ব্রিকস কী? এতে আগ্রহ বাড়ছে কেন

ব্রিকস কী? এতে আগ্রহ বাড়ছে কেন
ব্রিকস হলো পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রের (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন এবং দক্ষিণ আফ্রিকা) আদ্যক্ষরের সমন্বয়ে নামকরণকৃত উদীয়মান জাতীয় অর্থনীতির একটি সংঘ। ব্রিকস মূলত ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা অর্ন্তভূক্ত হবার পূর্বে 'ব্রিক' নামে পরিচিত ছিল। ব্রিকসে অন্তর্ভুক্ত সকল রাষ্ট্র উন্নয়নশীল অথবা সদ্য শিল্পোন্নত, কিন্তু তাদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ঘটনাবলীর উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব।

দক্ষিণ আফ্রিকার ব্রিকস রাষ্ট্রদূত অনিল সুকলল বলেন, ২২টি দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে পূর্ণ সদস্য হওয়ার জন্য ব্রিকস দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। এছাড়া একই সংখ্যক দেশ অনানুষ্ঠানিকভাবে ব্রিকস সদস্য হওয়ার বিষয়ে প্রস্তাব দিয়েছে।

আসন্ন ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলন- ২০২৩ এর লোগোতে একটি সূর্য দৃশ্যমান। সূর্যটি পাঁচটি রঙে আলো ছড়ায়: সবুজ, নীল, কমলা, লাল ও হলুদ। যা গ্রুপের বর্তমান পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধিত্ব করে।

এই বছরের শীর্ষ সম্মেলন ২২ থেকে ২৪ অগাস্ট দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এবারের থিম 'পার্টনারশিপ ফর মিউচুয়ালি অ্যাসিলেরেটেড গ্রোথ, সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট এন্ড ইনক্লুসিভ মাল্টিল্যাটারিজম।' ব্রিকস কর্মকর্তারা বলেছেন, এই চেতনার ফলে গ্লোবাল সাউথের প্রায় ৪০টি দেশ গ্রুপে যোগদানে আগ্রহী হয়েছে।

ব্রিকস কী?


ব্রিকস হলো ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন এবং দক্ষিণ আফ্রিকার একটি অর্থনৈতিক জোট। ২০০৬ সালের জুনে, চারটি দেশ নিয়ে (দক্ষিণ আফ্রিকা ছাড়া) ব্রিক গঠিত হয়। দক্ষিণ আফ্রিকা ২০১০ সালে ব্রিক এ যুক্ত হওয়ায় এর নতুন নাম হয় ব্রিকস। ব্রিকস’র সদর দপ্তর চীনের সাংহাই প্রদেশে অবস্থিত। এটি গঠনের সময় অনেকেই বলেছেন যে, অর্থনৈতিক জোটটি ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্ব অর্থনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করবে।

ব্রিকসের পাঁচটি রাষ্ট্রই জি-২০ এর সদস্য। ২০১০ সাল থেকে ব্রিকস রাষ্ট্রসমূহ প্রতিবছর আনুষ্ঠানিক সম্মেলনে মিলিত হয়। বর্তমানে রাশিয়া ব্রিকসের প্রধান হিসেবে কাজ করছে।

ব্রিকসে কেন আগ্রহ বাড়ছে


দক্ষিণ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক কার্লোস মারিয়া কোরেয়া সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে সিনহুয়াকে বলেছেন, আসন্ন শীর্ষ সম্মেলনে নেতারা ব্রিকস গ্রুপের সম্প্রসারণ, অন্তর্ভুক্তির মানদণ্ড এবং নির্দেশনাসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করবেন বলে আশা করা হচ্ছে।

দক্ষিণ আফ্রিকার ব্রিকস রাষ্ট্রদূত অনিল সুকলল বলেন, '২২টি দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে পূর্ণ সদস্য হওয়ার জন্য ব্রিকস দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। এছাড়া একই সংখ্যক দেশ অনানুষ্ঠানিকভাবে ব্রিকস সদস্য হওয়ার বিষয়ে প্রস্তাব দিয়েছে।'

ব্রিকসে আগ্রহ দেখানো সর্বশেষ দেশ


আরবি সম্প্রচারকারী এননাহার টিভি ২২ জুলাই আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট আবদেলমাদজিদ টেবুউনকে উদ্ধৃত করে বলেছে, 'আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিকস গ্রুপে যোগদানের জন্য আবেদন করেছি এবং আমরা ব্যাংকে (নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক) শেয়ারহোল্ডার সদস্য হওয়ার জন্য একটি চিঠি পাঠিয়েছি।'

জাপানি দৈনিক মাইনিচি শিম্বুনের জানায়, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, নাইজেরিয়া এবং অন্যান্য তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোও আবেদন করেছে। একবার অনুমোদিত হলে, ব্রিকস সদস্যরা বিশ্বের তেল ও গ্যাস সম্পদের অর্ধেকেরও বেশি নিয়ন্ত্রণ করবে।

উইটওয়াটারসরান্ড ইউনিভার্সিটির সিনিয়র লেকচারার কেনেথ ক্রিমার সাম্প্রতিক এক সাক্ষাত্কারে সিনহুয়াকে বলেন, 'গ্লোবাল সাউথের অনেক দেশ আরও ন্যায্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বিশ্ব ব্যবস্থা নির্মাণে কাজ করার জন্য একত্র হওয়ার চেষ্টা করেছে। ব্রিকস অনেক দেশকে এই দৃষ্টিভঙ্গিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য আবার এক হতে অনুপ্রাণিত করে।'

ব্রিকসের প্রতি আকর্ষণ কেন


এই বছরের জুনে ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ একবার দক্ষিণ আফ্রিকার আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও সহযোগিতা মন্ত্রী নালেদি পান্ডোরের সঙ্গে বৈঠকের পর আসন্ন শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন।

ব্রিকসের আকর্ষণ (বিশেষত্ব) এখানেই। ব্রিকস ব্লক আন্তর্জাতিক বিষয়ে একটি ইতিবাচক, স্থিতিশীল ও গঠনমূলক শক্তিতে পরিণত হয়েছে।

উদাহরণস্বরূপ, জার্মানির রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সম্প্রচারকারী ডয়চে ভেলে বলেছে, বেশ কয়েকটি উদীয়মান অর্থনীতি আইএমএফ-এর কঠোর অর্থনৈতিক নীতির কারণে আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত।

ডয়চে ভেলে বলেছে, নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এবং ব্রিকস কন্টিনজেন্ট রিজার্ভ অ্যারেঞ্জমেন্ট অর্থপ্রদানের সমস্যায় অর্থনীতিকে সহায়তা করতে পারে।

ব্রিকস নিয়ে গবেষণা করা প্রিটোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক ড্যানিয়েল ব্র্যাডলো বলেছেন, 'নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক হলো সবচেয়ে বড় অর্জন। এটি দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য বৃদ্ধির পথ দেখাচ্ছে এবং আন্তর্জাতিক মনোযোগও অর্জন করেছে।'

কিউবার প্রেসিডেন্ট মিগুয়েল দিয়াজ-ক্যানেল বলেছেন, সর্বোপরি ব্রিকস বহুমুখীতা ও বহুপাক্ষিকতাকে রক্ষা করে। এটি করার মাধ্যমে, 'ব্রিকস দেশগুলো স্নায়ু যুদ্ধের ধারণাকে মোকাবিলা করছে এবং আরও ন্যায্য ও ন্যায়সঙ্গত আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার সম্ভাবনা উন্মুক্ত করছে; যা বিশ্বকে উপকৃত করবে।'

কেনিয়ার আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পণ্ডিত ক্যাভিন্স আধেরে বলেছেন, 'ক্রমবর্ধমান মেরুকৃত বিশ্বে ব্রিকস দেশগুলোর জন্য একটি আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা তৈরি করার জন্য একটি কার্যকর উপায় তৈরি করছে।'

স্প্যানিশ ওয়েবসাইট রেবেলিয়ন জানিয়েছে, বহু দেশ কয়েক দশক ধরে বিশ্ব অর্থনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যে ক্লান্ত। ওয়াশিংটনের নির্দেশনা মেনে চলতে ব্যর্থতার ফলে নিষেধাজ্ঞা ও আর্থিক ব্ল্যাকমেলের শিকার হতে হয় তাদের।

ব্রিকসে বিপুল সম্ভাবনা


সম্ভাবনাময় সদস্যদের গ্রুপে অন্তর্ভুক্তি করার মাধ্যমে আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্য আরও চাঙ্গা হয়ে উঠবে এবং আরও বিনিয়োগকারীদের নজর কাড়বে। ব্রিকসের একটি মুদ্রা ইস্যু করারও সম্ভাবনা রয়েছে।

আমেরিকান সংবাদ প্রকাশনা 'ফরেন পলিসি' ব্রিকসের সম্ভাব্য মুদ্রা সম্পর্কে বলেছেন, 'এর সদস্যরা সম্ভবত বিদ্যমান যে কোনো আর্থিক ইউনিয়নের তুলনায় বিস্তৃত পরিসরে পণ্য উৎপাদন করতে সক্ষম হবে।'

তারা তাদের প্রতিবেদনে জানায়,'যেহেতু ব্রিকস গোষ্ঠীর প্রতিটি সদস্যই তাদের নিজস্ব অঞ্চলে একটি অর্থনৈতিক হেভিওয়েট, বিশ্বের দেশগুলো সম্ভবত তাদের প্রচলন করা মুদ্রায় ব্যবসা করতে ইচ্ছুক হবে।'

যেহেতু বাংলাদেশ, মিশর, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও উরুগুয়ে ব্রিকস নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের নতুন সদস্য হিসেবে যুক্ত হয়েছে। এই চারটি দেশ তিনটি মহাদেশে অবস্থিত হওয়ায় সেখানে আরও ন্যায্য ও আরও অবারিত আন্তর্জাতিক বাণিজ্য হতে বাধ্য।

ওয়াশিংটন পোস্ট সাম্প্রতিক একটি নিবন্ধে বলেছে, 'নতুন প্রবেশকারীরা ব্রিকসের অংশ হওয়ার ফলে তাদের কূটনৈতিক প্রভাব বিস্তার করতে পারে এবং লাভজনক বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সুযোগ লাভ করতে পারে।'

তাস নিউজ এজেন্সির সঙ্গে এক সাক্ষাত্কারে জেনেভায় জাতিসংঘে দক্ষিণ আফ্রিকার স্থায়ী প্রতিনিধি নোজিফো ম্যাক্সাকাতো-ডিসেকো বলেছেন, যোগদানের আগ্রহ প্রকাশকারী নতুন সদস্যদের গ্রহণ করতে পেরে ব্রিকস খুশি।

আফ্রিকা-চীন সহযোগিতা বিশেষজ্ঞ জেরাল্ড এমবান্ডা সিনহুয়াকে বলেছেন, 'ব্রিকস বহুপাক্ষিকতাকে সমুন্নত রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এটি বারবার বৈশ্বিক শাসন ব্যবস্থার সংস্কার এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর সঙ্গে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ন্যায্য আচরণ করার পরামর্শ দিয়েছে।'

এমবান্ডা বলেন, 'এই কারণেই আমি বিশ্বাস করি, ব্রিকস নিঃসন্দেহে বর্ধিত বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সুযোগের সঙ্গে দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জনের একটি উপায়।'

অর্থসংবাদ/এমআই

আর্কাইভ থেকে

আরও পড়ুন

২১ ডিসেম্বরের রাত কেন দীর্ঘ!
হেলিপ্যাডে ‘এইচ’ লেখা থাকে কেন?
আইনস্টাইনের পাণ্ডুলিপি ১৪ কোটি টাকায় বিক্রি
চুলের স্টাইলের কারণে স্কুল থেকে দুইবার বরখাস্ত
বিষাক্ত তেলাপিয়া খাওয়ায় হারালেন হাত-পা
কোরিয়ান 'মুন জার' কেন লাখ লাখ ডলারে বিক্রি হয়?
ব্যাংকের লকার খুলতে ব্যর্থ চোর, প্রশংসা জানিয়ে চিরকুট
ব্রিকস কী? এতে আগ্রহ বাড়ছে কেন
বিশ্বের সবচেয়ে সুখী মানুষ তিনি
উরুগুয়ের উপকূলে ভেসে এলো দুই হাজার মৃত পেঙ্গুইন