জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা সফল রাজনীতিবিদ। শেখ হাসিনা চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হয়ে দেশ পরিচালনা করছেন। বঙ্গবন্ধুর আরেক কন্যা রাজনীতির সঙ্গে উৎপোতভাবে জড়িত না থাকলেও তিনি বোনের সার্বক্ষণিক সঙ্গী। বঙ্গবন্ধুর দুই ছেলের মধ্যে শেখ কামাল রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু ১৫ আগস্ট নৃশংশভাবে বঙ্গবন্ধু পরিবারের প্রায় সবাইকে হত্যা করা হয়। অনেকেই ভেবেছিলেন বঙ্গবন্ধু পরিবার অধ্যায়ের শেষ। কিন্তু তার কন্যা শেখ হাসিনা বাবার নাম উজ্জল করেছেন। বঙ্গবন্ধুর সমসাময়িক আরো কয়েকজন বাঙালি নেতা আছেন যাদের আমরা শ্রদ্ধাভরে স্বরণ করি। তাদের সন্তানদের খোঁজ আমরা কয়জন জানি? এমনই কয়েকজন নেতার সন্তানদের খোঁজ দেওয়া হলো:
হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী
গণতন্ত্রের মানসপুত্রখ্যাত উপমহাদেশের বরেণ্য রাজনীতিক হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। যুক্ত পাকিস্তানের এক সময়ের প্রধানমন্ত্রী ও নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক গুরু তিনি। ব্যাক্তিগত জীবনে তিনি দুই বিয়ে করেছেন। স্যার আবদুর রহিমের কন্যা নিয়াজ ফাতেমার সাথে বিয়ে হয় ১৯২০ সালে। নিয়াজ ফাতেমা ১৯২২ সালে ইন্তেকাল করেন। তার এক পুত্র ও এক কন্যা আকতার জাহান ও শাহাব সোহরাওয়ার্দী। শাহাব সোহরাওয়ার্দী ছাত্র থাকাকালে ১৯৪০ সালে লন্ডনে মৃত্যুবরণ করেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর ১৮ বছর বিয়ে করেননি। ১৯৪০ সালে তিনি রাশিয়ান অভিনেত্রী ভেরা অ্যালেক্সান ড্রভনা টিসেস্কোকে বিয়ে করেন। ১৯৪৬ সালে বিবাহ বিচ্ছেদ হলে ভেরা শিশুপুত্র রাশেদকে নিয়ে লন্ডনে বসবাস করেন। ভেরা অ্যালেক্সান ড্রভনা টিসেস্কো ১৯৮৩ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ইচ্ছা ছিল পুত্র আইনে ডিগ্রি নিয়ে রাজনীতিতে যোগ দেবেন। পিতার বাসনা পূরণ হয়নি। রাশেদ সোহরাওয়ার্দী চার্টার হাউস অক্সফোর্ড এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি মায়ের পদাঙ্ক অনুসরণ করে রয়েল একাডেমি অব ড্রামাটিক আর্ট থেকে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে অভিনয় পেশায় যোগ দেন। তিনি রয়েল শেকসপিয়র কোম্পানিতে কয়েক বছর ছিলেন।
রাশেদ সোহরাওয়ার্দী আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অভিনেতা। তিনি ১৯৬৩ সালে ডক্টর হু, ১৯৯৮ সালে জিন্নাহ, ২০১৫ সালে লিজেন্ড চলচ্চিত্রে অভিনয় করে বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেন। জিন্নাহ চলচ্চিত্রে তিনি নেহরুর ভূমিকায় অপূর্ব অভিনয় করেন। তিনি একজন বিশ্বখ্যাত লেখকও ছিলেন। লেখক হিসেবে তিনি রবার্ট অ্যাশবি নামে পরিচিত।
তবে রাশেদ অভিনয়কে প্রাধান্য দিয়ে যতটা পেরেছেন রাজনীতির সঙ্গে ছিলেন। ছাত্রজীবনে তিনি পিতার গ্রেপ্তার, মুক্তি আন্দোলন দেখেছেন। তিনি বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলন ৬ দফা ও মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা ঘোষণার পর শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের গ্রেফতার করা হয়। আওয়ামী লীগের এ সংকটকালে দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া লন্ডন থেকে রাশেদ সোহরাওয়ার্দীকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। পল্টন ময়দানে ৬ দফা ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমানের আসন শূন্য রেখে সভা চলছে। প্রধান অতিথি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পুত্র রাশেদ সোহরাওয়ার্দী। তিনি ৬ দফা বাস্তবায়ন ও শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগের নেতাদের মুক্তি দাবি করেন। তার ভাষণ ৬ দফা আন্দোলনকে বেগবান করে।
লন্ডন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা ছিলেন রাশেদ সোহরাওয়ার্দী। তিনি এক বক্তৃতায় বলেছেন, I consider Sheikh Hasina & Sheikh Rehana as my own sisters. I request her, to remaining Prime Minister as long as she lives. তার এ ভাষণ সত্যিই প্রমাণিত। শেখ হাসিনা রাজনীতিতে আছেন এবং চতুর্থবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। রাশেদ সোহরাওয়ার্দী ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্ব জনমত সৃষ্টির জন্য নেতৃত্ব দেন। পিতার মতো তার মেধা ও দক্ষতাও ছিল। রাশেদ চৌধুরী এ বছর ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে লন্ডনে মৃত্যুবরণ করেন।
মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ১৯২৫ সালে প্রায় ৪০ বছর বয়সে বগুড়ার পাঁচবিবির জমিদার শামসুদ্দিন আহমদ চৌধুরীর মেয়ে আলেমা খাতুনকে বিবাহ করেন। তখন আলেমা খাতুনের বয়স ছিল ১৮-১৯ বছর। আলেমা খাতুনের গর্ভে ৩ ছেলে ও ২ মেয়ে জন্মগ্রহণ করেন। প্রথম ছেলে আজিজুল হক শৈশবেই মারা যান। অন্যান্যরা হলেন- রেজিয়া খানম, আবু নাসের খান, গোলাম কিবরিয়া এবং মাহমুদা খানম।
এরপর রাজনৈতিক প্রয়োজনে মওলানা ভাসানী আরও দু’বার বিয়ে করেছিলেন। দ্বিতীয় বিয়ে করেন টাঙ্গাইলের দীঘুলিয়া গ্রামের আবদুর রহমান মীরের মেয়ে আকলিমা খাতুনকে। বিয়ের ৬ মাস পরে আকলিমা খাতুন মারা যান। এরপর বিয়ে করেন বগুড়ার আদমদীঘি থানার কাঞ্চনপুর গ্রামের কাসিমউদ্দিন সরকারের মেয়ে হামিদা খাতুনকে। এ সময় হামিদা খাতুনের বয়স ছিল ১২ বছর। তার গর্ভে ১ ছেলে ও ২ মেয়ে- আবু বকর, আনোয়ারা খানম এবং মনোয়ারা খানম জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৪ সালের ডিসেম্বর মাসে হামিদা খাতুন মারা যান।
তার ছেলে আবু নাসের খান ভাসানী ছিলেন এরশাদ সরকারের মন্ত্রী। রাজনীতিতে তিনি তেমন সুবিধা করতে পারেননি। ভাসানীর তিন ছেলেই মারা গেছেন। চার মেয়ে বেঁচে থাকলেও তারা কেউ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নেই। ভাসানীর স্ত্রী আমেনা ভাসানী ন্যাপের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনিও মারা গেছেন। মওলানা ভাসানীর মেয়ের জামাই চৌধুরী মোতাহের হোসেন ছিলেন জিয়াউর রহমান সরকারে বিএনপি দলীয় এমপি।
শেরে বাংলা একে ফজলুল হক
এ. কে. ফজলুক হক এম.এ. পাশ করার পর দাম্পত্য জীবনে প্রবেশ করেন। এ সময় নবাব আবদুল লতিফ সি. আই. ই-এর নাতনি খুরশিদ তালাত বেগমের সাথে তার বিয়ে হয়। খুরশিদ তালাত বেগম দুটি কন্যা সন্তানের জন্ম দেন। খুরশিদ তালাত বেগমের অকাল মৃত্যুর পর তিনি হুগলী জেলার অধিবাসী এবং কলকাতা অবস্থানকারী ইবনে আহমদের কন্যা জিনাতুন্নেসা বেগমকে বিয়ে করেন। কিন্তু, জিনাতুন্নেসাও নিঃসন্তান অবস্থায় পরলোক গমন করেন এবং ১৯৪৩ সালে এ. কে. ফজলুক হক মীরাটের খাদিজাকে বিয়ে করেন।
তাদের ছেলে ফায়জুল হক ছিলেন জিয়া সরকারের বিএনপি দলীয় এমপি। পরে তিনি জাতীয় পার্টির টিকিটে এরশাদ সরকারের ও আওয়ামী লীগের টিকিটে শেখ হাসিনা সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। তার বড় ছেলে একে ফাইয়াজুল হক রাজু আওয়ামী লীগ নেতা। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বরিশাল-২ (উজিরপুর-বানাড়ীপাড়া) আসনে মনোনয়ন চেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। ফাইয়াজুল হক রাজু আওয়ামী লীগের সর্বশেষ কমিটির সহ-সম্পাদক ছিলেন। তবে তার মেয়ের জামাই আখতারুল আলম ফারুক ময়মনসিংহ জেলা বিএনপি নেতা।