তবে সম্প্রতি করোনা রোগী বাড়তে শুরু করায় আবার পুঁজিবাজার বন্ধ ঘোষণা করা হতে পারে বলে কিছুদিন থেকেই গুজব ছড়ানো হচ্ছে। পুঁজিবাজার বন্ধ ঘোষণার গুজবের মধ্যে বর্তমানে বাজারের শেয়ারের মূল্য সূচক ও লেনদেন কিছুটা কমতে শুরু করেছে।
শনিবার (৩ এপ্রিল) পুঁজিবাজার বন্ধ ঘোষণার গুজবের বিষয়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল- ইসলাম অর্থসংবাদ’কে বলেন, মানি মার্কেট খোলা থাকলে পুঁজিবাজারও খোলা থাকবে। বিনিয়োগকারীরা যাতে পেনিক না হয়, সে জন্য আমরা বিএসইসি থেকে আগে থেকেই আমাদের অবস্থান পরিষ্কার করে দিয়েছি।
আজ রোববারও (১১ এপ্রিল) ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) সূচকের কিছুটা পতন হয়েছে।
এর আগে গত বছরের ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনারোগী চিহ্নিত হওয়ার পর দেশের দুই পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারী, ব্রোকারেজ হাউজ এবং তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোতে শুরু হয় অস্থিতিশীল পরিবেশ। করোনা সংক্রমণরোধে সরকার ঘোষণা দেয় সাধারণ ছুটির। সেই ছুটির পরিপ্রেক্ষিতে ২৬ মার্চ থেকে দেশের পুঁজিবাজারের লেনদেন বন্ধ হয়ে যায়। টানা ৬৬ দিন বন্ধের কারণে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বাজার মূলধন কমে ১৯ হাজার কোটি টাকা।
এতে ডিএসই’র ক্ষতি হয় ৬২ কোটি টাকার বেশি। চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) ক্ষতি হয় ১০ কোটি টাকা। লোকসান ও ব্যয় কমাতে ব্রোকারেজ হাউজগুলো জনবল কমাতে শুরু করে। হাজারও কর্মী চাকরি হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েন। সেবছর তারল্য ও আস্থা সংকটের মধ্যে নতুন করে যুক্ত হয়েছিলো করোনা সংকট।
সাধারণ ছুটিতে ডিএসই’র ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৬২ কোটি টাকা। এর মধ্যে ডিএসই’র লেনদেনের চার্জ ৫ দশমিক ৮ কোটি টাকা, অগ্রিম আয়কর ১১ কোটি ৭ লাখ টাকা এবং স্টেকহোল্ডারদের কমিশন ৪৪ কোটি ৫ লাখ টাকা। একই দৃশ্য ছিল দেশের অপর পুঁজিবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জেরও (সিএসই)।
এসবের মধ্যেও দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই)প্রধান সূচক ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬৭৪ পয়েন্ট বা ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ বেড়েছিলো।
২০১৯ সালের শেষ দিন ডিএসইর মূল সূচক ডিএসইএক্স ছিল ৪ হাজার ৪৫৩ পয়েন্ট। সেটি ২০২০ সালের ২৪ ডিসেম্বর বেড়ে ৫ হাজার ২১৮ পয়েন্টে উঠেছিলো। লেনদেনও হচ্ছিলো হাজার কোটি টাকার ঘরে।
২০২০ সালের শেষ ছয় মাসে দেশের পুঁজিবাজার ভালো করলেও প্রথম ছয় মাসের পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। সে বছরের প্রথমার্ধে সূচক ৪ হাজার পয়েন্টের নেমে গিয়েছিল, লেনদেনও নেমেছিল ১০০ কোটি টাকার নিচে।
অন্যদিকে করোনার শুরুতে ডিএসই’র দৈনিক লেনদেন ২০০ কোটি টাকার নিচে নেমে যায়। দুই মাসের বেশি সময় বন্ধ থাকার পর লেনদেন শুরু হলেও গতি ফেরেনি। তবে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার নতুন চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের নেতৃত্বাধীন কমিশন উদ্যোক্তা-পরিচালক ন্যূনতম ২ শতাংশ এবং সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণের বিষয়ে কঠোরতা আরোপ করে। কোম্পানিগুলোর পর্ষদ পুনর্গঠন করে। একইসঙ্গে ওয়ালটন ও রবি আজিয়াটা কোম্পানির মতো বেশকিছু বড় কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করে।
এসব উদ্যোগের কারণে পুঁজিবাজারের লেনদেনেও গতি আসে। বর্তমানে বাজারে দৈনিক ৯০০ কোটি টাকার কাছাকাছি লেনদেন হচ্ছে। তাতে গত তিন মাসে ডিএসই’র প্রধান সূচক বেড়েছে প্রায় দুই হাজার পয়েন্ট। বেড়েছে বিনিয়োগকারীদের বাজার মূলধনও।
করোনার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের নেতৃত্বাধীন কমিশন করোনা কিংবা করোনার চেয়ে বড় মহামারি এবং যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগেও যাতে লেনদেন বন্ধ না হয় সে উদ্যোগ গ্রহণ করে। এরই অংশ হিসেবে ডিএসই’র আইটি খাতের সংস্কার, নতুন কোম্পানির আইপিওর অনুমোদন ও লেনদেন বাড়াতে নতুন ফান্ড গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে করোনা মহামারীর প্রভাব অন্য দেশগুলোর তুলনায় কম পড়ছে। আতঙ্কিত না হয়ে এই মুহূর্তে সবাইকে 'দেখেশুনে' বিনিয়োগ করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্লেষকরা। অন্যদিকে অর্থনীতির গতি যখন কমে যায় তার প্রভাব ব্যাংকের উপরে আসে। করোনা মহামারির সময়ে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কিন্তু বেড়ে যাচ্ছে।এছাড়াও ব্যাংকিং খাতের একটা বড় গ্রাহক হচ্ছে টেক্সটাইলগুলো। যেহেতু বড় বড় টেক্সটাইলের অর্ডার ক্যানসেল হয়ে যাচ্ছে। টেক্সটাইল খাতে যে ব্যাংকগুলো ঋণ দিয়েছে সেখানে কিন্তু ডিফল্টের পরিমাণ বেড়ে যাবে। এর ফলে ব্যাংকিং খাতে বড় ধরনের তারল্য সংকট দেখা দিতে পারে বস্ত্র বা পোশাক শিল্প খাতে করোনাভাইরাসের একটা বড় বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এর কারণ ইতোমধ্যে রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাকের অনেক অর্ডার বাতিল হয়ে গেছে। প্রতিদিনই কমছে এ খাতের রপ্তানি। শুধু তাই না, যারা ক্রেতা সেসব দেশেও মহামারী চলছে। খুব সহজেই তারা আবার আগের মত অর্ডার দিতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। সব মিলিয়ে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বস্ত্র খাতের কোম্পানিগুলো খারাপের দিকে যেতে পারে।
এসময় সিমেন্ট খাতেও একটা বড় খারাপ প্রভাব পড়ছে। কারণ এখন সরকার করোনা মোকাবিলা করতে ব্যস্ত। সরকারের অবকাঠামোগত উন্নয়নের কাজ কমে আসছে। আবার দেশের যে আবাসন খাত সেখানেও কিন্তু চাহিদা এবং কাজ দুটোই কমে আসছে।
অর্থনৈতিক অবস্থা যখন খারাপের দিকে যাচ্ছে তখন আশার আলো দেখাচ্ছে বাংলাদেশের অনেক ওষুধ কোম্পানি। যারা করোনাভাইরাস প্রতিরোধক কিছু ওষুধ তৈরি করার চেষ্টা করছে; যেগুলো তারা রপ্তানিও করতে চায়। এর বাইরেও করোনাভাইরাসের আক্রমণের ফলে বেশ কিছু ওষুধ আছে যেগুলোর চাহিদা অনেক বেশি বেড়েছে। ইতোমধ্যে এই ধরনের ওষুধের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। কোম্পানিগুলো ওষুধে তৈরি করে সরবরাহ করে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। যারা এ ধরনের ওষুধ বিক্রি করছে সেগুলো ভালো করবে এই মহামারির সময়।
এছাড়াও করোনায় যেহেতু অবকাঠামোগত উন্নয়ন থেমে যাচ্ছে। আবাসন খাত স্থবির হয়ে পড়তে যাচ্ছে। সে কারণে আবাসন খাতের সঙ্গে সম্পর্কিত যেসব প্রকৌশল কোম্পানি আছে তাদের প্রবৃদ্ধিও কমে যাবে। দেশে করোনাভাইরাসের প্রকোপ দেখা দেওয়ার পর গত বছর চার মাসের বেশি সময় উৎপাদন কর্মকাণ্ড প্রায় বন্ধ ছিল। ফলে সেই অর্থবছর শেষে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি কমে ৫ দশমিক ২৪ শতাংশে নেমে এসেছিলো।
এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ৭৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এটি একদিনে মৃত্যুর নতুন রেকর্ড। একই সময়ে দেশে নতুন করে আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন ৫ হাজার ৮১৯ জন। এর আগে গতকাল সর্বোচ্চ ৭৭ জনের মৃত্যু হয়েছিল। সবমিলিয়ে দেশে এ পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৮৪ হাজার ৭৫৬ জনে। মোট মৃত্যু হয়েছে ৯ হাজার ৭৩৯ জনের।
রোববার (১১ এপ্রিল) স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে পাঠানো করোনাবিষয়ক নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় করোনামুক্ত হয়েছেন ৪ হাজার ২১২ জন। এ পর্যন্ত মোট সুস্থ হয়েছেন ৫ লাখ ৭৬ হাজার ৫৯০ জন। গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম তিনজনের দেহে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। এর ১০ দিন পর ১৮ মার্চ দেশে এ ভাইরাসে আক্রান্ত প্রথম একজনের মৃত্যু হয়।