জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর বৃহস্পতিবার জুলাই-নভেম্বর সময়ের যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, এই পাঁচ মাসে ১৯ হাজার ৪৫ কোটি টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে।এই অংক গত ২০১৯-২০ অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২২৬ শতাংশ বেশি। আর পুরো অর্থবছরের চেয়ে ৩২ শতাংশ বেশি।
সঞ্চয় অধিদপ্তরের দুই অর্থবছরের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল ৫ হাজার ৮৪২ কোটি টাকার। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে বিক্রির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৯ হাজার ৪৪ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে পাঁচ মাসে বিক্রি বেড়েছে ১৩ হাজার ২০২ কোটি টাকা। এর আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর পাঁচ মাসে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি হয়েছিল ২১ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা।
এ বছর নভেম্বরে ৩ হাজার ৪০২ কোটি ৫৭ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে, যা আগের বছরের নভেম্বরের চেয়ে দশ গুণেরও বেশি। ২০১৯ সালের নভেম্বরে এ খাত থেকে ৩২০ কোটি ৬২ লাখ টাকা ঋণ নিতে হয়েছিল সরকারকে। আর ২০১৮ সালের নভেম্বরে নিট বিক্রি হয়েছিল ৩ হাজার ৮৩৩ কোটি টাকা।
দেখা যায়, এবার পাঁচ মাসে মোট জমা হয়েছে ৪৬ হাজার ৭৪৩ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র। এর মধ্যে মূল পরিশোধ হয়েছে ২৭ হাজার ৬৯৮ কোটি টাকা, আর মুনাফা পরিশোধ হয় ১৩ হাজার ২৪৮ কোটি টাকা। তবে সঞ্চয় ব্যুরো ও ডাকঘরে যে পরিমাণ জমা হয়েছে, তা থেকে মূল পরিশোধ হয়েছে বেশি। ফলে এ দুই জায়গা থেকে নিট বিক্রি নেতিবাচক হয়েছে। বলতে গেলে নিট বিক্রির পুরোটাই হয়েছে ব্যাংকের মাধ্যমে।
সঞ্চয় অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে মন্ত্রী, সাংসদ, সচিব, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী নির্বিশেষে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ সঞ্চয়পত্র কিনে থাকেন। একক কোনো ব্যক্তি সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা সঞ্চয়পত্রে খাটাতে পারেন। অথবা যৌথ নামে খাটানো যায় এক কোটি টাকা পর্যন্ত। পেনশনধারীরা একক নামে ৫০ লাখের পাশাপাশি যৌথ নামে কিনতে পারেন আরও ১ কোটি, অর্থাৎ মোট দেড় কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র।
আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধের পর যা অবশিষ্ট থাকে, তাকে বলা হয় নিট বিক্রি। ওই অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা থাকে এবং সরকার তা রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নে কাজে লাগায়।
বিনিময়ে সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের প্রতি মাসে সুদ দিতে হয়। এ কারণে অর্থনীতির পরিভাষায় সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রিকে সরকারের ‘ঋণ’ বা ‘ধার’ হিসেবে গণ্য করা হয়।
সঞ্চয়পত্র বিক্রির লাগাম টানতে গত ৩ ডিসেম্বর থেকে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নতুন সীমা নির্ধারণ করে দেয় সরকার। এখন একক নামে ৫০ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনতে পারছেন না কেউ। যৌথ নামে এক কোটি টাকার বেশি কেনা যাচ্ছে না।
তাছাড়া গত বছরের ১ জুলাই থেকে সঞ্চয়পত্রে মুনাফার ওপর উৎসে করের হার পাঁচ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়। এক লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনতে টিআইএন (কর শনাক্তকরণ নম্বর) বাধ্যতামূলক করা হয়। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট না থাকলে সঞ্চয়পত্র বিক্রি না করার শর্তারোপ করা হয়। এতভাবে চেষ্টা করার পরও সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণ বাড়ছে।
অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জায়েদ বখত বলেন, মহামারীর মধ্যে অর্থ সঙ্কটে পড়ে অনেকে যেখানে লোকসান দিয়ে মেয়াদ পূর্তির আগেই সঞ্চয়পত্র ভাঙ্গাচ্ছেন, তারপও কীভাবে নিট বিক্রি ক্রমাগত বাড়ছে, তা তার কাছে স্পষ্ট নয়।
“এমনটা হতে পারে যে, বেশি সুদ পাওয়ায় যার কাছে যা সঞ্চয় আছে তা দিয়ে সবাই নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে সঞ্চয়পত্র কিনছে। আবার এই যে বেশি বেশি রেমিটেন্স আসছে, তার একটি অংশও সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ হতে পারে।”
এ পরিস্থিতিতে সরকারের ভবিষ্যৎ ঋণের বোঝা কমাতে পেনশনার ও পরিবার সঞ্চয়পত্র ছাড়া অন্য সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোর পরামর্শ দিচ্ছেন জায়েদ বখত।
বাজেট ঘাটতি মেটাতে গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে ২৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ধরেছিল সরকার। বিক্রি কমায় বছরের মাঝামাঝিতে এসে সেই লক্ষ্য কমিয়ে ১১ হাজার ৯২৪ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়।
কিন্তু জুন মাসে অস্বাভাবিক বিক্রির কারণে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের পরিমাণ অর্থবছর শেষে ১৪ হাজার ৪২৮ কোটি ৩৫ লাখ টাকায় গিয়ে ঠেকে।২০১৬-১৭ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে ৫২ হাজার ৪১৭ কোটি ৪৮ লাখ টাকা ঋণ করতে হয়েছিল সরকারকে, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।