শনিবার (২৬ সেপ্টেম্বর) ‘ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং অ্যাক্ট- ২০১৫: ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের প্রভাব’ শীর্ষক ওয়েবিনারে এমন তথ্য জানানো হয়। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) ওয়েবিনারের আয়োজন করে।
ওয়েবিনারে বাংলাদেশের মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ মোসলেম চৌধুরী প্রধান অতিথি এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক আফতাব-উল ইসলাম অতিথি হিসেবে যোগ দেন।
স্বাগত বক্তব্যে ডিসিসিআই সভাপতি শামস মাহমুদ বলেন, মানসম্মত অডিট রিপোর্ট প্রস্তুতে ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিলের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যেটি দেশের ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ চিহ্নিতকরণে বিশেষ অবদান রাখে।
তিনি বলেন, পুঁজিবাজারে এখনও কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন হয়নি। এছাড়া দেশের জিডিপিতে পুঁজিবাজারের অবদান সারা পৃথিবীর অন্যান্য দেশসমূহের মধ্যে সবচেয়ে কম। এ অবস্থা উন্নয়নে লিস্টেট ও নন-লিস্টেট কোম্পানিসমূহের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্ট অন্যতম নিয়ামক হিসেবে কাজ করতে পারে।
ঢাকা চেম্বারের সভাপতি বলেন, বিশেষ করে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য বহুজাতিক কোম্পানিসমূহকে ‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকাউন্টিং স্ট্যান্ডার্ডস বোর্ড’-এর আওতায় আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করতে হয় এবং এক্ষেত্রে ফিন্যান্সিয়াল রিপোটিং খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি আরও বলেন, দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের অর্থায়নপ্রাপ্তি নিশ্চিতকরণের জন্য ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং-এর গাইডলাইন আরও সহজীকরণ এবং ব্যবহারবান্ধব করা প্রয়োজন।
মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ মোসলেম চৌধুরী বলেন, আমাদের ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং আইন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের আর্থিক বিষয়াদির পাশাপাশি জনস্বার্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোও বিবেচনা করে থাকে। তিনি বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ সিকিউরিটজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন এবং অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে এ কাউন্সিলের কার্যক্রম আরও সম্প্রসারণ ও দৃশ্যমান করার ওপর জোর দেন। বলেন, ‘ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ড (আইআরএফএস) অনুসরণের ক্ষেত্রে আমাদের অবশ্যই নিজেদের সক্ষমতাকে গুরুত্ব দিতে হবে এবং আমাদের এসএমই খাত এখনই আইআরএফএস-এর গাইড লাইন অনুসরণের জন্য প্রস্তুত হতে পারেনি। তাই বিষয়টি নিয়ে সকলেরই যত্নবান হতে হবে।
তিনি ফিন্যান্সিয়াল কাউন্সিল এবং এ খাতের প্রফেশনালদের মধ্যে সমন্বয় আরও বাড়নোর তাগিদ দেন। বলেন, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কারণে আগামী ১০ বছরের মধ্যে আইওটি এবং মেশিন লার্নিং ব্যবস্থা আরও সহজলভ্য হবে। আমাদের প্রথাগত অডিট রিপোটিং ব্যবস্থাকে যুগোপোযোগী করার জন্য আইসিএবি ও আইসিএমএবি-এর প্রতিষ্ঠানগুলোকে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পানা গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানসমূহের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও গভর্নেন্স বাড়ানোর আহ্বান জানান তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক আফতাব-উল ইসলাম বলেন, ক্যামেল রেটিং-এর মতো অডিট কোম্পানিসমূহের জন্য এফআরসি কর্তৃক রেটিং ব্যবস্থা প্রবর্তন করা যেতে পারে, যার মাধ্যমে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা, অবস্থান ও সক্ষমতা সম্পর্কে আমরা ধারণা পেতে পারি। এছাড়া তিনি অডিট রিপোটিংয়ে বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
ওয়েবিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিলের ‘ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্ট মনিটরিং ডিভিশন’-এর নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ মহিউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ব্যবসায়িক কার্যক্রমের তিনটি বিষয় যেমন- আর্থিক তথ্যবিবরণী, অডিট প্রসেস এবং স্বচ্ছতা নিরূপণ ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং অ্যাক্ট-এর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মানসম্মত ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্ট একটি ব্যাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য করে তোলার পাশাপাশি উদ্যোক্তাদের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি এবং দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে বেশ কার্যকর ভূমিকা পালন করে। তিনি অডিট রিপোর্ট প্রস্তুতকরণে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানকে পর্যাপ্ত সময় দেয়া প্রয়োজন বলে মত দেন।
নির্ধারিত আলোচনায় বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিলের স্ট্যান্ডার্ড সেটিং ডিভিশন-এর নির্বাহী পরিচালক এম আনোয়ারুল করিম, যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. জাভেদ সিদ্দিকী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অ্যাডভোকেট ব্যারিস্টার এ এম মাসুম, দি ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএবি)-এর সভাপতি মোহাম্মদ ফারুক এবং দি ইনস্টিটিউট অব কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএমএবি)-এর সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন আকন যোগ দেন।
বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিলের স্ট্যান্ডার্ড সেটিং ডিভিশন-এর নির্বাহী পরিচালক এম আনোয়ারুল করিম বলেন, ফিন্যান্সিয়াল কাউন্সিলের পক্ষ হতে অডিট রিপোর্ট-এর স্ট্যান্ডার্ড নিশ্চিতকরণের জন্য বিভিন্ন ধাপে এ পদ্ধতি সহজীকরণ করা হয়েছে এবং এ বিষয়ে জনসচেতনতা বাড়ানোর জন্য কর্মশালা আয়োজনসহ বেশকিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
ব্যারিস্টার এ এম মাসুম বলেন, কাউন্সিলের কার্যক্রম আরও দৃশ্যমান করার জন্য আরও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। তিনি অডিটরদের ক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি কোম্পানির পরিচালনাপর্ষদ এবং ব্যবস্থাপনার কাজে নিয়োজিতদের ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য বিদ্যমান আইনের ৪৭ ধারার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। জনস্বার্থের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়ে আত্মবিশাস ফিরিয়ে আনতে তিনি আইনের ৭১ ধারা ব্যবহারের জন্য কাউন্সিলের প্রতি আহ্বান জানান।
আইসিএবি-এর সভাপতি মোহাম্মদ ফারুক বলেন, রেগুলেটরদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার জন্য কাউন্সিলকে কাজ করতে হবে। সাধারণত অডিটরদের দ্বারা তৈরি কোম্পানিগুলোর অডিট রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করেই সেসব প্রতিষ্ঠানের ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্ট তৈরি করা হয় এবং এক্ষেত্রে কোনো ধরনের অসঙ্গতি পরিলক্ষিত হলে অডিটরদের পাশাপাশি সেই প্রতিষ্ঠানের পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনার কাজে নিয়োজিতদেরও আইনের আওতায় নিয়ে আসা প্রয়োজন।
ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিলের প্রাক্তন চেয়ারম্যান সি কিউ কে মোস্তাক আহমেদ কাউন্সিলের পর্যবেক্ষণের কার্যক্রম আরও বাড়ানো ও শক্তিশালীকরণের আহ্বান জানান। তিনি বিদ্যমান আইনে বেসরকারি খাতে এসএমইদের থ্রেসহোল্ড-এর সীমা পুনর্নির্ধারণের জন্য সংশ্লিষ্ট খাতের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনার পরামর্শ দেন।
স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের প্রধান অর্থনৈতিক কর্মকর্তা আব্দুল কাদের জোয়ারদার, ওমেরা ফুয়েলস লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আকতার হোসেন, নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকালটি সদস্য প্রফেসর ড. শরীফ আহকাম প্রমুখ মুক্ত আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। আলোচকরা পরিচালনাপর্ষদের সদস্যদের মানসিকতা পরিবর্তন, অডিট ফি বাড়ানো এবং ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানসমূহে দক্ষ অডিট কর্মকর্তা নিয়োগের ওপর জোর দেন।