০৭ শতাংশ হয়। এপ্রিলে আরও বেড়ে ৭ দশমিক ১০ শতাংশ, মে মাসে আরও বেড়ে ৭ দশমিক ১৩ শতাংশে ওঠে। গত জুনে এ হার সামান্য কমে ৭ দশমিক ১০ শতাংশে নামে। চলতি ১০ জুলাই ছয় মাস মেয়াদি ট্রেজারি বিলের নিলামের সুদহার বেড়ে সর্বোচ্চ ৭ দশমিক ৩৫ শতাংশ উঠেছে। সরকারি বাড়তি ঋণ নিলে এর সুদের হার আরও বাড়বে। ফলে ঋণের সুদহারও বাড়বে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রতি ছয় মাস পরপর ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণের সুদহার পরিবর্তন করতে পারবে। এক্ষেত্রে পরিবর্তনের বিষয়টি গ্রাহকদের জানাতে হবে। যে মাসে ঋণ নেওয়া হবে তার আগের মাসের ট্রেজারি বিলের গড় সুদের হারের সঙ্গে সমন্বয় রেখে সুদের হার নির্ধারিত হবে।
এদিকে ব্যাংকগুলো ঋণের বিপরীতে সুদ ছাড়াও ঋণ প্রসেসিং ফি, এজেন্সি কমিশন, গ্যারান্টি ফিসহ নানা নামে বিভিন্ন ধরনের অর্থ আদায় করছে। এগুলোসহ প্রকৃত সুদ আরও বেশি হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কিছু ঋণের ক্ষেত্রে সুদ ছাড়া অন্য কোনো ফি নেওয়ার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা দিলেও সব ঋণের তা দেওয়া হয়নি। ফলে প্রায় সব ব্যাংকই নানা নামে ফি বা কমিশন নিচ্ছে।
অর্থসংবাদ/এসএম