নিজের পরিচয়ে বেড়ে ওঠার স্বপ্ন থেকেই গল্পের শুরুটা। যখন সে নবম শ্রেণীতে পড়ে তখনেই কিছু একটা কাজ করার চিন্তা তার মাথায়। তখন থেকেই অনেক কিছু নিয়ে রিসার্চ শুরু করে। তখন অনেক ধারণাও পায় সে।কখনো ভাবলো হাতের তৈরী বিভিন্ন জিনিস তৈরি করবে, কখনোবা অনলাইন বিজনেস,কখনো কখনো ফ্রিল্যান্সিং করার ভাবনা তার মাথায় আসলো। কিন্তু কোনোটাতেই মন টিকে নি তার। আগে থেকে তার উৎপাদন বিষয়টা ভালো লাগতো। সেই সূত্রে স্থানীয় এক বড় ভাইয়ের পরামর্শে পরবর্তীতে কৃষিতে নেমে পড়ে।
ফারিয়া বলছিলেন, ‘২০১৯ সালের আগস্টের দিকে আমার এলাকার একজন বড় ভাইয়ের সাথে সবজি চাষ নিয়ে একদিন কথা হয়। তিনি সে বছর ব্রকলি চাষ করবেন বলে জানায়। তো তার কাছে প্রাথমিক ভাবে জেনে ইন্টারনেট রিসার্চ করে আমিও সিদ্ধান্ত নিলাম ব্রকলি চাষ করবো। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সে বার ২০ শতক জমিতে ব্রকলি চাষ করেছিলাম। তখন থেকেই শুরু আমার কৃষি যাত্রার। এরপর আরও বিভিন্ন সবজি চাষ করেছি।’
এই কিশোরী বলেন,‘এ বছর (২০২০-২০২১) ২০০ শতক জমিতে শীতকালীন বিভিন্ন সবজি চাষ করেছি। ব্রকলি, স্কোয়াশ, রেড ক্যাবেজ এবং অল্প অল্প করে লেটুস বিটরুটও করেছি। শীতকালীন সবজি শেষ। এখন ২১০ শতক জমি তে গ্রীষ্মকালীন আগাম বিভিন্ন সবজি চাষ করার প্রস্তুতি চলছে।’
পরিবারের কেউ কৃষিকাজের সাথে সরাসরি যুক্ত না জানিয়ে নেত্রকোনা সরকারি মহিলা কলেজে পড়ুয়া এই কিশোরী আরও বলেন,‘আমি ছোট থেকে কৃষিকাজ দেখে বড় হই নি। কারণ শহরেই আমার জন্ম এবং বেড়ে উঠা। সেইক্ষেত্রে গুগল রিসার্চ করে এবং বিভিন্ন জনের পরামর্শ নিয়ে চাষাবাদ করে আমি যে সবজি ফলন ফলাতে পারছি আমার কাছে এটাই আমার সফলতা। আর আমার ফলনই আমার উপার্জন। ’
কৃষি কাজে আসার অনুপ্রেরণা কথা বলতে গিয়ে ফারিয়া বলেন,‘আমার অনুপ্রেরণা আমি আসলে নিজেই। নিজের ইচ্ছাশক্তি থাকলে সব সম্ভব। পরিবার থেকে কোনো নিষেধ ছিল না। বরং পরিবার সব বিষয়ে সাহায্য করেছে। আমার সফলতায় তারা খুশি হয়, আমার ব্যর্থতায় তারা ব্যথিত হয়। আমার পরিবার আমার স্বপ্নের মাঝে কখনো বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় নি।’
এই কিশোরী আরও বলছিল,‘ এই কাজ করতে গিয়ে সমালোচনা যদি আমার পেছনে হয়ে থাকে সেটা তো আর আমি জানি না। তবে আমার চেনা জানা অনেকে বলেছে তোমার পরিবার তো বেশ স্বচ্ছল। তোমার পারিবারিক অবস্থা তো ভালো। তোমার তো টাকা পয়সার দরকার নেই। পড়াশুনা করে বড় হয়ে এ্যাডভোকেট হবা।কৃষি কাজে আসলা কেন।’
ফারিয়ার কৃষির কাজে অনেকের কর্মসংস্থানও হয়েছে। সেই সম্পর্কে বলে,‘এ ব্যাপারটা বেশ আনন্দের। প্রথম যখন আমি ২০ শতক জমি লিজ নিয়ে কৃষিকাজ শুরু করি। তখন আমি একাই কাজটা করি। কিন্তু এখন আমার চাষবাস ২০০ শতক জমি নিয়ে। তাই জমি সার্বক্ষনিক দেখাশোনা করার জন্য লোক নিয়েছি। এছাড়া সবজি উৎপাদন ও সবজি চাষবাস করার সময় আরো লোক নিয়োগ দেয়া হয়। তখন হয়তো ছয়-সাত জন জমিতে নিয়মিত কাজ করে। এতে কর্মসংস্খান পেয়ে তাদের উপকার হচ্ছে।’
চাষাবাদ সম্পর্কে ইন্টারনেট থেকে পড়াশোনা করেছে জানিয়ে ফারিয়া বলেন,‘এখন যুগ অনেক পাল্টেছে আমরা চাইলেই যে কোনে মূহুর্তে ইন্টারনেট থেকে সব তথ্য জানতে পারি। আমিও ইন্টারনেট থেকে তথ্য সংগ্রহ করেই কৃষিকাজে নামি। তারপর একটা বাস্তব জ্ঞান লাগে সেটা জেনেছি চুয়াডাঙ্গার সদর উপজেলার কৃষি অফিসার রাসেল ভাই থেকে। তিনি আমাকে বিভিন্ন সময় নানা বিষয়ে সাহায্য করেছে।’
ভবিষ্যত পরিকল্পনা জানতে চাইলে ফারিয়া বলেন, ‘অসংখ্য কৃষক কৃষি বিমুখ হয়ে যাচ্ছে। যার অন্যতম প্রধান কারণ হলো নায্যমূল্য না পাওয়া। পাশাপাশি আরও অনেক কারণ রয়েছে। আগাম চাষে ভালো মূল্য পেলেও সেই সময়টা খুবই অল্প। আর এই যে কৃষকরা কৃষি থেকে বিমুখ হয়ে যাচ্ছে এটা আমাদের দেশের জন্য খুবই হুমকিস্বরূপ। তো সেই জায়গা থেকে কৃষকরা যেন কৃষি বিমুখ না হয়ে উৎসাহ নিয়ে কাজ করতে পারে এবং উন্নত এবং জৈব কৃষি নিয়ে কাজ করতে পারে সেগুলো নিয়ে ভবিষ্যতে কাজ করার ইচ্ছে আছে।’
এই কিশোরী আরও বলেন,‘আরেকটা ইচ্ছে আছে আমার। সেটা হচ্ছে আমরা অনেকেই যেমন ছোট থেকে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হতে চাই বা একটা ভালো চাকরি করবো। এরকম মন মানসিকতা থাকে তেমন আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন ছোট থেকেই এমন ভাবতে পারে যে বড় হয়ে আমি একজন কৃষক হতে চাই। কৃষিটাকে যেন সেই জায়গায় নিয়ে যাওয়া যায় আমি সেই লক্ষ্যে কাজ করতে চাই। ’