এতে দেখা গেছে, শীর্ষ একটি নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান নন-অডিট বিভাগের কর্মীদের মাধ্যমে এক কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন প্রস্তুত করে দেয়। আবার এ নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানেরই নিরীক্ষা বিভাগের কর্মীরা গিয়ে ওই আর্থিক প্রতিবেদন প্রত্যয়ন করেছে।
কোনো প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের তৈরি করা আর্থিক প্রতিবেদন প্রচলিত আইন, বিধিবিধান ও আন্তর্জাতিক নিরীক্ষা মান অনুসরণ করে তৈরি করা হয়েছে কিনা, তা প্রত্যয়ন করাই নিরীক্ষকের দায়িত্ব। পাশাপাশি আর্থিক প্রতিবেদনে কোনো ধরনের অসংগতি আছে কিনা, সেটি খতিয়ে দেখাও নিরীক্ষকের কাজের মধ্যে পড়ে।
তবে নিরীক্ষকদের এ ধরনের অনৈতিক চর্চা নতুন নয়। ক্রিসেন্ট গ্রুপের ঋণ কেলেঙ্কারি থেকে শুরু করে সম্প্রতি আলোচনায় উঠে আসা সিলভার কম্পোজিট টেক্সটাইল মিলসের আর্থিক প্রতিবেদন জালিয়াতিসহ এ ধরনের অসংখ্য আর্থিক অপরাধের সঙ্গী হয়েছেন নিরীক্ষকরা, যা নিরীক্ষকদের পেশাদারিত্বকে প্রশ্নের মুখে ফেলছে। এতদিন এসব ঘটনা আড়ালে থাকলেও সম্প্রতি নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর কড়া নজরদারির কারণে বেরিয়ে আসছে অনেক কিছুই।
দেশের হিসাব ও নিরীক্ষা চর্চা উন্নয়নের লক্ষ্যে ২০১৬ সালে গঠিত হয় ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল। এর পর থেকেই কোম্পানিগুলোর আর্থিক জালিয়াতি এবং এর সঙ্গে জড়িত নিরীক্ষকদের ওপর নজরদারি জোরালো হয়েছে। সংস্থাটি স্ব-উদ্যোগে অন্যান্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন কোম্পানির আর্থিক জালিয়াতি রোধ এবং নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান ও নিরীক্ষকদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার উদ্যোগ নিয়েছে।
এরই মধ্যে বেশকিছু কোম্পানি ও নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম উদঘাটন করেছে এফআরসি। সম্প্রতি সিলভার কম্পোজিট টেক্সটাইল মিলসের পক্ষ থেকে একই নিরীক্ষকের প্রত্যয়ন করা দুই ব্যাংকের কাছে দুটি ভিন্ন আর্থিক প্রতিবেদন জমা দেয়ার বিষয়টি ধরা পড়েছে এফআরসির তদন্তে। এরই মধ্যে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে চিঠি দিয়েছে সংস্থাটি। পাশাপাশি সংস্থাটির প্রয়োগ বিভাগও এ বিষয়ে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবে।
এর আগে গত বছর অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় বহির্নিরীক্ষক নিয়োগের কারণে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ওষুধ খাতের একটি কোম্পানির নিরীক্ষাকাজ সম্পাদনের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও পূর্ণ পেশাদারির অভাব থাকায় সংশ্লিষ্ট নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানকে কঠোরভাবে সতর্ক করেছে এফআরসি। কেবল এ দুটি নয়, নিরীক্ষাকাজে এ ধরনের আরো অনেক অনিয়মেরই তদন্ত করছে এফআরসি।
দেশের আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মধ্যে ব্যাংক ও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রক সংস্থা হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। বীমা খাতের নিয়ন্ত্রকের দায়িত্বে রয়েছে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। সরকারের রাজস্ব আহরণ কার্যক্রমের দায়িত্বে থাকা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডও (এনবিআর) ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক কার্যক্রমের ওপর নজরদারি করে। আর নিবন্ধনকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে দেশে কার্যরত সব কোম্পানির নিয়ন্ত্রক হিসেবে রয়েছে দ্য রেজিস্টারার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মস (আরজেএসসি)। ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে কাজ করছে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ)। এ নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর আওতাধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আর্থিক প্রতিবেদন নিরীক্ষার কাজ করছে দেশের নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। এছাড়া পেশাদার নিরীক্ষকদের সংগঠন দ্য ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশও (আইসিএবি) এক্ষেত্রে স্ব-নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে কাজ করছে। এতগুলো নিয়ন্ত্রক সংস্থার নজরদারির মধ্যে থাকা সত্ত্বেও এতদিন নিরীক্ষকরা অনিয়ম করেও একপ্রকার ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিলেন। তবে এফআরসি গঠনের পর নিরীক্ষকদের ওপর নজরদারি জোরালো হয়েছে।
এফআরসির পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকও বিভিন্ন আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা তদন্ত করছে। তদন্ত করতে গিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক দেখতে পায়, এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক প্রতিবেদন নিরীক্ষার দায়িত্বে থাকা নিরীক্ষকদের দায় কোনো অংশেই কম নয়। নিরীক্ষকরা যদি এক্ষেত্রে তাদের ওপর অর্পিত পেশাগত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতেন তাহলে অনেক কেলেঙ্কারির ঘটনা আরো আগেই চিহ্নিত করা সম্ভব হতো বলে মনে করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ভুয়া রফতানি বিলের মাধ্যমে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক থেকে ক্রিসেন্ট গ্রুপের ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় রফতানির অর্থ দেশে না এলেও নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান সাইফুল শামসুল আলম অ্যান্ড কোম্পানি এবং আজিজ হালিম খায়ের চৌধুরী রফতানির বিল এসেছে বলে সার্টিফিকেট দিয়েছিল। এ ঘটনা ধরা পড়ার পর সাইফুল শামসুল আলম অ্যান্ড কোম্পানিকে ২০১৮ সালে জনতা ব্যাংকের নিরীক্ষক হিসেবে পুনর্নিয়োগের অনুমোদন দেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি তিন বছর নগদ সহায়তা এবং দুই বছর সাধারণ অডিট কার্যক্রম থেকেও তাদের নিষিদ্ধ করা হয়। এছাড়া বহির্নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠান এসএফ আহমেদ অ্যান্ড কোম্পানির বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
সম্প্রতি বিভিন্ন ধরনের অনিয়মের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক ৩৬টি নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিরীক্ষার জন্য অযোগ্য ঘোষণা করেছে। প্রথমবারের মতো এত বেশিসংখ্যক নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
অযোগ্য ঘোষিত নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আলোচ্য তিন প্রতিষ্ঠান ছাড়াও রয়েছে মাহফেল হক অ্যান্ড কোম্পানি, শফিক বসাক অ্যান্ড কোম্পানি, আহমেদ অ্যান্ড আখতার, আহমেদ মাসুক অ্যান্ড কোম্পানি, আতা খান অ্যান্ড কোম্পানি, পিনাকী অ্যান্ড কোম্পানি, মালেক সিদ্দিকী ওয়ালী, সিরাজ খান বসাক অ্যান্ড কোম্পানি, এ মতিন অ্যান্ড কোম্পানি, কে এম আলম অ্যান্ড কোম্পানি, আর্টিসান, এ হক অ্যান্ড কোম্পানি, ফেমস অ্যান্ড আর, হুদা হোসাইন অ্যান্ড কোম্পানি, রহমান আনিস অ্যান্ড কোম্পানি, এ বি সাহা অ্যান্ড কোম্পানি, ইসলাম জাহিদ অ্যান্ড কোম্পানি, মিজান ইসলাম অ্যান্ড কোম্পানি, খান আইয়ুব, শফিক মিজান রহমান অ্যান্ড অগাস্টিন, হাবিব সরোয়ার ভূঁইয়া অ্যান্ড কোম্পানি, রহমান কাসেম অ্যান্ড কোম্পানি, জে আর চৌধুরী অ্যান্ড কোম্পানি, মোহাম্মাদ আতা করিম অ্যান্ড কোম্পানি, আখতার আমির অ্যান্ড কোম্পানি, নুরুল আজিম অ্যান্ড কোম্পানি, দেওয়ান নজরুল ইসলাম অ্যান্ড কোম্পানি, আহসান জমির অ্যান্ড কোম্পানি, আশরাফ উদ্দিন অ্যান্ড কোম্পানি, বখতিয়ার হুমায়ুন অ্যান্ড কোম্পানি, আশরাফুল হক নবী অ্যান্ড কোম্পানি এবং রহমান মুস্তাফিজ হক অ্যান্ড কোম্পানি।
২০১৭ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের তৈরি যোগ্য নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের তালিকা হালনাগাদের সময় আলোচ্য ৩৬ প্রতিষ্ঠান বাদ পড়ার পর বর্তমানে এ তালিকায় রয়েছে ৪১টি প্রতিষ্ঠান। এ তালিকায় আহসান মঞ্জুর অ্যান্ড কোম্পানি এবং চৌধুরী ভট্টাচার্য অ্যান্ড কোম্পানিকে নতুন করে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর আর্থিক প্রতিবেদন নিয়েও অভিযোগের শেষ নেই। অনেক ক্ষেত্রেই কোম্পানিগুলোর গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক তথ্য নিরীক্ষক কর্তৃক কোয়ালিফাই না করার অভিযোগ রয়েছে। আবার এ-সংক্রান্ত বেশকিছু ঘটনা বিএসইসির তদন্তেও উদঘাটিত হয়েছে। তার ওপর প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে কোম্পানি ও ইস্যু ব্যবস্থাপকদের সঙ্গে যোগসাজশের মাধ্যমে আর্থিক তথ্য-উপাত্ত অতিরঞ্জিত করার উদাহরণও রয়েছে।
২০১৯ সালে আইপিওর মাধ্যমে পুঁজিবাজারে আসা কপারটেক ইন্ডাস্ট্রিজের আর্থিক প্রতিবেদনে অসংগতির সঙ্গে এর নিরীক্ষক আহমদ অ্যান্ড আখতারের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়। এজন্য নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানটির একমাত্র পার্টনারের প্র্যাকটিসিং লাইসেন্স নবায়ন করেনি আইসিএবি। এর ফলে প্রতিষ্ঠানটি নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার যোগ্যতা হারায়। প্রতিষ্ঠানটিকে অডিটর প্যানেল থেকেও বাদ দেয় বিএসইসি।
গত বছরের মে মাসে অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের নেতৃত্বে বিএসইসির নতুন কমিশন দায়িত্ব নেয়ার পর আর্থিক অপরাধের সঙ্গে নিরীক্ষকদের সংশ্লিষ্টতার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার কার্যক্রমে গতি পায়। এরই মধ্যে আইপিওর আবেদন করা আল ফারুক ব্যাগস লিমিটেডের প্রসপেক্টাসের অসংগতির কারণে নিরীক্ষক আর্টিসান চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টকে ২ লাখ টাকা জরিমানা করে বিএসইসি। আইন ভঙ্গ করে আরএন স্পিনিংয়ের নগদ লেনদেনের বিষয়টি আর্থিক প্রতিবেদনে উল্লেখ না করার কারণে নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান আতিক খালেদ চৌধুরী চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টসকে পুঁজিবাজার-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নিরীক্ষা কার্যক্রম থেকে তিন বছর নিষিদ্ধ করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের অযোগ্য ঘোষিত ৩৬ নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিএসইসির প্যানেলভুক্ত ১৪ প্রতিষ্ঠানও রয়েছে।
তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর আর্থিক প্রতিবেদন প্রচলিত আইন, বিধিবিধান ও আন্তর্জাতিক নিরীক্ষা মান অনুসরণ করে তৈরি করা হয়েছে কিনা এবং আর্থিক প্রতিবেদনে কোনো ধরনের অসংগতি আছে কিনা, সেটি খতিয়ে দেখে থাকে বিএসইসির করপোরেট ফাইন্যান্স বিভাগ। পাশাপাশি নিরীক্ষক তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে অনুসরণ করেছেন কিনা, সেটিও ওই বিভাগের কার্যপরিধির মধ্যে পড়ে।
পেশাদার হিসাববিদদের সংগঠন আইসিএবিও পেশাগত উন্নয়ন এবং আর্থিক প্রতিবেদন জালিয়াতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি জাল আর্থিক প্রতিবেদন শনাক্ত করার জন্য ডকুমেন্ট ভেরিফিকেশন সিস্টেম (ডিভিএস) প্রবর্তন করেছে। এরই মধ্যে সিস্টেমটি ব্যবহারের জন্য এনবিআর ও এফআরসির সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে আইসিএবি। এ সিস্টেমের মাধ্যমে খুব সহজেই আইসিএবির সনদপ্রাপ্ত নিরীক্ষকদের মাধ্যমে আর্থিক প্রতিবেদন প্রত্যয়ন করা হয়েছে কিনা সেটি জানা যাবে। তাছাড়া সংগঠনটি হিসাব ও নিরীক্ষাসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সব ধরনের গাইডলাইন ও স্ট্যান্ডার্ডের বিষয়ে তাদের সদস্যদের আপ টু ডেট রাখতে সদস্যদের জন্য সেমিনারসহ প্রচার-প্রচারণার উদ্যোগ নিয়েছে।