মঙ্গলবার (২৭ এপ্রিল) রাতে ফরেন পলিসি ম্যাগাজিন আয়োজিত ভার্চুয়াল ক্লাইমেট সামিটে এক ভিডিও বার্তায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে বিশ্বকে বাঁচাতে প্যারিস চুক্তির কঠোর বাস্তবায়নের বিকল্প নেই এমন মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণ কমাতে ধনী দেশগুলো, বিশেষ করে জি-২০ জোটভুক্ত দেশগুলোর মূল ভূমিকা পালন করা উচিত।
প্যারিস চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের ফিরে আসাকে ‘সুখবর হিসেবে’ বর্ণনা এ সিদ্ধান্তের পাশাপাশি গত সপ্তাহে ‘লিডার্স সামিট’ আয়োজনের জন্য প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশংসা করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনে অভিযোজন ও প্রশমনের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় প্যারিস চুক্তিতে প্রতি বছর ১০ হাজার কোটি ডলার তহবিলের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।
শেখ হাসিনা বলেন, প্যারিস চুক্তির কঠোর বাস্তবায়ন বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণ ও তার ফলে সৃষ্ট বৈশ্বিক উষ্ণায়ন রোধ করার একমাত্র উপায়। ধরিত্রীকে বাঁচাতে ব্যবস্থা নেওয়ার আজই সময়, কাল নয়।
বৈশ্বিক উষ্ণতা যেভাবে বাড়ছে তাতে বিপর্যয় এড়ানোর জন্য আর বেশি সময় হাতে নেই বলে সতর্ক করে আসছেন বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞরাও।
তারা বলছেন, গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমণের কারণে পৃথিবীর উষ্ণতা বাড়তে থাকায় সাগর পৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে; ঝড়, বন্যা এবং খরার মত প্রাকৃতিক দুর্যোগ পাচ্ছে নতুন মাত্রা।
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এভাবে বাড়তে থাকলে এই শতকের মাঝামাঝি সময়েই পৃথিবীর নিচু এলাকাগুলোর শত কোটি মানুষকে বাস্তুহারা হতে হবে। ভয়ঙ্কর সেই পরিণতি থেকে পৃথিবীকে বাঁচাতে ২০১৫ সালে প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনে চুক্তিবদ্ধ হন বিশ্ব নেতৃবৃন্দ।
বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির হার প্রাক শিল্পায়ন যুগের চেয়ে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি যেন না হতে পারে, সেজন্য নিঃসরণের মাত্রা সম্মিলিতভাবে কমিয়ে আনার অঙ্গীকার করা হয় সেই চুক্তিতে। এ পর্যন্ত বিশ্বের ১৮৯টি দেশ ওই চুক্তিতে অনুস্বাক্ষর করেছে।
বিশ্বে যে দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে, বাংলাদেশ রয়েছে সেই তালিকার একেবারে সামনের সারিতে। আর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখন ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের প্রধান।
ভাষণের শুরুতে আমন্ত্রণের জন্য আয়োজকদের ধন্যবাদ জানিয়ে করোনাভাইরাস মহামারী থেকে মুক্তির জন্য ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার ওপর জোর দেন শেখ হাসিনা।
ধারণ করা ভিডিও বার্তায় তিনি বলেন, কোভিড-১৯ এর পর সম্ভবত এ সময়ের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় জলবায়ু পরিবর্তন। প্রতিটি দেশের জন্য, বিশেষ করে বাংলাদেশের মত জলবায়ু সংবেদনশীল দেশগুলোর জন্য এটা বিশাল হুমকি।
বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বৃদ্ধিকে ‘সমস্ত দুর্বিপাক’এবং মানুষের জীবনধারণের জন্য ‘সবচেয়ে বড় চাপের কারণ’ হিসেবে তুলে ধরেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে আমরা বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে যেন না বাড়ে সেই ব্যাপারে একমত হয়েছি। কিন্তু তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য দায়ী ‘গ্রিনহাউস’ গ্যাসের নিঃসরণ রোধে উল্লেখযোগ্য কিছু করা যায়নি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের মত দেশগুলো প্রতিনিয়ত বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস ও বজ্রপাতসহ নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
আমার দেশের উপর দিয়ে তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। গত বছর বাংলাদেশ ভারি বর্ষণ মোকাবেলা করেছে, সে সময় দেশের এক তৃতীয়াংশ নিমজ্জিত হয়েছিল। সুপার সাইক্লোন আম্পানসহ বেশ কয়েকটি সাইক্লোন গত বছর আমার দেশের উপর আঘাত হেনেছে। এই সমস্ত ঘটনা ঘটেছে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ বড় দূষণকারী দেশ নয়। প্রকৃতপক্ষে ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের (সিভিএফ) কোনও সদস্য দেশই উল্লেখযোগ্য কারণ নিঃসরণ করে না।
“তবু আমরাই সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী। প্রতিবছর আমার দেশের জিডিপির ২ শতাংশ যায় জলবায়ুর ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবেলায়।”
তিনি বলেন, নিচের দিকের ১০০টি দেশ বৈশ্বিক নির্গমনের মাত্র ৩ দশমিক ৫ শতাংশের জন্য দায়ী, যেখানে জি-২০ দেশগুলো ৮০ শতাংশের জন্য দায়ী। সিভিএফ দেশগুলো জলবায়ু অভিযোজনে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে।
প্রথম নিম্ন আয়ের দেশ হিসেবে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট তহবিল গঠনের পর ৮০০টির বেশি প্রশমন ও অভিযোজন কর্মসূচি বাস্তবায়নে নিজস্ব সম্পদ থেকে ৪ কোটি ১৫ লাখ ডলারের বেশি ব্যয় করেছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের সংসদ ২০১৯ সালে জলবায়ু সংবেদনশীলতার বর্তমান অবস্থাটিকে ধরিত্রীর জন্য ‘জরুরি অবস্থা’ হিসেবে ঘোষণা করে একটি প্রস্তাবও গ্রহণ করেছে।
আমরা ৩০ কোটি গাছের চারা রোপণ করছি এবং আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ‘মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা’ নামে একটি কর্মসূচি চালু করেছি। আমরা জলবায়ু অভিযোজন ও স্থিতিস্থপকতা বৃদ্ধিতে প্রতিবছর ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করছি, যা গড়ে জিডিপির ২ দশমিক ৫ শতাংশ।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে ১২ হাজার ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র এবং দুই লাখ হেক্টর উপকূলীয় সবুজবেষ্টনী তৈরি করা হয়েছে। দেশের বিজ্ঞানীরা উপকূলীয় মানুষের জন্য লবণাক্ততা ও বন্যাসহনশীল ফসল, বৃষ্টি জলাধার এবং পুকুর-বালু-ফিল্টার, ভাসমান কৃষি প্রযুক্তি ও অস্থায়ী জলজ উদ্ভিদ উদ্ভাবন করেছেন।
আমার সরকার ঘূর্ণিঝড়-ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে দরিদ্রদের জন্য ঘূর্ণিঝড় প্রতিরোধী ঘর তৈরি করছে। পানি সংরক্ষণ ও নাব্যতা বৃদ্ধির জন্য আমরা সারা দেশে নদী ও খাল খনন করছি।
মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে পরিবেশগতভাবে সঙ্কটের মুখে থাকা কক্সবাজারে আশ্রয় দেওয়ায় ওই অঞ্চলের প্রতিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলেও সম্মেলনে জানান শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, অভিযোজন সম্পর্কিত গ্লোবাল সেন্টার ঢাকায় দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক অফিস স্থাপন করেছে। সেটি স্থানীয়-ভিত্তিক অভিযোজনের উদ্ভাবনী চর্চাকে ছড়িয়ে দিতে কাজ করছে।