জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত বদ্বীপ এবং উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে কার্যকর কৃষি-খাদ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্ব জোরদারের আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সোমবার (২৪ জুলাই) স্থানীয় সময় বিকেলে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সদর দপ্তরে ‘ফুড সিস্টেম অ্যান্ড ক্লাইমেট অ্যাকশন’ শীর্ষক প্লেনারি সেশনে তিনি এ আহ্বান জানান।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরপরই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘সবুজ বিপ্লবের’ ডাক দিয়েছিলেন। এখন সময় এসেছে ক্লাইমেট-স্মার্ট ‘কৃষি-খাদ্য বিপ্লবের’। এ সেক্টরের রূপান্তরের আমাদের প্রকৃতিবান্ধব সমাধান এবং উন্নত প্রযুক্তি প্রয়োগ করা প্রয়োজন।
তিনি বলেন, জলবায়ু সংকটের কারণে আমাদের একটি টেকসই এবং রূপান্তরিত খাদ্য ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করতে হবে। আর বিলম্ব না করে আমাদের অবশ্যই চিহ্নিত করতে হবে আমাদের এখন কী করা দরকার। খাদ্য নিরাপত্তা এখন জলবায়ু ন্যায়বিচারের সঙ্গে সম্পর্কিত।
যথাযথ কৃষি কাজ ও কম গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ করে পশুপালন এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য সবার সাশ্রয়ী প্রযুক্তিতে প্রবেশাধিকারের ওপর গুরুত্বারোপ করেন শেখ হাসিনা।
আধুনিক কৃষি-খাদ্য সরবরাহ চেইন বৈশ্বিক গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণে সবচেয়ে বেশি দায়ী হিসেবে আর্বিভূত হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের উচিত খাদ্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ, ব্যবহার এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বিনিয়োগ করা।
এক্ষেত্রে দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং আন্তর্জাতিক জনমতের ওপর গুরুত্বারোপ করেন শেখ হাসিনা।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন অংশে আমরা তাপমাত্রা বৃদ্ধি, দীর্ঘায়িত খরা, ব্যাপক বন্যা, পরিবর্তনশীল বৃষ্টিপাত প্রত্যক্ষ করছি। বাংলাদেশে, উপকূলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে, লবণাক্ততা বাড়ছে এবং ধান উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। আমরা দেখছি, প্রতি বছর নদী ভাঙন, নগরায়ন, শিল্পায়নসহ বিভিন্ন কারণে আবাদযোগ্য জমি হ্রাস পাচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষি ও খাদ্যের টেকসই ব্যবস্থাপনার পাঁচটি প্রস্তাব পেশ করেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রথম প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী জলবায়ু-অভিযোজিত কৃষি-খাদ্য ব্যবস্থার প্রতি যথাযথ মনোযোগের সঙ্গে উন্নত দেশগুলোর জলবায়ু অর্থায়নে খাদ্য ব্যবস্থার রূপান্তরকে অগ্রাধিকার দেওয়ার আহ্বান জানান।
দ্বিতীয় প্রস্তাবে তিনি বলেন, জাতিসংঘের খাদ্য ব্যবস্থা সমন্বয় কেন্দ্রকে গবেষণা ও উদ্ভাবনে আন্তঃসহযোগিতার মাধ্যমে জ্ঞান-ব্যবস্থাপনা বাড়ানো প্রয়োজন।
তৃতীয় প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে খাদ্য ও সারের চাহিদা পূরণে বেসরকারি খাতকে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত করার পরামর্শ দেন।
চতুর্থ প্রস্তাবে শেখ হাসিনা বদ্বীপ এবং উপকূলের মতো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলগুলোতে কার্যকর কৃষি-খাদ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্ব জোরদারের আহ্বান জানান।
পঞ্চম প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী জলবায়ু-স্থিতিস্থাপক খাদ্য ব্যবস্থার জন্য জোটকে সক্রিয় করার আহ্বান জানান। ২০২১ সালে জাতিসংঘের খাদ্য ব্যবস্থা শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশ এ বিষয়ে যৌথ-নেতৃত্ব দিতে সম্মত হয়েছিল।
সম্প্রতি বাংলাদেশের ‘গ্লোবাল মিথেন অঙ্গীকারে’ যোগদানের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আশা করছি এই উদ্যোগের প্রধান পৃষ্ঠপোষকরা তাদের প্রতিশ্রুত আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসবেন।
শেখ হাসিনা বলেন, তার সরকার জি-২০ দ্বারা আন্তর্জাতিক বায়ো-ফুয়েল অ্যালায়েন্সের প্রস্তাব অনুসরণ করে উন্নয়ন করছে।
তিনি বলেন, আমরা সৌর বিদ্যুৎ ব্যবহার করে সেচকে উৎসাহিত করছি, এমনকি ক্ষুদ্র কৃষকদেরও।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার সরকার ভাসমান কৃষি, ছাদ কৃষি, রান্নাঘর বাগান, হাইড্রোপনিক এবং অ্যারো-পনিক কৃষির সম্প্রসারণে প্রণোদনা ও সহায়তা প্রদান করছে।
ভাসমান কৃষির উদাহরণ হিসেবে তিনি বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী ভাসমান সবজি উৎপাদন পদ্ধতির কথা উল্লেখ করেন।
কৃষকদের প্রযুক্তি সহায়তার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কৃষকদের সহায়তার জন্য বাংলাদেশ ডিজিটাল প্রযুক্তি সর্বোচ্চ ব্যবহার করছে।
শেখ হাসিনা জানান, তার সরকার সারা দেশে ৫০০টি কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্র স্থাপন করেছে।
তিনি আরও জানান, তার সরকার গত ১৪ বছরে বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে প্রায় ৬৪২টি নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও শুরু করেছে। এগুলো জ্বালানি, পানি, সার, বীজ এবং কীটনাশকের কার্যকারিতা বাড়াতে সহযোগিতা করেছে।
বাংলাদেশ তার অভিজ্ঞতা সাব-সাহারান আফ্রিকাসহ অন্যদের সঙ্গে বিনিময়ের জন্য প্রস্তুত বলে জানান তিনি।
এই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গোপসাগরের গভীরে টেকসই মৎস্য সম্পদ আহরণে বিদেশি বিনিয়োগ আহ্বান করেন।
এ প্লেনারি সেশনে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন মৌরিতানিয়া প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ ওউলদ গাজোয়ানি, তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট কায়েস সাইয়েদ, সামাও এর প্রধানমন্ত্রী ফিয়ামি নাওমি মাতাফা, ইতালির উপ-প্রধানমন্ত্রী অ্যান্তেনিও তাজানি, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) মহাপরিচালক কিউ দোঙ্গিউ।
এর আগে প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সদর দপ্তরে জাতিসংঘের খাদ্য ব্যবস্থাপনা সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দেন।
২৪ থেকে ২৬ জুলাই রোমে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা আয়োজিত জাতিসংঘ খাদ্য ব্যবস্থাপনা সম্মেলনে ২০টির বেশি রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানসহ ১৬০টির বেশি দেশ থেকে প্রায় ২ হাজারের অধিক প্রতিনিধি ও সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ অংশগ্রহণ করছেন।
জাতিসংঘ মহাসচিবের আমন্ত্রণে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) আয়োজিত ফুড সিস্টেম সামিটে যোগ দিতে রোববার (২৩ জুলাই) স্থানীয় সময় বিকেলে ইতালির রোম আসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সফর শেষে আগামী বুধবার (২৬ জুলাই) দেশে ফিরবেন তিনি।
অর্থসংবাদ/এসএম