গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়, হেফাজতে ইসলামের নেতৃত্ব চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় নিয়ে আসার জন্য নূর হোসাইন কাসেমী ও মামুনুল হক চক্র সক্রিয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে যাতে করে হেফাজতের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব হাটহাজারীর প্রভাবমুক্ত এবং ঢাকা কেন্দ্রিক করা যায়। এটি তাদের সুদূর-প্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ধারণা করা হচ্ছে। হেফাজতের নেতৃত্বে পুরোপুরি দখলে নেওয়ার জন্য আল্লামা শফীপন্থী কোন আলেমকে হেফাজতের নতুন কমিটিতে রাখা হবে না বলে শফীপন্থী আলেমগণ আশঙ্কা করছেন। হেফাজতের নেতৃত্ব ঢাকাকেন্দ্রিক করার মাধ্যমে অরাজনৈতিক ক্বওমী সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের নামের সংগঠনটি জামায়াত দখলে নেওয়ার চেষ্টা করছে। এসব কারণে চট্টগ্রামের সিনিয়র আলেমদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ এবং প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যা ভবিষ্যতে হেফাজতের ভাঙনের কারণ হতে পারে।
ইসলামের হেফাজত এবং ক্বওমীদের স্বার্থ রক্ষায় আল্লামা শফী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হেফাজতে ইসলামের পরিচিতি সারা বিশ্বেই রয়েছে।
আল্লামা শাহ আহমদ শফীর ইন্তেকালের পর জানাযার দিন লক্ষাধিক অনুসারীর মধ্যে জামায়াত-শিবিরের কৌশলী উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মত। জানাযার সার্বিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের নেতৃবৃন্দকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়। এছাড়া, আহমদ শফীর লাশ বহনকারী খাটিয়া জামায়াতের আমীর ও সাবেক এমপি শাহজাহান চৌধুরী, সাবেক শিবির নেতা ও বর্তমান এবি পার্টির সদস্য সচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু, শিবিরের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সালাউদ্দিন আইয়ুবি, শিবিরের সাংস্কৃতিক সম্পাদক আব্দুল আলিমসহ আনুমানিক ৩০/৪০ জন বেষ্টন করে রাখে। বিষয়টি নিয়ে ক্বওমী আলেমসহ সারাদেশের মানুষের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। জানা যায়, মাওলানা মামুনুল হক সুকৌশলে জামায়াত-শিবিরের নেতৃবৃন্দকে সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ করে দিয়ে জামায়াতের সাথে হেফাজতের একটি সেতুবন্ধন তৈরির প্রচেষ্টা চালায়।
আল্লামা শাহ আহমদ শফীর মৃত্যু পরবর্তী হেফাজতে ইসলামের নতুন কমিটি গঠনের জন্য চলতি মাসের মাঝামাঝি সময়ে কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়। ইতোমধ্যে সংগঠনের বর্তমান মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরীর নেতৃত্বে ১৮ সদস্য বিশিষ্ট একটি কাউন্সিল বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করা হয়েছে যাদের অনেকের সরাসরি বিএনপি-জামায়াতের সাথে সংশ্লিষ্টতা ও যোগাযোগ থাকার অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া, প্রায় প্রতিদিনই উক্ত কাউন্সিলের কমিটি গঠনের জন্য বিএনপি-জামায়াত মতাদর্শী হেফাজতের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী, মাওলানা মীর ইদ্রিস, মাওলানা জাকারিয়া নোমান ফয়জী, মাওলানা নাসির উদ্দিন মুনির, মাওলানা জাফর আলম নিয়মিত গোপন বৈঠক করে হেফাজতের কমিটির তালিকা তৈরি করছে। তালিকাটি কাউন্সিলের দিন মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরীকে দিয়ে অনুমোদন করিয়ে উপস্থাপন করা হবে বলে জানা যায়। নতুন কমিটি গঠনের সাথে সংশ্লিষ্ট উল্লিখিত ০৫ জন আলেমই জামায়াত-শিবির মতাদর্শী বলে জনশ্রুতি রয়েছে।
হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ, বাংলাদেশের ক্বওমী মাদ্রাসাভিত্তিক একটি সংগঠন যা ২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সংগঠনটি বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের কথিত ইসলামীবিরোধী ইস্যু নিয়ে আন্দোলন করে আসছে। হেফাজতে ইসলামের মূল শক্তি ক্বওমী মাদ্রাসা এবং মাদ্রাসাগুলো হতে শিক্ষা লাভ করা ক্বওমী আলেম ও শিক্ষার্থীগণ। অপরদিকে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্ব থেকেই ক্বওমী আলেমদের সাথে বিতর্কিত রাজনৈতিক সংগঠন জামায়াতে ইসলামের আক্বীদাগত (আদর্শগত) পার্থক্য বিদ্যমান।
মুক্তিযুদ্ধের সময় হানাদার পাকিস্তানীদের পক্ষ অবলম্বন করায় ক্বওমী আলেমদের সাথে জামায়াত-শিবিরের আরও বেশি দূরত্ব সৃষ্টি হয়। এক্ষেত্রে ক্বওমী আলেমদের গ্রহণযোগ্যতা সমাজে বৃদ্ধি পেতে থাকলেও বিতর্কিত কর্মকান্ড ও মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত হওয়ায় জামায়াতে ইসলামের গ্রহণযোগ্যতা সমাজে কমতে থাকে। বিষয়টি অনুধাবন করতে পেরে জামায়াতে ইসলামী ও তাদের বিতর্কিত ছাত্র সংগঠন ছাত্রশিবির দেশের অন্যতম বৃহত্তম ইসলামী সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ ও ক্বওমী মাদ্রাসাগুলোকে তাদের দখল নেওয়ার জন্য দীর্ঘদিন ধরে পরিকল্পনা করে আসছে। এ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ছাত্রশিবির ১৯৮৫ সালে ক্বওমী অঙ্গনের বৃহত্তম প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসায় আক্রমণ করে মাদ্রাসাটি দখলে নেওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধের মুখে তা ব্যর্থ হয়। এ ঘটনায় তিনজন নিহত এবং শতাধিক আহত হয়। পরবর্তীতে ১৯৮৯ সালে ছাত্রশিবিরের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে তৎকালীন মুহতামিম আল্লামা শাহ আহমদ শফী কর্তৃক ১০ জন ছাত্রকে বহিষ্কার করা হলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রশিবিরের নেতৃত্বে মাদ্রাসায় হামলা হয় যাতে ১০-১৫ জন আহত হয়।
চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসের ১৮ তারিখ আল্লামা শাহ আহমদ শফীর মৃত্যুর পূর্ব থেকে হাটহাজারী মাদ্রাসায় জামায়াতে ইসলামের দোসররা ব্যাপকভাবে আনাগোনা শুরু করে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা যায়। এরই ধারাবাহিকতায় মাদ্রাসার উপর তারা বিভিন্নভাবে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করতে থাকে। পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় বিভিন্নভাবে প্রচার-প্রচারণা চালাতে থাকে। ছাত্রদের সূত্রে জানা যায়, হঠাৎ করে হাটহাজারী মাদ্রাসায় মানবতাবিরোধী অপরাধে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামী দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর ছেলে শামীম সাঈদীর আনাগোনা বৃদ্ধি পায়। হেফাজতের বিতর্কিত নেতা মুফতী হারুন ইজহার ও মাওলানা মামুনুল হকের যাতায়াত বৃদ্ধি পেতে থাকে। মরহুম শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হকের ছেলে মামুনুল হকের স্ত্রীসহ শ্বশুরবাড়ি সম্পর্কীয় অধিকাংশ আত্মীয়-স্বজন জামায়ত-শিবিরের সদস্য বা এর সাথে সংশ্লিষ্ট বলে জনশ্রুতি রয়েছে।