ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা পূরণ করতে আমাদের দেশের কৃষকেরা উদ্ভাবন করেছেন একটি বিশেষ ভাসমান কৃষি পদ্ধতি। ভাসমান এই কৃষি পদ্ধতিকে ধাপ কৃষি পদ্ধতি বা বেড কৃষি পদ্ধতিও বলে।
ভাসমান এই কৃষি পদ্ধতি শত বছরের পুরনো হলেও গত তিন দশক ধরে এর বিস্তৃতি ঘটেছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। এই পদ্ধতিতে প্রথম চাষাবাদ শুরু হয় বাংলাদেশের শষ্য ভান্ডার বলে খ্যাত বরিশাল অঞ্চলের পিরোজপুর জেলার নিচুভূমি ও বিল অঞ্চলগুলোতে। তারপর দেশের বিভিন্ন জেলার নিম্ন অঞ্চল ,পতিত অঞ্চল, লবনাক্ত অঞ্চল ও হাওর অঞ্চল গুলোতে এই ভাসমান কৃষি পদ্ধতি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। মাটি ছাড়া পানির উপর কচুরীপানা,টোপাপানা ,দুলালী লতা , শ্যাওলা সহ আরও নানান জলজ উদ্ভিদ দিয়ে তৈরী বেডের উপর এই ভাসমান চাষ পদ্ধতিকে বৈজ্ঞানিক ভাবে বলা হয় হাইড্রোপনিক পদ্ধতি।
যেভাবে প্রস্তুত করা হয় ধাপ/ ধাপ প্রস্তুতি:
কচুরীপানা,টোপাপানা ,দুলালী লতা , কলমিলতা ,শ্যাওলা সহ নানান জলজ উদ্ভিদ স্তরে স্তরে সাজিয়ে দুই থেকে তিন ফুট পুরু করে বাঁশ ও দড়ি দিয়ে বেঁধে ধাপ ও ভাসমান বীজতলা তৈরী করা হয়। ধাপ দ্রুত পঁচানোর জন্য সামান্য ইউরিয়া সার ব্যাবহার করা হয়।তারপর ৭-১০ দিন ফেলে রাখা হয় পঁচানোর জন্য। এক একটি ভাসমান ধাপ বেড ৫০-৬০ মিটার ( ১৫০-১৮০ ফুট) লম্বা ও ১.৫ মিটার ( ৫-৬ ফুট) প্রশস্ত এবং প্রায় ১ মিটার(২-৩ ফুট) পুরু বীজতলা তৈরী করা হয়। ধাপগুলো যেন ভেসে না যায় সে জন্য অনেক সময় শক্ত বাঁশের খুঁটির সাথে বেঁধে রাখা হয়। আবার অনেকে চারপাশে চিকন জাল দিয়ে ঘিরে দেন।তারপর সেই ধাপে বিভিন্ন শাক সবজির মেদা বা দৌলা সাজানো চারা বপন করা হয়।
দৌলা বা মেদা কি?
ভাসমান ধাপ পদ্ধতিতে সরাসরি বীজ বপন সম্ভব না। তাই কৃষকরা প্রতিটি বীজের জন্য এক ধরণের আধার তৈরী করেন। এই আধারকে বলা হয় দৌলা বা মেদা।
এক মুঠো আধা পঁচা টোপাপানা বা কচুরিপানা দুলালী লতা দিয়ে পেঁচিয়ে বলের মত গোল করা হয় তারপর তার মধ্যে নারকেলের ছোবড়ার গুড়া দিয়ে দড়ি বা সোটা দিয়ে বেঁধে তৈরী করা হয় দৌলা। এর আগে ভেজা জায়গায় বীজ অঙ্কুরিত করে নেয়া হয়। তারপর দৌলার মধ্যে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে গর্ত করে বিভিন্ন সবজির অঙ্কুরিত বীজ পুঁতে মাচানে বা রাস্তার পাশে শুকনো জায়গায় রাখা হয়। দৌলা গুলো এভাবে ৩-৭ দিন লাইন করে রাখা হয়। ৭-১০ দিন পর সাজানো চারাগুলো ভালোভাবে বেড়িয়ে আসলে সেখান থেকে সরিয়ে ধাপে বসিয়ে দেয়া হয়।
ধাপে চারার যত্ন/ বীজ থেকে চারা জন্মানোর প্রক্রিয়া:
অঙ্কুরিত চারা গুলো ধাপে স্থানান্তরের পর পরিপক্ক চারায় পরিণত হতে সময় লাগে ২০-২২ দিন। তখন ৫-৬ দিন পর পর ভাসমান ধাপের নিচ থেকে নরম কচুরীপানা ও শ্যাওলা টেনে এনে দৌলার গোড়ায় গোড়ায় বিছিয়ে দেয়া হয় ।যেন তা অঙ্কুরিত চারাগুলোকে পুষ্টি সরবরাহ করে পরিপক্ক ও সুস্থ্য চারায় পরিণত হতে সাহায্য করে।তখন প্রতিদিন ধাপে হালকা করে পানি সেঁচ দেয়া হয় যেন চারার গোঁড়া শুকিয়ে না যায় চারাগুলো সতেজ থাকে। এভাবে একমাস পরিচর্যার পর চারা গুলো বিক্রির জন্য উপযোগী হয়।
চারা থেকে ফসল উৎপাদন :
চারাগুলো পরিপক্ক হওয়ার পর ১ সপ্তহের মধ্যে কৃষক ও চারার পাইকারী ব্যবসায়ীরা কিনে নিয়ে যান। তারপর সেই চারা রোপন করা হয় ভাসমান ধাপে। মাটিতে চারা রোপন করলে বৃষ্টির দিনে পানি জমে চারার গোড়া পঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে কিন্তু ভাসমান বেডে সেই ভয় থাকে না। আবার মাটিতে সবজি চাষ করলে প্রচুর সার ও কীটনাশক প্রয়োগ করতে হয় । ভাসমান বেডে তার প্রয়োজন হয় না। কারণ পঁচা কচুরীপানা,দুলালী লতা,কলমি লতা বিভিন্ন ধরণের শ্যাওলা ও অন্যান্য জলজ উদ্ভিদ থেকে চারা গুলো পর্যাপ্ত জৈব সার পেয়ে থাকে। এভাবে সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে লাউ ,মিষ্টি কুমড়া, শশা,টমেটো , লাল শাক,পালং শাক, পুঁই শাক ,কাঁচা মরিচ,ক্যাপসিক্যাম, ধনে পাতা ,করলা ইত্যাদি সহ প্রায় ২৩-২৫ ধরনের শাক সবজি ও মসলা আবাদ করা হয়।
ধাপের পুনঃব্যবহার:
একটি ধাপ সাধারণত তিন মাস ব্যবহারের উপযোগী থাকে। তারপর ধাপগুলো আবার ব্যাবহারের জন্য কিছু পরিবর্তন করতে হয়। অনেক সময় কৃষকেরা ধাপগুলো নিজেরাই সামান্য পরিবর্তন করে স্বল্পজীবী সবজি যেমন লাল শাক,পালং শাক, ধনে পাতা, ফুলকপি,মরিচ ,লেটুস পাতা ইত্যাদি আবাদ করেন। আবার অনেক সময় ধাপগুলো অন্য কৃষকদের কাছে বিক্রি করে দেন।তাছাড়া পানি শুকিয়ে গেলে ব্যবহারের অনুপোযোগী ধাপগুলো মাটির সাথে মিশিয়ে জৈব সার হিসেবে ব্যবহার করা হয়।এতে মাটির উর্বরতা বাড়ে।
ভাসমান চাষ পদ্ধতির আয়-ব্যায়:
সাধারণত ৫০-৬০ মিটারের একটি ভাসমান ধাপ তৈরীতে খরচ হয় ৩-৫ হাজার টাকা।সেই ধাপ থেকে চারা বিক্রি করা যায় ২৫০০-৩০০০ টাকার।১০০ ফুট লম্বা একটি ধাপ তৈরী করতে এবং চারা উৎপাদনে ৫ মাসে ব্যায় হয় ১৫ হাজার টাকা । প্রথমবার ব্যবহৃত ধাপ বিক্রি করা যায় ২ হাজার থেকে ৩ হাজার টাকায়। সব মিলিয়ে কৃষক চাইলে ভাসমান চাষ পদ্ধতি ব্যবহার করে বছরে একর প্রতি দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা আয় করতে পারেন।
জলবায়ু পরিবর্তন জনিত কারণে বাংলাদেশের মানুষ ও বাংলাদেশের কৃষি যে সব বিপর্যয়ের সম্মুক্ষীন হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে আরও যে সব বিপর্যয়ের আশঙ্কা করা হচ্ছে সেই বিপর্যয়ের ফলে খাদ্য ঘাটতি অনেকটাই মোকাবেলা করতে সক্ষম এই ভাসমান চাষ পদ্ধতি। বাংলাদেশে ৪৫ লাখ হেক্টর জলসীমার মধ্যে বা তার অর্ধেক জলসীমাতেও যদি ভাসমান সবজির আবাদ করা যায় তাহলে কৃষিক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্য আসবে। আর বর্ষাকালে যখন পানিতে ডুবে থাকে কৃষি জমি ,খাদ্য ঘাটতি দেখা দেয় দেশ জুড়ে তখন এই ভাসমান চাষ পদ্ধতি হতে পারে দুঃসময়ের পরম বন্ধু। ভাসমান চাষ পদ্ধতিতে আবাদ করে কৃষক বাঁচাতে পারেন নিজেকে , দেশকে এবং দেশের মানুষকে।
ভাসমান পদ্ধতিতে চাষাবাদ করতে যেহেতু রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করা হয় না বললেই চলে তাই এই পদ্ধতিতে চাষাবাদ অনেক সাশ্রয়ী এবং উৎপাদিত খাদ্য অনেক নিরাপদ ।