প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের (ডিএলএস) তথ্যমতে, প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের দুগ্ধ শিল্পে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে কাজ করা হচ্ছে। গ্রামীণ পর্যায়ে অবকাঠামো উন্নয়নসহ বিপণন পর্যায়ে উন্নয়নের জন্য চার বছর মেয়াদি কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। ডেইরি গ্রুপগুলো থেকে উৎপাদিত দুধ যাতে প্রাতিষ্ঠানিক বিপণন চ্যানেলে (ফরমাল ডেইরি মার্কেটিং) প্রবেশ করতে পারে, সেজন্য উৎপাদক এলাকাগুলোর দুগ্ধ প্রক্রিয়াকরণকারীদের তত্ত্বাবধানে এসব ভিএমসিসি স্থাপন করা হচ্ছে। এসব কালেকশন সেন্টার থেকে দুধ আঞ্চলিক ডেইরি হাবে স্থানান্তরিত হবে। যেখানে অধিক পরিমাণ দুধ শীতলীকরণ ও ভ্যালু এডিশনের ব্যবস্থা থাকবে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মিল্ক কুলিং সেন্টার ও দুগ্ধ প্রক্রিয়াকরণ ইউনিট স্থাপন করা হচ্ছে। ভিএমসিসি ও ডেইরি হাবকেন্দ্রিক মিল্ক কুলিং সিস্টেম স্থাপনের মাধ্যমে দুধের গুণগত মান নিয়ন্ত্রণে রাখবে এবং ফুড সেফটি সহায়ক হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিদিন দুধ গ্রহণের তালিকায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে নিম্নে বাংলাদেশ। সেখানে দুধ উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি ভোক্তা পর্যায়ে চাহিদা বৃদ্ধিতে দুধের সরবরাহ পরিস্থিতি আরো উন্নত করা এবং মানসম্পন্ন দুধ সরবরাহ বৃদ্ধিতে উদ্যোগ প্রয়োজন। মূলত নিরাপদ ও মানসম্পন্ন দুধ তাদের কাছে পৌঁছাতে পারার কারণে মানুষ দুধ গ্রহণ করছে। সামনের দিনে ভোক্তাদের আরো সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। উৎপাদিত দুধের যুক্তিযুক্ত মূল্য না পাওয়া, দুধ সংরক্ষণ ও বাজারজাতে সহযোগিতা না পাওয়ার কারণে দুগ্ধ উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়া দুগ্ধ শিল্পের জন্য পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি ও ওষুধ না পাওয়া, বিদ্যুতের মূল্য কৃষিভিত্তিক শিল্পের চেয়ে অনেক বেশি হওয়ার সমস্যা রয়েছে। আছে সহজে বিদ্যুৎ সংযোগ না পাওয়ার সমস্যাও।
তবে সম্প্রতি সময়ে দুগ্ধবতী গাভীর সংকট, দক্ষ কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন জনবলের অভাব, দক্ষ প্রাণী চিকিৎসক ও ভেটেরিনারি চিকিৎসকের অভাব, স্বল্প সুদে ঋণ না পাওয়া এমন প্রতিবন্ধকতা অনেকটাই দূর হয়েছে। এখন প্রয়োজন উন্নত বিপণন ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
এ বিষয়ে প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের উপপ্রকল্প পরিচালক পার্থ প্রদীপ সরকার বলেন, খামারি পর্যায়ে বিপণন দুর্বলতা কাটাতে হলে গ্রামীণ পর্যায়ে অবকাঠামো উন্নয়ন প্রয়োজন। দেশের যেসব অঞ্চলে দুগ্ধ খামারিদের উৎপাদন ভালো কিন্তু বিপণন দুর্বলতা রয়েছে, সেখানে এসব ভিলেজ মিল্ক কালেকশন সেন্টার ও আঞ্চলিক পর্যায়ে ডেইরি হাব স্থাপন করা হবে। এর মাধ্যমে খামারিরা যেমন তাদের পণ্যের বাড়তি দাম পাবেন, তেমনি ভোক্তা পর্যায়ে ভালো মানের দুধ পৌঁছে দেয়া সম্ভব হবে। পাশাপাশি এসব খামারিকে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত করা হবে। ফলে গ্রাম পর্যায়ে শিল্প উদ্যোক্তারা তাদের দুধ ক্রয় করতে পারবেন। খামারিদের শিল্পের সঙ্গে যুক্ত করতে পারলে দুধের মূল্য সংযোজন করা সম্ভব হবে।
ডিএলএসের তথ্যমতে, প্রতি বছর দেশে গড়ে ১ কোটি ৫২ লাখ টন দুধের চাহিদা রয়েছে। এ পরিমাণ চাহিদার বিপরীতে দেশে গত অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৬ লাখ ৮০ হাজার টন। জনপ্রতি প্রতিদিন ২৫০ গ্রাম করে চাহিদা ধরা হয়েছে। ফলে উৎপাদনের বিপরীতে এখন জনপ্রতি প্রতিদিনের প্রাপ্তি হচ্ছে ১৭৫ দশমিক ৬৩ গ্রাম। তবে আশার কথা হলো, দুধ উৎপাদন গত এক দশকের ব্যবধানে সাড়ে তিন গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এ উৎপাদন বৃদ্ধিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছেন খামারিরা। কিন্তু দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেক খামারিই তাদের উৎপাদিত দুধ বিক্রি করতে পারেন না। কেননা দুধ বিপণনের আগে বেশকিছু বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া পরিপালন করতে হয়। কিছু অবকাঠামোগত উন্নয়নের প্রয়োজন রয়েছে। এসব সুবিধা গ্রামাঞ্চলে না থাকার কারণে খামারিরা দুধ বিক্রিতে পিছিয়ে পড়তেন। পাশাপাশি তারা দুধের ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হতেন। কিন্তু গ্রামীণ পর্যায়ে ৩০০ কালেকশন কেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে সেই অসুবিধা অনেকটাই লাঘব হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, প্রকল্পের মাধ্যমে প্রাণিসম্পদজাত পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি, প্রাণিজাত পণ্যের মার্কেট লিংকেজ ও ভ্যালু চেইন সৃষ্টি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি খামারিদের জন্য জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, নিরাপদ প্রাণিজ খাদ্য উৎপাদন এবং বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রাণিসম্পদ খাতে টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে এ প্রকল্প পরিচালিত করা হচ্ছে, যার মাধ্যমে সঠিকভাবে খাদ্য ও পুষ্টি সরবরাহ, প্রাণিস্বাস্থ্য এবং কৃত্রিম প্রজনন ব্যবস্থাপনা উন্নত করা যাবে। এর মাধ্যমে খামারি ও হাউজ হোল্ড পর্যায়ে উৎপাদনশীলতা কমপক্ষে ২০ শতাংশ বৃদ্ধি করা হবে।
সূত্র: বণিক বার্তা