ভোটের আগেই জয় নিশ্চয়তার সংস্কৃতি থেকে বের হতে হবে

ভোটের আগেই জয় নিশ্চয়তার সংস্কৃতি থেকে বের হতে হবে

জনগণের স্বার্থে নির্বাচন প্রয়োজন, তাই যে দলই আসুক সেখানে ভোটারের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়েছেন এক গোলটেবিল আলোচনার বক্তারা।


বক্তারা বলছেন, বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচনে যে দলগুলো অংশ নেয় তাদের সবাই ভোটের আগেই জয়ী হয়ে যেতে চায়। জয়ের নিশ্চয়তা ছাড়া কেউ নির্বাচনে অংশ নিতে চায় না। রাজনৈতিক দলগুলো এই সংস্কৃতি থেকে বের না হলে দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান কঠিন।


শনিবার (২২ জুলাই) বনানীর ঢাকা গ্যালারিতে গণমাধ্যমের সম্পাদকদের সংগঠন এডিটরস গিল্ড, বাংলাদেশ আয়োজিত ‘প্রাক নির্বাচনী পরিবেশ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বিশিষ্টজনেরা এমন মত দিয়েছেন।


বক্তারা আলোচনায় বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো খুব সহজেই ক্ষমতায় যেতে চায়। কিন্তু মানুষকে বুঝিয়ে ভোটকেন্দ্র পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে কারো কোনো আগ্রহ নেই।


তার বলছেন, ভূ-রাজনীতির কারণে বাংলাদেশের প্রতি সবার আগ্রহ রয়েছে। নির্বাচনে তাদের আশা, বিএনপি কোনো না কোনভাবে নির্বাচনে আসবে। আলোচনায় ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার সমালোচনাও করেন বক্তারা।


গোলটেবিলে বৈঠকে বক্তারা নির্বাচনে প্রার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতেরও তাগিদ দেন। তারা বলেন, অনেকেই নির্বাচন বানচাল করার ষড়যন্ত্র করছে। তাদেরকে সেই সুযোগ দেয়া যাবে না।


গোলটেবিল আলোচনায় জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদের (জানিপপ) চেয়ারম্যান অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ বলেন, ‘বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলো প্রস্তুতি নিচ্ছে। শেষ পর্যন্ত সবকিছু নির্ভর করবে সব পক্ষের অন্তর্ভুক্তিমূলক একটি নির্বাচনের ওপর।’


তিনি বলেন, সম্প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে নির্বাচনের একটি ঈঙ্গিত দিয়েছেন। সেরকম হলে আমাদের দ্রুতই প্রস্তুতি নিতে হবে। এছাড়া বিদেশি পর্যবেক্ষকরা আসবে কি না তা নিয়ে তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। হয়তো তারা আংশিকভাবে হলেও নির্বাচনের পর্যবেক্ষণ করবে। সবকিছু নির্ভর করবে বড় দলগুলোর অংশগ্রহণের ওপর নির্ভর করবে।


ফেয়ার ইলেকশন মনিটিরিং অ্যালায়েন্সের (ফেমা) প্রধান মুনিরা খান বলেন, ‘সবসময় নির্বাচনের আগে এসে বাংলাদেশের রাজনীতিকরা দেশের ও গণতন্ত্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেন। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন যেন হয় তার জন্য আমরা অনেকদিন থেকেই কাজ করছি। কেউ না কেউ তো দেশের ক্ষমতায় আসবেই, কিন্তু আমরা যদি জবাবদিহি নিশ্চিত করতে না পারি তা আমাদের গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর।’


তিনি বলেন, ‘সভা সমাবেশ করলেই তো হলো না, যারা স্টেকহোল্ডার, জনগণের, তাদেরও অংশগ্রহণ প্রয়োজন। এখন ১১ কোটি ভোটার সবার কথা তো রাজনৈতিক নেতারা শুনছে না। রাজনীতিবিদরাই নির্বাচনের আগে দেশের ক্ষতি করে, গণতন্ত্রের ক্ষতি করে। এখানে সবচেয়ে দরকার সবার সদিচ্ছা। দলগুলো খুব সহজেই ক্ষমতায় যেতে চায় কিন্ত্র মানুষকে বুঝিয়ে ভোটকেন্দ্র পর্যন্ত নিয়ে যাবার ব্যাপারে কারো কোনো আগ্রহ নেই।


সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদাত হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশের ইতিহাসে ১১টি নির্বাচন হয়েছে। এরমধ্যে আমরা কখনও দুটি নির্বাচনের পরিবেশ একই রকম থাকতে দেখিনি। আস্থার সংকট আমাদের নির্বাচনী পরিবেশকে সবসময়ই নষ্ট করেছে। এক দল অন্য দলের প্রতি, সরকারের প্রতি জনগণের, নির্বাচনী সংস্থাগুলোর প্রতি রাজনীতিকদের আস্থা নেই। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোকে গণতন্ত্রমনা হতে হবে। একে অপরের প্রতি অনাস্থার মনস্তত্ব থেকে রাজনৈতিক দলগুলোকে বের হয়ে আসতে হবে। আপনি যত ভালোই নির্বাচন দেন কিছুদিন পরই বিরোধীদল সরকার পতনের আন্দোলন শুরু করবে কিংবা সংসদ বর্জন করবে। এটাই বাংলাদেশের ইতিহাস বলে। আস্থার অভাবের সংস্কৃতি বিরাজমান।


আমার কাছে ২০০৮ সালের নির্বাচনটা সবচেয়ে ক্রেডিবল। ভোটার তালিকা নিয়ে শঙ্কা ছিলো না, অংশগ্রহণ ছিলো অনেক বেশি। তারপরও সেই নির্বাচন নিয়ে অনাস্থা ছিলো। তাহলে কোথায় আমরা আছি।


তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর এই মনস্তত্বের পরিবর্তন করতে হবে। প্রত্যেকটা দলে প্রথম সভাপতি আমৃত্যু সভাপতি থাকে। রাজনৈতিক দলগুলো ভিতরেই যদি গণতন্ত্র না থাকে তাহলে বাস্তবে গণতন্ত্র চর্চা ব্যাহত হবেই


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘আমাদের দেশে প্রাক নির্বাচনী পরিবেশ সবসময় একইরকম ছিল, তবে বিভিন্ন সময়ে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। স্বাধীনতার দীর্ঘ সময় পরে এসেও আমাদের রাজনীতিতে স্পষ্ট স্বাধীনতা বিরোধীরা রয়ে গেছে। এ কারণে নির্বাচনের পরিবেশ বলতে স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি সুবিধা পাবে আমরা এমন কিছু চাই না।’


‘মূল বিষয় এবার যেটা দাঁড়িয়েছে, এখন পুরো দেশটা দুইভাগে ভাগ হয়ে গেছে ফলে নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হবে না। এখানে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আর বিপক্ষের মধ্যে তো সমঝোতা হবে না। জিডিপি বাড়লে বা কমলে কেউ ভোট দেয় না, দেশের উন্নয়নের সাথে ভোট দেয় না কেউ।’


বিদেশি সংস্থাগুলোর সমালোচনা করে এই অধ্যাপক বলেন, ‘ইইউ বা অন্যান্য সংস্থা সুধীজন বলতে বিএনপিকে বোঝে। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে কথা বলে না, গণহত্যার বিরুদ্ধে কথা বলে না, অন্য দেশের রাজনৈতিক সহিংসতা নিয়ে কথা বলে না কিন্তু হিরো আলমের জন্য বিবৃতি দেয়। বিদেশি প্রতিনিধিদের জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে হবে। তারা কাদের সাথে আলোচনা করে? তারা সবার প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনা করছে না কেন?


বিএনপি নির্বাচনে না গেলে বিএনপির অস্তিত্ব হ্রাস পাবে মন্তব্য করে মুনতাসির মামুন। নির্বাচন হবে বলে মনে করি এবং বিএনপিও কোনো না কোনোভাবে নির্বাচনে আসবে বলেই মনে হয়। একটি দল যদি না আসে বাকি ১৫ দল আসলে সেটাও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন হবে। বিএনপি যদি না আসে বিএনপি খণ্ড-বিখন্ড হয়ে যাবে।’


সাবেক রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জমির বলেন, ‘আস্থা আর অনাস্থার সঙ্গে ভূ রাজনীতি, সংবিধান, সংলাপ এগুলোর সাথে যুক্ত হয়েছে সন্ত্রাস, সুবিধা, অসুবিধা জড়িত। ইইউকে প্রশ্ন করেছিলাম, তোমরা কি আমেরিকায় কখনো নির্বাচনী পর্যবেক্ষক পাঠিয়েছ? ছয় জানুয়ারি ক্যাপিটাল হিল আক্রমণ হলো তখন কি আপনাদের কোনো বক্তব্য ছিলো? তারা তখন চুপ করে ছিলো। প্রতিদিন তিন দিন অন্তর যুক্তরাষ্ট্রে গুলি চলে, সেখানে কেউ মানবাধিকার নিয়ে প্রশ্ন তোলে না। যদি তারা মনে করে আমাদের নির্বাচন প্রক্রিয়া যদি আমাদের নিয়ন্ত্রণ করতে চায়।’


অনুষ্ঠানের সঞ্চালক এডিটরস গিল্ডের সভাপতি ও একাত্তর টিভির প্রধান সম্পাদক মোজাম্মেল বাবু বলেন, ‘সরকারি দল হিসেবে আওয়ামী লীগের দায়িত্ব ভোট যেন সুষ্ঠু হয়, যেই প্রার্থী হোক তার নিরাপত্তা যেনো পুলিশ সঠিকভাবে তাদের নিরাপত্তা দেয়। কারণ নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য ছক কেটে ষড়যন্ত্র হচ্ছে ফলে সতর্ক থাকতেই হবে। বড় দলগুলোকে জয়ী হতেই হবে এমন মনস্তত্ব থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। জনগণের স্বার্থে সুষ্ঠু নির্বাচন আমরা সবাই চাই।’


তিনি আরও বলেন, ‘কোনো দল যখন মনে করে বর্জনের মাধ্যমেই তার অর্জন বেশি, তাহলে কী করে তাদেরকে নির্বাচনে আনবে? বর্জনের অধিকার যদি থাকে আর বর্জনে যদি তাদের অর্জন থাকে কী করে তাদেরকে আনবেন?


গোলটেবিল বৈঠকে আরও বক্তব্য রাখেন আজকের পত্রিকার সম্পাদক ও সাবেক প্রধান তথ্য কমিশনার অধ্যাপক গোলাম রহমান, বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া কবীর এবং পুলিশের ডিআইজি নজরুল ইসলাম।


অর্থসংবাদ/এসএম

আর্কাইভ থেকে

আরও পড়ুন

নির্বাচনী প্রচারে টেলিগ্রাম চ্যানেল খুললো আ. লীগ
নির্বাচন থেকে সরে গেলেন জাপার তিন প্রার্থী
নির্বাচনে ভোটারদের উপস্থিতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ: কাদের
মানুষের ভাগ্য নিয়ে কেউ ছিনিমিনি খেলতে পারবে না: প্রধানমন্ত্রী
আ.লীগের আমলে বেড়েছে মাথাপিছু আয়
পল্টনের খাদে পড়ে গেছে বিএনপির এক দফা: কাদের
বিএনপির রাজনীতি করার অধিকার বাংলাদেশে নেই: শেখ হাসিনা
ঢাকায় নির্বাচনী জনসভার অনুমতি পেল আ.লীগ
বছরে ২০ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে আ.লীগ: কাদের
বিকেলে ৬ জেলার জনসভায় ভার্চুয়ালি বক্তব্য দেবেন শেখ হাসিনা