প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার সরকার জনগণের ভবিষ্যতকে সুরক্ষিত করতে এবং সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য জাতীয় ‘মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা’ নামে একটি নতুন কর্মসূচি চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
‘আমাদের এও নিশ্চিত করা উচিত যে- উন্নয়নশীল দেশগুলো প্রশমন, অভিযোজন এবং দুর্যোগ প্রতিক্রিয়া ও পুনরুদ্ধারের জন্য বছরে অন্তত ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যেন পেতে পারে’,- যোগ করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী আজ বুধবার ‘মিডনাইট সার্ভাইভাল ডেডলাইন ফর দি ক্লাইমেট’ শীর্ষক ‘ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের (সিভিএফ)’ এক ভার্চুয়াল সম্মেলনে বর্তমান সভাপতি হিসেবে দেয়া ভাষণে এ আহ্বান জানান।
বিশ্বকে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে রক্ষায় শক্তিশালী আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্বের জন্য চার দফা প্রস্তাবও উত্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী। প্রথম প্রস্তাবে তিনি বলেন, প্যারিস চুক্তির কঠোর বাস্তবায়নই জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতির বর্তমান হারকে হ্রাস করার একমাত্র উপায়।
দ্বিতীয় প্রস্তাবে তিনি বলেন, প্যারিস চুক্তির আওতায় সরকারগুলোকে তাদের জাতীয় অবদানকেই কেবল সম্মান জানানো উচিত নয়, তাদের আকাঙ্ক্ষাও যথেষ্ট পরিমাণে বাড়ানো দরকার। জলবায়ু ন্যায়বিচারের ধারণাটি জলবায়ু এবং পৃথিবীর স্বার্থে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী তার তৃতীয় প্রস্তাবে বলেন, প্রযুক্তিতে প্রবেশাধিকারের পাশাপাশি এমডিবি এবং আইএফআইসহ বড় অর্থনীতির দেশগুলোকে (উন্নত দেশগুলো) অর্থের আরও জোরদার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
চতুর্থ প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, লোকসান ও ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টিকে চিহ্নিত করতে এবং মূলধারায় আনতে সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করুন। পরিবর্তনের বিষয়টি সমাধানের জন্য দ্রুত পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, প্রকৃতির বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধে, আমরা কেবল হেরে যাব। আমাদের সমস্ত কর্মকাণ্ড এটাই প্রকাশ করে যে আমরা সচেতনভাবে জরুরি সহযোগিতার মাধ্যমগুলো ধ্বংস করে দিচ্ছি যা আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। কাজেই পৃথিবীকে বাঁচাতে ব্যবস্থা নেয়ার সময় আজই, আগামীকাল নয়।
শেখ হাসিনা আরও বলেন, আজ আমাদের সময়ের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে অবস্থান করছি। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব আমাদের সভ্যতার ক্ষতি করছে, আমাদের গ্রহকে ধ্বংস করছে এবং আমাদের অস্তিত্বকেও হুমকির মুখে ফেলেছে।
জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস, গ্লোবাল সেন্টার অন অ্যাডাপটেশন (জিসিএ)- এর সভাপতি বান কি মুন এবং সিভিএফের সদস্য দেশগুলোর রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানরা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
সিভিএফ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, আমরা, সিভিএফ নেতৃবৃন্দ এবং আমাদের অংশীদারগণ, ২০২০ সালের এনডিসি বর্ধিত সময়সীমার আগে জলবায়ু জরুরি অবস্থা মোকাবেলায় ত্বরিৎ এবং শক্তিশালী বৈশ্বিক পদক্ষেপ নেয়ার জন্য সবাইকে আহ্বান জানিয়েছি।
বাংলাদেশ দ্বিতীয়বারের মতো জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত ফোরামের নেতৃত্বের জন্য নির্বাচিত হয়ে সম্মানিত হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন যে, সিভিএফ বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশের ১ বিলিয়নেরও বেশি লোকের প্রতিনিধিত্ব করে। বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণে অনুল্লেখযোগ্য অবদানের পরেও সিভিএফ দেশগুলোই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে, যোগ করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সভাপতি হিসেবে বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার লক্ষ্যে আমাদের সমর্থন অব্যাহত থাকবে, অর্থায়ন ব্যবস্থাকে ত্বরান্বিত করা এবং জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতার আখ্যানগুলো এবং ক্ষতি এবং ক্ষয়ক্ষতি ইস্যু তুলে ধরাই আমাদের লক্ষ্য হবে।
তিনি আরও বলেন, আমরা জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত বিষয়ে জাতিসংঘে বিশেষ ‘র্যাপোটিয়ার’ নিয়োগ এবং একটি সিভিএফ এবং ভি ২০ যৌথ মাল্টি-ডোনার তহবিল গঠনের ওপরও গুরুত্ব দেব।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ গত ৮ সেপ্টেম্বর ঢাকায় গ্লোবাল সেন্টার ফর অ্যাডাপটেশনের দক্ষিণ এশিয় আঞ্চলিক কার্যালয় খুলেছে। এটি বাংলাদেশের সভাপতির সচিবালয় হিসেবে কাজ করবে এবং এই অঞ্চলে জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতা বাড়াতে দক্ষিণ এশিয়ায় যথাযথ পদক্ষেপে সহায়তা, সাহায্য এবং বিকাশ ঘটাবে।
জার্মান ওয়াচের জলবায়ু পরিবর্তন ঝুঁকি সূচক ২০১৯ অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুপ প্রভাবে অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্থ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ৭ম স্থানে রয়েছে।
‘আমার দেশ এই বর্ষায় বার বার বন্যার মুখোমুখি হচ্ছে যা ফসলের ব্যাপক ক্ষতি এবং বিশাল জনগোষ্ঠীকে বাস্তুচ্যুত করেছে। গত মে মাসে সুপার সাইক্লোন আম্পানের প্রভাব এবং বর্তমান কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে পরিস্থিতি আরও খারাপ আকার নিয়েছে।
রোহিঙ্গা সংকট প্রসংঙ্গে তিনি বলেন, মিয়ানমার থেকে আগত ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে কক্সবাজারে আশ্রয় দেয়ায় তারাও মারাত্মক সামাজিক এবং পরিবেশগত ক্ষয়ক্ষতির কারণ হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে আমরা জলবায়ু সৃষ্ট বিপর্যয় মোকাবেলায় বিভিন্ন প্রশমন ও অভিযোজনমূলক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছি। আমার সরকার ২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট তহবিলের অধীনে নিজস্ব সম্পদ থেকে ৪৩০ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করেছে। সারা বছর দেশজুড়ে লাখ লাখ গাছের চারা রোপণ করা হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, আমাদের বিজ্ঞানীরা লবনাক্ততা, বন্যা এবং খরা প্রতিরোধী ফসল এবং ভাসমান কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন। আমার সরকার অভিযোজনমূলক কাজের জন্য ২০১০ সাল থেকে প্রতি বছর গড়ে ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, জিডিপির ১ শতাংশ ব্যয় করছে।
তিনি বলেন, এবছর আমরা আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করছি। যিনি প্রাকৃতিক দুর্যোগের হুমকিকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন এবং মানুষকে রক্ষার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। আমি অত্যন্ত আনন্দিত যে অনেক সিভিএফ দেশ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে কার্যকরভাবে কাজে লাগাতে সক্ষম হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, কোস্টারিকা প্রতি বছর শতভাগ নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। ইথিওপিয়াতে গত বছর ৪ বিলিয়ন চারা গাছ রোপন করা হয়েছে এবং ২০২৪ সাল নাগাদ ২০ বিলিয়ন গাছ লাগানো হবে।
তিনি বলেন, ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা সত্বেও জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর গভীর ক্ষতি ও ক্ষয়ক্ষতি কমাতে শক্তিশালী আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্ব অপরিহার্য। বিশ্ব প্যারিস চুক্তির ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড উষ্ণতার সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ার দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। এটা সীমানা পেরিয়ে যাওয়ার শেষ সীমা এবং জি-২০ দেশগুলো থেকে যেগুলোর নিঃসৃত কার্বনের পরিমাণ তিন চতুর্থাংশেরও বেশি, আমরা তাদের নির্গমনকে কার্যকরভাবে হ্রাস করার জন্য সুস্পষ্ট এবং সুনির্দিষ্ট এনডিসি আশা করি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধির বর্তমান ধরণ অব্যাহত থাকলে অধিকাংশ দ্বীপ এবং সমুদ্র তীরবর্তী রাষ্ট্র পানির নিচে চলে যাবে ফলে লাখ লাখ মানুষ জলবায়ু শরণার্থী হয়ে পড়বে এবং এদেরকে আশ্রয় দেয়ার সামর্থ বিশ্বের নেই। এটি উপলব্ধি করে, বাংলাদেশ সংসদ একটি ‘প্ল্যানেটারি জরুরি অবস্থা’ ঘোষণা করে এবং বিশ্বকে জলবায়ু পরিবর্তন বন্ধে যুদ্ধের সময়ের মতো করে কাজ করার আহ্বান জানায়। কপ-২৬ স্থগিতাদেশে আমাদের বর্ধিত এনডিসিগুলো ঘোষণা করার সময় এই বছরের ৩১ ডিসেম্বর মধ্যরাতে পড়ে যায়। এটি কার্যত আমাদের ‘বেঁচে থাকার সময়সীমা’।
তিনি বলেন, সিভিএফের পক্ষে, আমরা আজ সিভিএফ চালু করছি ‘জলবায়ুর জন্য মধ্যরাত বেঁচে থাকার সময়সীমা’ উদ্যোগটি প্রতিটি জাতির প্রতিটি নেতাকে এখন নেতৃত্ব প্রদর্শনের অনুরোধ করার জন্য। জাতিসংঘের পাশাপাশি সম্মেলন করে আমরাও ধরিত্রী মাতার সঙ্গে আমাদের সম্প্রীতি সুরক্ষার জন্য একটি আন্তর্জাতিক দিবসকে ‘জলবায়ু রেসিলিয়েন্স ডে’ নামকরণ করার আহ্বান জানাচ্ছি।
সূত্র : বাসস