সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের সর্বোচ্চ আসনে বসা সম্মানিত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আসা এ ধরনের অভিযোগ গোটা শিক্ষক সমাজের জন্য বিব্রতকর। যারা আলোকবর্তিকা হয়ে সমাজকে আলোর পথ দেখাবে তাদের যদি বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হয়, তার চেয়ে অসম্মানজনক কাজ আর কী হতে পারে? এসব ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধ হচ্ছে না মনে করেছেন তারা।
মধ্যরাতে ক্যাম্পাস ত্যাগ হাবিপ্রবি উপাচার্যের আগামী মাসে দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালেয়র (হাবিপ্রবি) উপাচার্য ড. মু. আবুল কাসেমের মেয়াদ শেষ হবে। তার আগেই মঙ্গলবার (১২ জানুয়ারি) মধ্যরাতে পরিবার নিয়ে ক্যাম্পাসের উপাচার্য বাসভবন ত্যাগ করে ঢাকায় চলে গেছেন তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, আগামী ২ ফেব্রুয়ারি তার মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা। এর আগেই উত্তপ্ত পরিস্থিতি বিরাজ করছিল ক্যাম্পাসে। এর মধ্যে প্রধান বিষয় ছিল করোনাকালে উপাচার্য তার কার্যালয়ে না আসা এবং কারও সঙ্গে কথা না বলা। এছাড়া নিয়োগ, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে বৈরী আচরণ, ক্লাস-পরীক্ষা চালুসহ বিভিন্ন দাবি তুলে মঙ্গলবার দিনভর উপাচার্যের বাসভবনের ভেতর দিনভর অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন শতাধিক শিক্ষার্থী। তবে রাত ৮টার পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক বিধান চন্দ্র হালদারকে উপাচার্যের চলতি দায়িত্ব দিয়ে গভীর রাতে ক্যাম্পাস ছাড়েন তিনি।
উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থানরত ছাত্রলীগ নেতা রিয়াদ খান বলেন, আবাসিক হল সংকট, যানবাহন সংকট, শিক্ষক স্বল্পতা রয়েছে বিভিন্ন বিভাগে। তিনি এখানে আসার পর থেকেই শিক্ষক, কর্মচারী, কর্মকর্তা ও ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে গ্রুপিং সৃষ্টি করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়কে তিনি পিছিয়ে দিয়েছেন।
রেজিস্ট্রার প্রফেসর ডা. ফজলুল হক জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীর স্বল্পতার কারণে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে ভিসি দীর্ঘদিন থেকেই এসব নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ রেখেছেন। চাকরিপ্রার্থীরা তাকে নিয়োগের জন্য চাপ দিলেও শিক্ষকরা কোনো চাপ দেননি বলে তিনি দাবি করেন।
গোপনে ক্যাম্পাস ত্যাগ বেরোবি উপাচার্যের দীর্ঘদিন পর শুক্রবার (১৫ জানুয়ারি) হঠাৎ ক্যাম্পাসে এসে কিছুক্ষণ অবস্থানের পর শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে গোপনে ক্যাম্পাস ছেড়ে ঢাকায় চলেন গেছেন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ।
জানা যায়, ক্যাম্পাসে উপাচার্য আসার খবর পেয়ে তৎক্ষণাৎ তার বাসভবনের সামনে অবস্থান নেয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকতা ও কর্মচারীদের সমন্বিত সংগঠন অধিকার সুরক্ষা পরিষদের নেতা কর্মীরা। শিক্ষকদের অভিযোগ, উপাচার্য তাদের আসার খবর পেয়ে বাসভবনের পেছনের দরজা দিয়ে ক্যাম্পাস ছেড়েছেন। এ ঘটনায় শিক্ষক-কর্মকর্তা ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
পরে উপাচার্যের দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ করার কথা জানিয়ে অধিকার সুরক্ষা পরিষদের আহবায়ক অধ্যাপক ড. মতিউর রহমান বলেন, দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত অবস্থান করার পর জানা যায় নাজমুল আহসান কলিম উল্লাহ শিক্ষকদের আসার খবর পেয়ে বাসভবনের পেছন গেট দিয়ে গোপনে পালিয়ে গেছেন। আমরা এক সপ্তাহের মধ্যে ভিসির অনিয়ম-দুর্নীতি ও লুটপাটের সব ফিরিস্তির শ্বেতপত্র প্রকাশ করবো।
খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের ‘পরিবারপ্রীতি’
অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় পরিবারের সদস্যদের নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক শহীদুর রহমান খানের বিরুদ্ধে। তিনি নিজের ছেলেকে অ্যাডহক ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেকশন অফিসার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। মেয়েকে নিয়োগ দিয়েছেন শিক্ষক হিসেবে। অধ্যাপক পদে তার স্ত্রীও এই বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ পেতে আবেদন করেছেন। তবে এ নিয়োগের প্রক্রিয়া স্থগিত করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
শুধু উপাচার্যের পরিবারের সদস্য নয়, নতুন প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য নিয়োগ নিয়েও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয়টির নীতিনির্ধারণী ফোরাম সিন্ডিকেটের পাঁচজন সদস্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখার আবেদন জানিয়েছেন। চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা পেয়ে তদন্ত শুরু করেছে ইউজিসি তিন সদস্যের একটি কমিটি। কমিটির আহ্বায়ক ইউজিসির সদস্য বিশ্বজিৎ চন্দ বলেন, তথ্য সংগ্রহের কাছ চলছে। তাঁরা প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটন করে প্রতিবেদন দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
রাবি ভিসির দুর্নীতি ও ছাত্রলীগের অবস্থান শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালার বিধি পরিবর্তন করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এম আব্দুস সোবহানের মেয়ে ও জামাতাকে দেওয়া নিয়োগ কেন অবৈধ ও বাতিল হবে না তা জানতে চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। একইসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ধরনের নিয়োগ বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। গত ১০ ডিসেম্বর এ সংক্রান্ত ১২টি চিঠি পাঠিয়েছে মন্ত্রণালয়। এর আগে ইউজিসি এ নিয়ে একটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় মন্ত্রণালয়ে।
এদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগের জেরে গত সোমবার (১১ জানুয়ারি) রাতভর উপাচার্য বাসভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ দেখায় শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মী ও চাকরিপ্রার্থীরা। পরে মঙ্গলবার (১২ জানুয়ারি) সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করে তারা। আন্দোলনকারীদের অন্যতম রাবি শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি ইলিয়াস হোসেন জানান, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ‘প্রশাসনিক’ কারণ দেখিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় নিয়োগ কার্যক্রম বন্ধ রেখেছেন। সেই ‘প্রশাসনিক’ কারণটা কি? আমরা তার স্পষ্ট ব্যাখ্যা চাই। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য যদি দুর্নীতি করে থাকেন, তাহলে তার দুর্নীতির কেন বিচার হচ্ছে না? একজন দুর্নীতিবাজ উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয় দায়িত্বে থাকতে পারেন না। অথচ উপাচার্য দায়িত্বে আছেন কিন্তু নিয়োগ কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় কেন এটা করেছে আমরা তার ব্যাখ্যাও দাবি করছি।
নোবিপ্রবি সাবেক উপাচার্যের অনিয়মের তথ্য চেয়ে ইউজিসির চিঠি
নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (নোবিপ্রবি) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম ওয়াহিদুজ্জামানের দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগের বিষয়ে তথ্য-প্রমাণাদি চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় রেজিস্ট্রারকে চিঠি দিয়েছে ইউজিসি। গত সপ্তাহে কমিশনের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ম্যানেজমেন্ট বিভাগের উপ-পরিচালক ও সংশ্লিষ্ট তদন্ত কমিটির সদস্য সচিব মো. আমিরুল ইসলাম শেখ স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক স্মারকের মাধ্যমে নোবিপ্রবির সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম অহিদুজ্জামানের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের বিষয়ে নিম্নলিখিত তথ্য প্রমাণাদি (সংশ্লিষ্ট কাগজপত্রের প্রতি পৃষ্ঠায় স্বাক্ষর ও তারিখসহ) সংযুক্ত করে আগামী ৭ কর্মদিবসের মধ্যে ইউজিসি সদস্য প্রফেসর ড. মো. আবু তাহের বরাবর গোপনীয়তার সঙ্গে (সীলগালাসহ) প্রেরণ করার জন্য অনুরোধ করা হলো।
উপাচার্যদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, সেচ্ছাচারিতা ও প্রশাসনিক অনিয়মের অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ইউজিসি সদস্য প্রফেসর ড. মুহাম্মদ আলমগীর বলেন, এ ধরনের সুনির্দ্দিষ্ট অভিযোগ আসলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের তদন্ত করতে বলা হয়। তখন আমরা তদন্ত করে যা পাওয়া যায় তার প্রতিবেদন আকারে মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। এরপর ব্যবস্থা গ্রহণ করার দায়িত্ব মন্ত্রণালয়ের। এখানে ইউজিসির করা আর কিছু করার থাকে না। শিক্ষা মন্ত্রণালয় যদি সঠিক ব্যবস্থা না নিয়ে থাকে, তাহলে এ ধরনের ঘটনা ঘটতেই থাকবে।
খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) সাবেক এই উপাচার্য বলেন, এ ধরনের ঘটনায় আমরাও বিব্রত। এটা গোটা শিক্ষক সমাজের জন্য একটা অসম্মানজনক কাজ। আমরা খুবই হতাশ যে, উপাচার্যদের বিরুদ্ধে কেন এ ধরনের অভিযোগ আসবে? তারা তো আলোকবর্তিকা এবং সমাজকে আলো দেখাবে। সুতরাং তারা কেন অনিয়ম করবে? তাদের কেন বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করা হবে? তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করবো আমরা কেউ কখনও ভাবেনি।