আইডিআরএ চেয়ারম্যানের ক্ষমতা অপব্যবহারে অপসারিত হোমল্যান্ডের সিইও

আইডিআরএ চেয়ারম্যানের ক্ষমতা অপব্যবহারে অপসারিত হোমল্যান্ডের সিইও
আইডিআরএ চেয়ারম্যানের ক্ষমতা অপব্যবহারে হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ড. বিশ্বজিৎ কুমার মন্ডলকে অপসারণ করা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার (২১ সেপ্টেম্বর) এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে বীমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। জানা যায়, বিশেষ নিরীক্ষককে তথ্য না দেয়ার মতো ঠুনকে অভিযোগে আইনের মনগড়া ব্যাখ্যা দিয়ে হোমল্যান্ডের সিইওকে অপসারন করা হয়।

বীমা আইনের ২৯ ধারায় বিশেষ নিরীক্ষক নিয়োগের বিষয়ে বলা হয়েছে এবং প্রাসঙ্গিক যেকোন কাগজপত্র ও তথ্যাদি তলব করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে নিরীক্ষককে। তবে বিশেষ নিরীক্ষককে তথ্য না দেয়ার বিষয়ে কোন শাস্তির বিধান উল্লেখ নেই আইনের এ ধারায়।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কারো বিরুদ্ধে তথ্য না দেয়ার অভিযোগ উঠলে বীমা আইনের ৪৯ ধারায় শাস্তির বিধান রয়েছে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড এবং উক্ত অপরাধ সংঘটন চলমান থাকলে প্রতিদিনের জন্য অতিরিক্ত ৫ হাজার টাকা করে অর্থ দণ্ডের বিধান রয়েছে।

অপরদিকে কারো বিরুদ্ধে বীমা আইনের বিধান পালনে ব্যর্থতার অভিযোগ উঠলে এই আইনের ১৩৪ ধারায় শাস্তির বিধান রয়েছে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা এবং সর্বনিম্ন ৫০ হাজার টাকা এবং লঙ্ঘন অব্যাহত থাকলে লঙ্ঘনজনিত সময়ের প্রতিদিনের জন্য অনধিক ৫ হাজার টাকা অতিরিক্ত অর্থ জরিমানার বিধান রয়েছে।

এদিকে বিশেষ নিরীক্ষককে তথ্য না দেয়ার মতো ঠুনকে অভিযোগে ড. বিশ্বজিৎ কুমার মন্ডলকে হোমল্যান্ড লাইফের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা পদ থেকে অপসারণের আইনগত ভিত্তি খুঁজে পাচ্ছেন না খাত সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, বীমা আইনের ২৯ ধারার বিধান পরিপালনে ব্যর্থতার জন্য ব্যক্তিগত জরিমানা বা অর্থ দণ্ডের বাইরে অন্য কোন শাস্তি দেয়ার সুযোগ নেই।

জানা গেছে, হোমল্যান্ড লাইফের ২০১৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত অনিষ্পন্ন বীমা দাবি, ব্যবস্থাপনা ব্যয়, কমিশন প্রদান, বীমা সংক্রান্ত সব লেনদেন, কোম্পানির আর্থিক সক্ষমতা যাচাই করতে বিশেষ নিরীক্ষার জন্য গত বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান হুসেইন ফরহাদ অ্যান্ড কোং-কে নিয়োগ দেয় আইডিআরএ। এরপর ১৪ নভেম্বর বীমা আইন ২০১০ এর ২৯ (২) ধারার ক্ষমতাবলে নিরীক্ষা দলকে সব তথ্য অভিগম্যতাসহ সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে হোমল্যান্ড লাইফকে নির্দেশ দেয় আইডিআরএ।

তবে আইডিআরএ অভিযোগ, হুসাইন ফরহাদ অ্যান্ড কোং চলতি বছরের ২৯ জানুয়ারি আইডিআরএ’কে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে- বিশেষ নিরীক্ষা কর্যক্রম পরিচালনার জন্য হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্সের কাছে বারবার তাগাদা দেয়া হলেও অধিযাচিত তথ্য, রেকর্ডপত্র, প্রমাণ না পাওয়ায় তাদের পক্ষে সুষ্ঠুভাবে বিশেষ নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা সম্ভব হচ্ছে না।

একইসঙ্গে আইডিআরএ অভিযোগ তুলেছে, চলতি বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি বিশেষ নিরীক্ষার এক্সিট সভায় কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন এবং ওই সভায় গুরুত্বপূর্ণ নিরীক্ষা পর্ববেক্ষণের বিষয়ে তথ্য প্রদান না করায় তা অমীমাংসিত রয়ে গেছে। এছাড়া নিরীক্ষা কাজে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ অসহযোগিতা এবং প্রয়োজনীয় লেনদেন, বিল-ভাউচার, দলিলাদি কোম্পানি থেকে সরবরাহ না করায় নিরীক্ষা কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পারেনি অডিট ফার্ম।

আইডিআরএ আরো অভিযোগ তুলেছে, চলতি মাসের ১০ তারিখ বিশেষ নিরীক্ষা কার্যক্রমের বিষয়ে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ, হোমল্যান্ড লাইফ এবং নিরীক্ষা ফার্ম হুসেইন ফরহাদ অ্যান্ড কোং-এর মধ্যে ত্রিপক্ষীয় শুনানি হয়। শুনানিতে হোমল্যান্ড লাইফের বিরুদ্ধে কোম্পানির ব্যাংক হিসাবে অনিয়ম, লাইসেন্সবিহীন এজেন্টকে কমিশন দেয়া, অনিষ্পন্ন বীমা দাবি অর্থ ও বীমা দাবির সংখ্যায় গড়মিল, হিসাববিহীন নবায়ন প্রিমিয়াম আয়, ব্যবসায় সমাপনী তথ্য ও প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম আয়ের তথ্য প্রদান না করা, প্রশাসনিক ও অন্যান্য ব্যবস্থাপনা ব্যয়ে অনিয়ম এবং ভাউচার ও নথি প্রদানে অসহযোগিতার বিষয় প্রমাণিত হয়।

এসব অভিযোগ তুলে গত ১৪ আগস্ট আইডিআরএ থেকে হোমল্যান্ড লাইফের মুখ্য নির্বাহীকে দেয়া চিঠিতে বলা হয়েছে, ড. বিশ্বজিৎ কুমার মন্ডল হোমল্যান্ড লাইফের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা পদে থাকায় বিশেষ নিরীক্ষা কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন বিঘ্নিত হয়েছে। এ কারণে ড. বিশ্বজিৎ কুমার মন্ডল বীমা আইন লঙ্ঘন করেছেন এবং নিরীক্ষা কাজে তার অসহযোগিতা বীমা গ্রহীতা ও বীমাকারীর স্বার্থের পরিপন্থি কার্যক্রম হিসেবে কর্তৃপক্ষের নিকট গণ্য হয়েছে।

এজন্য বীমা আইন ২০১০ এর ৫০ ধারার ১(খ) উপধারায় দেয়া ক্ষমতাবলে ড. বিশ্বজিৎ কুমার মন্ডলকে কেন হোমল্যান্ড লাইফের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাপদ থেকে অপসারণ করা হবে না তিন দিনের মধ্যে তার ব্যাখা চাওয়া হয় চিঠিতে। একইসঙ্গে ড. বিশ্বজিৎ কুমার মন্ডলকে হোমল্যান্ড লাইফের মুখ্য নির্বাহীর দায়িত্ব পালনে বিরত থাকার নির্দেশ দেয়া হয়।

এর আগে চলতি বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি আইডিআরএ থেকে হোমল্যান্ড লাইফের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাকে একটি চিঠি দেয়া হয়। ওই চিঠিতে বীমা আইন ২০১০ এর ১৩৪ ধারা অনুযায়ী কেন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না, তার কারণ জানতে চেয়ে নিরীক্ষা কর্যক্রম সম্পন্ন করে ৯০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়। কিন্তু কোম্পানি নিরীক্ষা সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় নথি সময় মতো সরবরাহ না করায় নিরীক্ষা কার্যক্রম সম্পন্ন করে প্রতিবেদন দাখিল করতে বিলম্ব হচ্ছে বলে নিরীক্ষা ফার্ম জানিয়েছে।

এর পরিপ্রেক্ষিতে ২৮ ফেব্রুয়ারি ড. বিশ্বজিৎ চিঠি দিয়ে আইডিআরএ চেয়ারম্যানকে জানান, ২০১৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত তিন বছরের বিশেষ নিরীক্ষার জন্য ২০২২ সালে ১৪ সেপ্টেম্বর নিরীক্ষা ফার্ম নিয়োগ দেয়া হয়। তিন বছরের নিরীক্ষা কাজ হাতে নিয়ে এক মাস পরে ২০২২ সালের ১৭ অক্টোবর নিরীক্ষা কার্যক্রম শুরু করে। নিরীক্ষা ফার্মের পাঁচজন আর্টিকেল্ড স্টুডেন্ট কাজ করার কথা থাকলেও কোন দিন তাদের পাঁচজন ছাত্র একত্রে কাজ করেননি। নিয়মিতভাবে সর্বোচ্চ তিনজন কাজ করেছেন।

এতে বলা হয়েছে, আর্টিকেল্ড স্টুডেন্টরা মূল কাজ শুরু করেন ২০২২ সালের ২৫ অক্টোবর থেকে। ১০ নভেম্বর থেকে ২৬ নভেম্বর পর্যন্ত তারা পরীক্ষার জন্য ছুটিতে ছিলেন এবং কেউ কাজে আসেননি। এসব প্রতিকূলতাই নিরীক্ষা কাজ সম্পন্ন করতে দেরি হওয়ার মূল কারণ।

এতে আরও বলা হয়েছে, ২০২২ সালের ২৫ অক্টোবর থেকে ২০২৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তারা মোট ৫১টি আইটেমের চাহিদা দিয়েছেন। আমরা ২০২৩ সালের ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত তাদের চাহিদার শতভাগ কাগজপত্র জোগান দিয়েছি। পরবর্তী সময়ে চলতি বছরের ২৪ জানুয়ারি থেকে ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৩০টি আইটেমের চাহিদা পাই এবং ২৪ জানুয়ারি থেকে ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নিরীক্ষকদের সরবরাহ করা হয়। সর্বশেষ ২৪ ফেব্রুয়ারি তারা কাজ শেষ করে চলে যান।

বিশ্বজিৎ চিঠিতে বলেছেন, নিরীক্ষকরা নিয়োগ পাওয়ার এক মাস পরে কাজে যোগ দেয়া, ৫ জন স্টুডেন্টের পরিবর্তে ৩ জন নিয়মিতভাবে কাজ করা, এরমধ্যে আবার ১৫-১৬ দিন কাজ বন্ধ রাখার পরও আমাদের কাগজপত্র সরবরাহ করতে বিলম্বের কারণে কাজ ব্যাহত হওয়াকে একমাত্র কারণ উল্লেখ করে আমাদের ওপর একতরফা দোষ চাপিয়ে তাদের দায়-দায়িত্ব হতে অব্যাহতি পাওয়ার অজুহাত খোঁজার বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। এ বিষয়ে আমরা মর্মাহত।

শুধু কাগজপত্র সরবরাহের কারণেই যে নিরীক্ষা কাজ শেষ করতে দেরি হচ্ছে, তা একতরফাভাবে বলা ঠিক হবে না। যাইহোক কাগজপত্র সরবরাহের জন্য আমাদের তরফ থেকে খুব কম সময় দেরি করা হলেও আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করছি। এমন তথ্য উল্লেখ করে চিঠিতে নিরীক্ষা কাজে অসহযোগিতার যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার অনুরোধ করা হয়।

এরপর গত ১৫ মে আইডিআরএ থেকে আবারও হোমল্যান্ডের মুখ্য নির্বাহীকে চিঠি দিয়ে নিরীক্ষা কাজে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ সুষ্ঠুভাবে নিরীক্ষা কর্যক্রম পরিচালনায় অসহযোগিতা করেছে বলে অভিযোগ করা হয়। সেই সঙ্গে বীমা আইন ২০১০ এর ২৯ ধারার ক্ষমতাবলে কাজে অসহযোগিতার জন্য কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাএবং প্রধান অর্থ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বীমা আইন ২০১০ এর ১৩৪ ধারা অনুযায়ী কেন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না, তার জবাব চাওয়া হয়।

২৫ মে আইডিআরএ’র এই চিঠির জবাব দেন বিশ্বজিৎ। এ সংক্রান্ত চিঠিতেও নিরীক্ষকদের চাহিদা মতো বিভিন্ন ভাউচার, দলিলাদি সরবরাহ করা হয়েছে উল্লেখ করা হয়। নিরীক্ষকদের কীভাবে তথ্য সরবরাহ করা হয়েছে, তার বিস্তারিতও উল্লেখ করা হয় চিঠিতে।

এরপর গত ৭ জুন বিশ্বজিৎ আইডিআরএ চেয়ারম্যানকে একটি চিঠি দেন। ওই চিঠিতে গ্রাহকদের বীমা দাবি পরিশোধের জন্য পর্ষদকে তহবিল বরাদ্দ দেয়ার নির্দেশনা দেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়। কোম্পানির তহবিলে কোন অর্থ না থাকায় এবং পরিচালনা পর্ষদ তহবিল ভেঙে বীমা দাবি পরিশোধ আগ্রহী না হওয়ায় এই নির্দেশনা দেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়।

বিশ্বজিৎ বীমা গ্রাহকদের বীমা দাবি পরিশোধের লক্ষ্যে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে এমন চিঠি দেয়ার পরই তাকে কেন বীমা আইন ২০১০ এর ৫০ ধারার ১(খ) উপ-ধারায় দেওয়া ক্ষমতাবলে হোমল্যান্ড লাইফের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাপদ থেকে অপসারণ করা হবে না তা জানতে চেয়ে কারণ দর্শনানোর নোটিশ দেয়া হয়।

১৪ আগস্ট আইডিআরএ থেকে দেয়া এ কারণ দর্শানোর নোটিশের জবাব ২১ আগস্ট দেন বিশ্বজিৎ। এ সংক্রান্ত চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, বীমা আইন ২০১০ এর ১৩৪ ধারার কারণ দর্শানোর নোটিশের জবাবে ২০২৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি এবং ২৫ মে আমরা অবহিত করেছি, যা আপনার পাঠানো কারণ দর্শানোর নোটিশে উল্লেখিত হয়নি।

চিঠিতে বলা হয়েছে, নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানকে তথ্য দেয়ার জন্য কোম্পানির দায়িত্ব পাওয়া কর্মকর্তা আশিষ মালাকার গত ২ জুলাই চাকরি ছেড়ে চলে যান। ব্যক্তিগত কারণে তাৎক্ষণিকভাবে তার পক্ষে সব কাগজপত্র কোম্পানিকে বুঝিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়নি। এরপরও শুনানি সভায় সব কাগজপত্রসহ উপস্থিত হওয়ার জন্য তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ঢাকার বাইরে থাকায় আমরা শুনানির দিন সব কাগজপত্রসহ উপস্থিত হতে পারিনি। ১০ আগস্ট শুনানির দিন পরিচিতি পর্বের সময় আমি বিষয়টি মৌখিকভাবে আপনাদের অবহিত করেছিলাম। শুনানির পরবর্তীসময়ে তার সঙ্গে যোগাযোগ করে সব তথ্য (ই-মেইলসহ) সংগ্রহ করা হয়েছে।

চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, বিশেষ নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য হোমল্যান্ড লাইফকে বার বার তাগাদা দেওয়া সত্ত্বেও অযাচিত তথ্য, রেকর্ডপত্র, প্রমাণ না পাওয়ায় তাদের পক্ষে সুষ্ঠুভাবে বিশেষ নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না মর্মে নিরীক্ষকরা যে অভিযোগ করেছেন তা সঠিক নয়। আসলে নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানকে তথ্য সরবরাহ না করার বিষয়টি আমার ব্যক্তিগত কোনো স্বার্থ হাসিল বা অসৎ উদ্দেশ্যে নয়। গ্রাহক স্বার্থ সংরক্ষণই আমার মূল উদ্দেশ্য। আমি আগেও বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছি এবং কখনোই গ্রাহক স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করার কোন অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে উত্থাপিত হয়নি।

কোম্পানির ব্যাংক হিসাবে অনিয়ম নিয়ে তোলা অভিযোগের বিষয়ে বিশ্বজিৎ জানিয়েছেন, নিরীক্ষা কার্যকাল ২০১৮ থেকে ২০২০ সাল। আমাদের প্রধান কার্যালয়ে জায়গা সংকুলান না হওয়ায় কাগজপত্র শ্যামলী ও দৈনিক বাংলায় কোম্পানির স্টোর রুমে রাখা হয়। তৎকালীন যারা স্টোরের দায়িত্বে ছিলেন তারাও অনেকেই এখন কোম্পানিতে নেই। তাই নিরীক্ষকদের ২০২২ সালের ৩ নভেম্বর, ২৫ অক্টোবর, ২৭ নভেম্বর ও ৫ ডিসেম্বর এবং চলতি বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে কাগজপত্র স্টোর থেকে খুঁজে বের করে মেইলে সরবরাহ করা হয়। চিঠিতে ই-মেইল ঠিকানা এবং কোন তারিখে কোন তথ্য দেওয়া হয়েছে তাও উল্লেখ করা হয়েছে।

এক্সিট সভা নিয়ে তোলা অভিযোগের বিষয়ে বিশ্বজিৎ জানিয়েছেন, এক্সিট সভাটি অনুষ্ঠিত হয় ২৭ ফেব্রুয়ারি। সভায় বিশেষ নিরীক্ষা কার্যক্রমের পরিকল্পনা নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে কথা হয়। কীভাবে নিরীক্ষকরা কাজ করেছেন তা নিয়েই কথা হয়েছে। তবে তথ্য সরবরাহ না করার কারণে নিরীক্ষা কার্যক্রম অমীমাংসিত রয়ে গেছে এমন কোনো বিষয় নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বলা হয়নি। ওই সময়ে কী কী বিষয় অমীমাংসিত রয়ে গেছে তা আমাদের জানানো হয়নি। এক্সিট মিটিংয়ের সংক্ষিপ্ত আলোচনার বিষয়বস্তু আপনাদের কাছে নিরীক্ষকরা দাখিল করে ২৭ জুলাই, যা মিটিং শেষ হওয়ার পাঁচ মাস পর। কোনো বিষয় অমীমাংসিত থাকলে ওই বিষয়টি আমাদের কোনো পত্র দিয়ে জানানো প্রয়োজন ছিল। তাহলে আমরা তাৎক্ষণিক বিষয়টি নিয়ে পারস্পরিক আলোচনা করতে পারতাম।

অনিষ্পন্ন বীমা দাবির অর্থ ও বীমা দাবির সংখ্যার গড়মিল নিয়ে করা অভিযোগের বিষয়ে বিশ্বজিৎ বলেছেন, অনিষ্পন্ন দাবির মধ্যে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে ৯ কোটি ৯৯ লাখ টাকার যে পার্থক্যের কথা বলা হয়েছে, তা আমার দায়িত্ব পালনের সময়ে নয়। বিশেষ নিরীক্ষক তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন, বীমা দাবি অনিষ্পন্ন রয়েছে ১২ কোটি ৬ লাখ টাকা, যার মধ্যে ২ কোটি ৭ লাখ টাকার প্রভিশন করা হয়েছে। নিয়ম অনুসারে ৯ কোটি ৯৯ লাখ টাকার প্রভিশন করা হয়নি। এটি ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২০ সালে যারা দায়িত্বে ছিলেন তাদের ভুল। সে কারণে বিষয়টি স্বীকার করে নিয়ে আমি বলেছি কোম্পানি অনিষ্পন্ন বীমা দাবি হিসাব ভুক্তকরণে সে সময় ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ভুল করেছে। কিন্তু পরবর্তীসময়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পাওয়া সাপেক্ষে বীমা দাবির অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে।

এ বিষয়ে আরও বলা হয়েছে, বর্তমানে কোম্পানির অনিষ্পন্ন বীমা দাবির পরিমাণ ৭৯ কোটি ৭০ লাখ টাকা, যা কর্তৃপক্ষের চাহিদা মোতাবেক বিভিন্ন সময়ে তথ্য দেওয়া হয়েছে। যে কারণে অনিষ্পন্ন দাবির পরিমাণ বর্তমানে বেশি বলে আমি উল্লেখ করেছি। তাই বীমা দাবির বিষয়ে সঠিক তথ্য আমি দেইনি বলে ৫০(১) (খ) ধারায় যে অভিযোগ করা হয়েছে তা সঠিক নয়।

অনিষ্পন্ন দাবির বিষয়ে তথ্য সরবরাহ করা হয়নি বলে বিশ্বজিৎ’র বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তোলা হয়েছে, তা থেকে অব্যাহতি দেওয়ারও অনুরোধ জানানো হয়েছে চিঠিতে।

যোগাযোগ করা হলে একাধিক বীমা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাবলেন, প্রথমে দু-দফায় হোমল্যান্ড লাইফের মুখ্য নির্বাহীকে বীমা আইনের ১৩৪ ধারা অনুযায়ী কেন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না, তা জানতে চেয়ে শোকজ করা হয়। যাকে শোকজ করা হয় তিনি তার উত্তরও দিয়েছেন। কিন্তু তার উত্তর গ্রহণযোগ্য হয়েছে কি না? তার সমাধান না করেই হঠাৎ ৫০ ধারার ১(খ) উপ-ধারা অনুযায়ী তাকে অপসারণ করার বিষয়ে শোকজ এবং পরবর্তীতে অপসারণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ যুক্তিসঙ্গত হয়নি।

তারা বলেন, বিশেষ নিরীক্ষার সময় নির্ধারণ করা হয়েছে ২০১৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত। সে সময় বিশ্বজিৎ কুমার হোমল্যান্ড লাইফে ছিলেন না। সুতরাং সেই সময়ের অনিয়মের জন্য তিনি দায়ী নন। তাহলে ওই সময়ের তথ্য দিতে তার আপত্তি থাকার কথা নয়। এখানে মনে হচ্ছে অন্য কোন কারণ আছে। বিশ্বজিৎ’র বিরুদ্ধে ইচ্ছাকৃতভাবে মনগড়া অভিযোগ তোলা হচ্ছে কি না বিষয়টি খতিয়ে দেখা উচিত।

তারা আরও বলেন, এর আগেও আইডিআরএ শীর্ষ কর্মকর্তারা নানা বিতর্কে জড়িয়েছেন। একজন তো ঘুষ দাবির অভিযোগ মাথায় নিয়েই আইডিআরএ চেয়ারম্যানের পদ ছেড়েছেন। আবার বর্তমানে দায়িত্বে থাকা লাইফ মেম্বারের বিরুদ্ধে একটি কোম্পানির কর্মকর্তা ঘুষ চাওয়ার অভিযোগ তুলেছেন। নিয়ন্ত্রক সংস্থার বিরুদ্ধে বারবার এ ধরনের অভিযোগ ওঠা ভালো লক্ষণ নয়। এটি সার্বিক বীমা খাতের জন্য ক্ষতিকর। এমনিতেই বীমা খাতের ওপর মানুষের আস্থার সংকট রয়েছে।

এ ছাড়াও নিরীক্ষকদের আপত্তির বিষয়ে হোমল্যান্ড লাইফের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নথিপত্র সরবরাহপূর্বক নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে যে জবাব দিয়েছেন তার সত্যতা যাচাইসহ এ ধরণের বড় একটি সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে অন্ততপক্ষে ত্রিপক্ষীয় একটি শুনানি করা উচিত ছিল বলে মনে করেন একাধিক বীমা কোম্পানির সিইও’রা।

অভিযোগ রয়েছে, হোমল্যান্ড লাইফের বর্তমান চেয়ারম্যান হান্নান মিয়া নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জয়নুল বারীর ঘনিষ্ঠজন।পরিচালকদের দ্বন্দ্ব নিরসন ও গ্রাহক স্বার্থ রক্ষায় প্রশাসক নিয়োগের পরিবর্তে নিরপেক্ষ পরিচালক করে হান্নান মিয়াকে বীমা কোম্পানিটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত করেন মোহাম্মদ জয়নুল বারী। এই নিয়োগ দেয়া হয় ২০২২ সালের ৬ নভেম্বর।

এদিকে হান্নান মিয়া হোমল্যান্ড লাইফে যোগদানের পর থেকে অবৈধভাবে নানান সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করে আসছিলেন। তবে এই সুবিধা গ্রহণে বীমা কোম্পানিটি পরিচালনা পর্ষদ নেতিবাচক অবস্থান নেয়। এ ঘটনায় হান্নান মিয়া কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ কুমার মণ্ডলকে দায়ী করে আসছিলেন এবং তাকে অপসারণে নেপথ্যে কাজ করেছেন বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে।

হান্নান মিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তিনি বীমা কোম্পানিটিতে যোগদানের পর থেকে গাড়ির জ্বালানি বাবদ ভুয়া বিল-ভাউচার দেখিয়ে কোম্পানি থেকে অতিরিক্ত অর্থ গ্রহণ করতেন। আবার নিজের বাসার ড্রাইভারকে হোমল্যান্ড লাইফের ড্রাইভার হিসেবে নিয়োগ দেখিয়ে গ্রহণ করছেন বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা।

এছাড়াও তেল খরচের স্লিপ ঘষা-মাজা এবং ওভারটাইম না করেই ওভারটাইমের বিল নেয়ার অভিযোগ রয়েছে হান্নান মিয়ার ড্রাইভারের বিরুদ্ধে। এসব বিষয়ে চেয়ারম্যান হান্নান মিয়াকে জানানো হলেও তিনি তার ড্রাইভারের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেননি।

আরো অভিযোগ রয়েছে, পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়-স্বজন নিয়ে হোমল্যান্ড লাইফ কার্যালয়ে ব্যক্তিগতভাবে বসন্ত উৎসব আয়োজন করেছেন হান্নান মিয়া। উৎসব উদযাপনের খরচও তিনি নিয়েছেন কোম্পানি থেকে।

অপসারণের বিষয়ে বিশ্বজিৎ কুমার মণ্ডল বলেন, আইডিআরএ আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ এনেছে অপারণের ক্ষেত্রে এগুলোর কোন ভিত্তি নেই। এক্ষেত্রে অন্যের দায় আমার ওপর চাপানো হয়েছে।

তিনি বলেন, অতীতে কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ও বিভিন্ন কর্মকর্তা কোম্পানির অর্থ আত্মসাৎ করেছে। যার ফলে কোম্পানির তহবিল ঘাটতি হয়েছে এবং দাবি পরিশোধ না করায় গ্রাহকরা আইডিআরএ’র কাছে অভিযোগ করেছে ও মামলা করেছে।

তিনি বলেন, বিষয়গুলো তো আমার আমলের না। আমি এসেছি মাত্র ১ বছর আগে। সুতরাং বীমা দাবি পরিশোধ না করায় আমাকে অভিযুক্ত করে অপসারণ করা সম্পূর্ণরূপে আইনবহির্ভূত এবং আইডিআরএ’র ক্ষমতার অপব্যবহার বলে আমি মনে করি।

বিশ্বজিৎ কুমার মণ্ডল বলেন, আমি কোম্পানিতে যোগদানের পর ৩৫ কোটি ৯ লাখ টাকার দাবি পরিশোধ করেছি। এরপরও আমি দাবি পরিশোধে পরিচালনা পর্ষদের কাছে অর্থ ছাড় চেয়েছি। কিন্তু পর্ষদ চেয়ারম্যান হান্নান মিয়া এ বিষয়ে কোন সিদ্ধান্তই দেননি। পরবর্তীতে আমি আইডিআরএ’র কাছে অর্থ ছাড়ের অনুমোদনের নির্দেশনা চেয়েছি। দীর্ঘ ৩ মাস আইডিআরএ থেকে টালবাহানা করে আমাকে অপসারণের মাত্র কয়েকদিন আগে ১০ কোটি টাকার বন্ড ভাঙ্গানোর অনুমোদন দিয়ে দাবি পরিশোধ করতে বলা হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, ২০১৮-২০২০ সালে যদি কোন অনিয়ম হয়ে থাকে এবং তার জন্য যদি গ্রাহক স্বার্থ ক্ষুন্ন হয়ে থাকে তবে তার জন্য সংশ্লিষ্ট সময়ের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকেই দায়ী করতে হবে, আমাকে নয়। আর তথ্য সরবরাহে ঘাটতি থাকলে তাতে আইন লঙ্ঘন হতে পারে পারে এবং তার জন্য বীমা আইনের ১৩৪ ধারার বিধান আছে। এক্ষেত্রে এটিকে ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে ৫০ ধারায় নেয়ার কোন সুযোগ নেই; আইন বিশেষজ্ঞরাও এটাই মনে করেন।

বিশ্বজিৎ কুমার মণ্ডল বলেন, আমি করপোরেট অফিসের প্র্যাকটিস অনুসারেই নিরীক্ষকের প্রতিটি চিঠির ওপর স্বাক্ষর করে কোম্পানির সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে সে বিষয়ে তথ্য সরবরাহ বা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার আদেশ দিয়েছি। আলাদাভাবে অফিস আদেশ দিয়ে এ ধরণের কাজের দায়িত্ব দেয়ার কোন নজির আছে বলে মনে হয় না। সুতরাং এ ধরনের খোঁড়া যুক্তি দিয়ে অপসারণের কোন যৌক্তিকতা নেই।

আর্কাইভ থেকে

আরও পড়ুন

ব্র্যাক ব্যাংক ও মেটলাইফের মধ্যে ব্যাংকাসুরেন্স চুক্তি
৩৪ ব্যাংক ‘ব্যাংকাস্যুরেন্স’ ব্যবসায় অযোগ্য
কমেছে জীবন বিমার বিনিয়োগ, বেড়েছে সাধারণ বিমার
বিআইএ’র বার্ষিক সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত
ফের সোনার বাংলা ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারপারসন শেখ কবির
মেটলাইফের বিমা সুবিধা পাবেন ক্যাল বাংলাদেশের কর্মীরা
বেস্ট সিইও'র স্বীকৃতি পেলেন ন্যাশনাল লাইফের কাজিম উদ্দিন
বিমা খাতের বড় সমস্যা কর্পোরেট গভর্নেন্সের অভাব
দুর্বল বিমা কোম্পানিকে মূলধারায় নিয়ে আসার চেষ্টা করতে হবে
যাত্রা শুরু করলো শান্তা লাইফ ইন্স্যুরেন্স