সাম্প্রতিক বছর গুলোতে বাগদা চিংড়ি চাষে হোয়াইট স্পট বা চাইনা ভাইরাস রোগ মারাত্মক বিপর্যয় বয়ে আনছে। পুকুর বা ঘেরের চিংড়ির অস্বাভাবিক আচরণ দেখলেই বুঝতে হবে চিংড়ি রোগে আক্রান্ত হয়েছে।
মাটির প্রকৃতি, পানির তাপমাত্রা, লবণাক্ততা, অক্সিজেন, পি এইচ ইত্যাদির সমষ্ঠিগত বৈশিষ্ঠ্যের এক বা একাধিক গুণাবলী খারাপ হলে চিংড়ি দুর্বল ও রোগাক্রান্ত হয়। অধিক হারে পোনা মজুদ, অতিরিক্ত খাদ্য ও সার প্রয়োগ, কম গভীরতা উচ্চতাপ, হঠাৎ করে লবণাক্ততায় তারতম্য হওয়া ইত্যাদি কারণেই চিংড়ি আক্রান্ত হয়।
জেনে নিন চিংড়ির বিভিন্ন রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার:
হোয়াইট স্পট বা চায়না ভাইরাস রোগ: চিংড়ি পোনা ঘেরে ছাড়ার ৩০-৭০ দিনের মধ্যে এ রোগ দেখা দিতে পারে। প্রথমদিকে এ রোগের কোনো বাহ্যিক লক্ষণ দেখা যায় না। ৩/৪ দিন পর রোগের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। চিংড়ি খোলাস্থানে জড়ো হয় এবং তাদের গায়ে, মাথায় খোলসে সাদা সাদা স্পট দেখা যায়। কখনো আবার নির্লাভ বা লালচে হয়ে যায়। এ রোগে সাধারণত বাগদা চিংড়ি বেশি আক্রান্ত হয়।
প্রতিকার: এ রোগের তেমন কোনো চিকিৎসা নেই। তাই বিভিন্ন ওষুধ বা কেমিকেল ব্যবহার না করে পানির গুণগত মান উন্নত করতে হবে। ঘেরের তলদেশের পচাঁ কাদা মাটি তুলে ফেলতে হবে। চুন সার দিয়ে জমি প্রস্তুত করতে হবে।
মস্তক হলুদ রোগ: ইয়োলো হেড নামক ভাইরাস দ্বারা এ রোগ হয়। যকৃত, অগ্ন্যাশয়, গ্রন্থি ফ্যাকাশে হওয়ার কারণে চিংড়ির মাথা হলুদ রং ধারণ করে। পোনা মজুদের ২৫-৩০ দিনের মধ্যে এ রোগ দেখা দিতে পারে। এ রোগে আক্রান্ত হলে ব্যাপক আকারে চিংড়ি মারা যায়। এতে চাষীর অনেক ক্ষতি হয়। এ রোগও সাধারণত বাগদা প্রজাতির চিংড়িতে বেশি আক্রমণ করে।
রোগের প্রতিকার: এ রোগটিও চিকিৎসার মাধ্যমে সারে না। ফাইটো ফ্লাংকটন চাষ করলে এ রোগ অনেকটা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। সুষ্ঠু খামার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এ রোগ প্রতিরোধ করা যায়। খামারের তলদেশে শুকিয়ে ব্লিচিং পাউডার/চুন দিয়ে যথাযথভাবে মাটি শোধন করে নিতে হবে।
চিংড়ির কালো ফুলকা রোগ: পুকুরের তলায় মাত্রাতিরিক্ত হাইড্রোজেন সালফাইট এবং অন্যান্য জৈব পদার্থের কারণে চিংড়ির কালো ফুলকা রোগ দেখা যায়। এ রোগে চিংড়ির ফুলকায় কালো দাগ ও পচন দেখা যায়। মাছের খাদ্য গ্রহণে অনীহা দেখা যায়। আক্রান্ত চিংড়ি ধীরে ধীরে মারা যায়।
প্রতিকার: পুকুরের তলদেশে থেকে দ্রুত পানি পরিবর্তন করতে হবে। গলদা চাষে মিথাইলিন ব্লু ব্যবহার করে ভাল ফল পাওয়া যায়। এসকোর্বিক ২০০০এমজি/কেজি খাদ্যে মিশিয়ে খাওয়ালে ভালো ফল পাওয়া যায়। পুকুর প্রস্তুতকালীন সময়ে তলদেশের কাদা-মাটি তুলে ভালো করে শুকিয়ে এবং পরিমাণমতো চুন/ডলমাইট/ব্লিচিং পাউডার দিতে হবে। পুকুরের পাড়ে পাতা ঝরা গাছ কেটে ফেলতে হবে।
কালো দাগ রোগ: চিংড়ির এক মারাত্মক ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ হলো কাল দাগ। পুকুরের অত্যধিক জৈব পদার্থ থাকার কারণে এ রোগ দেখা দেয়। এ রোগ হলে চিংড়ির খোলস লেজ ও ফুলকায় কাল কাল দাগ হয়। খোলসের গায়ে ছিদ্র হয়। পরবর্তীতে ফাঙ্গাস দ্বারা আক্রান্ত হয়ে চিংড়ি মারা যায়।
প্রতিকার: দ্রুত পানি পরিবতন এবং প্যাডেল হুইলের সাহায্যে বায়ু সঞ্চালনের রোগের প্রকোপ কমে যায়। মিথাইল ব্লু (২-৫ পিপিএম) পানিতে ব্যবহার করে রোগ নিরাময় করা যায়।
খোলস নরম রোগ: ক্যালসিয়ামের অভাবে চিংড়ির এ রোগ হয়। অনেকে স্পঞ্জ রোগ বলে। পানির লবণাক্ততা কমে গেলে এ রোগে বাগদা চিংড়ি আক্রান্ত হতে পারে। এ রোগ হলে চিংড়ি খোলস বদলানোর ২৪ ঘন্টা পরও তা শক্ত হয় না। চিংড়ি বড় হয় না ও ক্রমশ দুর্বল হয়ে মারা যায়।
প্রতিকার: ক্যালসিয়ামসহ সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ করে পুষ্টির অভাব দূর করতে পারলে এ রোগ ভালো হয়। পানিতে শতাংশে ১ কেজি পরিমাণ পাথুরে চুন প্রয়োগ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। রোগের আক্রমণ হলে বড় চিংড়ি ধরে ফেলতে হবে। খামারে পানি নিষ্কাশনে ও প্রবেশের পৃথক ব্যবস্থা রাখতে হবে।
সতর্কতা ও করণীয়
প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম। এজন্য চিংড়ি ঘেরের আকার ছোট করুন। পোনা মজুদহার একর প্রতি ৩ থেকে ৪ হাজারের মধ্যে রাখুন। ঘেরভূক্ত আলাদা নার্সারিতে চিংড়ি পোনা ২-৩ সপ্তাহ প্রতিপালনের পর চাষের ঘেরে নালা কেটে বের করে দিন।
প্রস্তুতকালীন সময়ে চুন (কমপক্ষে শতাংশে ১ কেজি) প্রয়োগ করুন। চাষকালীন সময়ে পানি পরিবতনের পরপরই প্রতি শতাংশে ৫০-১০০ গ্রাম কার্বনেট চুন প্রয়োগ করে পানি শোধন করুন।
ঘেরের পানির গভীরতা কমপক্ষে ৩-৪ ফুট রাখুন। ১৫ দিন বা একমাস পরপর ঘেরের পানি বের করে নতুন পানি দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। রাক্ষুসে মাছ, কাকরা ও অন্যান্য চিংড়িভূক প্রাণী নিয়ন্ত্রণ করুন।
খামার জলজ আগাছা মুক্ত রাখুন ও বাঁশের কনচি গাছের শুকনা ডালপালা দিয়ে আশ্রয় করে দিন। এ ছাড়াও অন্য কোনো সমস্যা দেখা দিলে নিকটস্থ মৎস্য কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করে পরামর্শানুযায়ী ব্যবস্থা নিন।
তথ্য-সূত্র: কৃষি তথ্য সার্ভিস