বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো এক চিঠিতে প্রাইম ব্যাংক ফাউন্ডেশন এসব স্বীকার করে নিয়েছে। ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইকবাল আনোয়ার ও সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার শাহিদুল হক এ চিঠিতে স্বাক্ষর করেন।
এ প্রকল্পে জমি ক্রয়, অর্থ প্রদান ও তার হিসাব প্রক্রিয়ার মধ্যে নানা অনিয়ম পেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। একই সঙ্গে শনাক্ত করেছে নানা ধরনের ঝুঁকি। প্রতিবেদনে দেখা গেছে, স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য পূর্বাচলে ৪৭ কোটি টাকা ব্যয়ে জমি কেনা হয়েছে। জমির দাম কিস্তিতে পরিশোধ করা হলেও ব্যাংক দেখিয়েছে একসঙ্গে টাকা দেয়া হয়েছে । বিলম্ব ফি, অতিরিক্ত টাকা এবং নিবন্ধন ব্যয়সহ এখন পর্যন্ত প্রায় ৫০ কোটি টাকা ব্যয় করেছে ব্যাংক। কর পরিশোধের আগে সিএসআরের অর্থ ব্যয় দেখানোর কোনো সুযোগ নেই। কর পরিশোধের পর প্রকৃত মুনাফা থেকে সিএসআর খাতে অর্থ বরাদ্দ করতে হবে। ব্যাংক তা করেনি। সিএসআর নীতিমালা হালনাগাদ করার নির্দেশ দেয়ার পরও তা করেনি। ডিসেম্বরের মধ্যে সংশোধনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
প্রকল্পটি বিশ্লেষণ করে সিএসআরের অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে কোনো সমন্বয় না পেয়ে বারবার আপত্তি জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপরও তারা প্রকল্পটি এগিয়ে নিচ্ছিল। এ পরিপ্রেক্ষিতে সোমবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে প্রাইম ব্যাংককে চিঠি দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়, সিএসআর খাত থেকে ইংরেজি শিক্ষার স্কুলে কোনো অর্থ ব্যয় করা যাবে না। ৪ কোটি টাকা বেশি দিয়ে জমি কেনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছে, এতে ব্যাংক পরিচালনায় দুর্বলতা ফুটে উঠেছে।
নীতিমালা অনুযায়ী, সিএসআরের অর্থ সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের উপকারে আসে এমন সেবা ও কর্মসংস্থানমূলক খাতে ব্যয় করতে হবে। উচ্চবিত্ত বা মধ্যবিত্তের উপকারে আসে এমন কোনো খাতে ব্যয় করা যাবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ নীতিমালা পাশ কাটিয়ে এ অর্থে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের জন্য ইংরেজি মিডিয়াম স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত নিয়ে এগোয় ফাউন্ডেশন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আপত্তি উপেক্ষার বিষয়ে ব্যাংকটির কাছে ব্যাখ্যা তলব করা হয়। তাদের জবাব সন্তোষজনক বিবেচিত হয়নি। এরপরই আলোচ্য স্কুলটিকে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সন্তানদের কাজে লাগে এমন সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করার নির্দেশ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ সিদ্ধান্তও অগ্রাহ্য করে প্রকল্পটি এগিয়ে নেয়া হয়। এতেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক কঠোর অবস্থান নেয়।
এ ধরনের স্কুল প্রসঙ্গে প্রাইম ব্যাংক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ ব্যাংককে জানিয়েছে, দেশে ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা বেশ ব্যয়বহুল। প্রচলিত মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে ইংরেজিতে দুর্বলতার কারণে আশানুরূপ প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করতে পারছে না। এ কারণে ব্যাংকটি ২০০৮ সাল থেকে ইংরেজি মিডিয়াম স্কুল পরিচালনা করছে। মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত সন্তানদের কথা মাথায় রেখেই এ স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু ভর্তি ফি ও মাসিক বেতনের বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিএসআরের অর্থ সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য বরাদ্দ। এ অর্থে ইংরেজি মাধ্যম স্কুল প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার বিষয়ে প্রাইম ব্যাংকের বক্তব্য কর্পোরেট স্যোশাল রেসপনসিবিলিটির মূল নীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এখনও দেশের বিপুলসংখ্যক শিশু শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অবকাঠামোগত সমস্যা রয়েছে। বেতন দিয়ে পড়ানোর মতো সক্ষমতা নেই এমন পরিবারের সংখ্যা নেহাত কম নয়। আলোচ্য বেতন দিয়ে নিম্নবিত্তের সন্তানদের পড়াশোনা সম্ভব নয়। মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানদের ভালো চাকরির জন্য ইংরেজিতে দক্ষ বানানোর চেয়ে সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য প্রচলিত শিক্ষার একটি ভালোমানের স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হলে তা সমাজ ও অর্থনীতিতে অধিকতর অবদান রাখতে পারত।
জমি কেনার প্রসঙ্গে প্রাইম ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানিয়েছে, স্কুলপ্রতিষ্ঠার জন্য রাজউকের পূর্বাচলে জমি প্রাপ্তির জন্য ২০০৮ সালে আবেদন করলেও তা বিবেচিত হয়নি। পরে পূর্বাচলে ইংরেজি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ার জন্য জমি বরাদ্দ পেয়েছে এমন একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করা হয়। সে অনুযায়ী ব্যাংক বরাদ্দ প্রাপ্ত জমির মূল্য বাবদ রাজউকের দায় পরিশোধ করবে এবং রাজউক নিয়ম অনুযায়ী প্রাথমিক বরাদ্দের ১০ বছর পর জমির মালিকানা ফাউন্ডেশনের নামে হস্তান্তর করবে।
এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রাথমিক বরাদ্দ প্রাপ্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্ল– রিডস স্কুলের পক্ষে এটিএম ওয়াহাবের নামে জমি রেজিস্ট্রি করে দেয় রাজউক। ফলে আগামী ১০ বছর জমিটি ব্যাংকের মালিকানায় আসবে না। এতে ব্যাংক ঝুঁকিতে পড়বে। জমির মালিকানা পেতে ব্যাংক জমির মূল্যের বাইরে স্কুল কমিটিকে ৪ কোটি টাকা দিয়েছে। একটি ব্যাংকের পক্ষে এ ধরনের লেনদেন গ্রহণযোগ্য নয়।
এ বিষয়ে প্রাইম ব্যাংকের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হলে তারা জানায়, স্কুলের নামে আবদুল ওয়াব জমির জন্য আবেদন করেন। সে অনুযায়ী তিনি অনেক চেষ্টা করে ওই জমি পান। আবেদন ফি হিসেবে ১২ লাখ টাকা জমাও দেন। কিন্তু জমি পাওয়ার পর যে পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করতে হবে তার সামর্থ্য না থাকায় তিনি ব্যাংকের হাতে জমির মালিকানা তুলে দেন। তিনি রাজউকের প্রদেয় অর্থের অতিরিক্ত ৫ কোটি টাকা দাবি করলে ব্যাংক প্রস্তাবে রাজি হয়। যদিও ব্যাংক উল্লেখ করেছে, ৪ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে।