কৃষিতথ্য সার্ভিসের পরিচালক কৃষিবিদ কার্তিক চন্দ্র চক্রবর্তী জানান, সঠিকভাবে পরিচর্যা করলে টবেই ফুটে উঠবে বিভিন্ন রঙের গোলাপ ফুল।
জেনে নেওয়া যাক টবে গোলাপ ফুল চাষের পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থাপনা-
টবের স্থান নির্বাচন: শুরুতেই আমাদের টবের স্থান সঠিকভাবে নির্বাচন করতে হবে। খোলামেলা আলো বাতাসপূর্ণ স্থানে টব রাখতে হবে। টবে যেন সকালের সূর্যের রোদ পায়। যেন অন্তত ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা রোদ পায়। বিকেলের রোদ (বিশেষ করে গ্রীষ্মকালে) না লাগানোই ভালো। এতে ফুলের রং ফ্যাকাসে হয়ে যায়। গোলাপ গাছে যাতে চারদিক থেকে আলো পড়ে সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে।
তা না হলে গাছটি কেবল আলোর দিক দিয়েই বাড়বে। এজন্য টবসহ গাছটি মাঝে মাঝে ঘুরিয়ে নিতে হয়। গ্রীষ্মের প্রখর রোদ থেকে টবের গোলাপ গাছকে রক্ষা করার জন্য পর্যায়ক্রমে রোদ ও ছায়ায় ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে টব রাখলে গাছ ভালো থাকবে। ফুলও বেশি দিন ধরে পাওয়া যাবে।
মাটি তৈরি: এরপর আমাদের মাটি তৈরির বিষয়টিতে গুরুত্ব দিতে হবে। এঁটেল মাটি গোলাপ চাষের জন্য ভালো নয়। টবের জন্য সার ও মাটি এমনভাবে প্রস্তুত করতে হবে যাতে মাটি বেশ ফাঁপা থাকে এবং পানি না দাঁড়ায়। ১ ভাগ দো-আঁশ মাটি, ৩ ভাগ গোবরসার, ১ ভাগ পাতা পচা সার, আধ ভাগ বালি (নদীর সাদা বালি হলে ভালো হয়) দিয়ে মিশ্রণ তৈরি করে তাতে এক মুঠো সরিষার খৈল ও এক চামচ চুন মিশিয়ে ১টি ২০ সে. মি. (৮ ইঞ্চি) টবে একমাস রেখে দিতে হবে।
এই একমাস টবে পানি দিয়ে মাটি উল্টে পাল্টে দিতে হয়। এতে মাটির মিশ্রণ ভালো হবে। অনেকে মাটির মিশ্রণে ব্যবহৃত চা পাতা ব্যবহার করেও ভালো ফল পেয়েছেন। টবের নিচের কয়েক সে. মি. পরিমাণ অংশে ইট বা মাটির হাড়ি পাতিলের ভাঙা টুকরা এমনভাবে বিছিয়ে দিতে হয় যাতে টবের মাটি এগুলোর ওপর থাকে। এতে বাড়তি পানি নিকাশের সুবিধা হবে।
টবের আকার: টবের আকার নির্ভর করে যে গোলাপের চাষ করা হবে তার জাতের ওপর। ছোট জাতের জন্য ২০ সে. মি. (৮ ইঞ্চি) টব ভালো। বড় জাতের জন্য ৩০ সে. মি. (১২ ইঞ্চি) বা আরও বড় টব ব্যবহার করতে হয়। তবে প্রথম বছর যে আকারের টবে গাছ বসানো হবে পরের বছর তার থেকে বড় টবে গাছ স্থানান্তর করলে ফুল বেশি পাওয়া যায়।
টবে চারা বসানোর সময় : বছরের যেকোনো সময়ই টবে গোলাপের চারা বসানো যায়। তবে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ও জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাস চারা লাগানোর উত্তম সময়। এ সময় চারা লাগালে বেশি দিন ধরে ফুল পাওয়া যায়, গাছের পরিচর্যা করতে সুবিধা হয়, রোগ ও পোকার আক্রমণও কম থাকে।
চারা সংগ্রহ: চারা সংগ্রহের সময় সুন্দর চারা সংগ্রহ করা উচিত। চারার গোড়ায় মাটির গোল্লাটি অবিকল আছে কি না তা ভালো করে দেখে নিতে হবে। মাটির গোল্লাসহ চারার গোড়ার শিকড় বেরিয়ে থাকা অসুন্দর চার গাছ না নেওয়াই ভালো। পরিচিত নার্সারি থেকে চারা সংগ্রহ করা উচিত। চারা সংগ্রহের ব্যাপারে অভিজ্ঞ লোকের পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে।
টবে চারা বসানো: চারাগাছ বা কলমচারা মাটির গোল্লাসহ পলিথিন ব্যাগে অথবা ছোট মাটির টবে কিনতে পাওয়া যায়। চারাটি যদি টবের হয়, তাহলে টব থেকে পুরো মাটিসহ চারাটি এমনভাবে নিতে হবে যাতে ভেঙে না যায় বা শিকড়ের কোনো ক্ষতি না হয়।
ভেজা মাটির গোল্লাসহ চারা সংগ্রহ করলে তা একটু শুকিয়ে নিতে হয়। চারা বসানোর আগেই গাছের অপ্রয়োজনীয় পুরানো বা মরা ডালপালা হালকাভাবে ছেঁটে দিতে হবে। এরপর চারাটি টবের মাঝখানে সোজা করে বসিয়ে টবের ওপরে কিছু কম্পোস্ট সার দিয়ে গাছের গোড়ার মাটি হালকা চাপ দিয়ে বসিয়ে দিতে হবে। চারা এমনভাবে বসাতে হবে যাতে কুঁড়ি বের হবার গিট/পর্বটি মাটির ওপরেই থাকে।
পানি দেওয়ার নিয়ম : টবে বসানোর পর অন্তত ২/৩ বার পানি সেচ দিতে হবে। চারা অবস্থায় গাছ যাতে প্রখর রোদ বা বৃষ্টির ঝাপটা থেকে রক্ষা পায় সেদিকে খেয়াল রাখা দরকার। প্রথম অবস্থায় ৩/৪ ঘণ্টা এবং ধীরে ধীরে বাড়াতে বাড়াতে ৭/৮ ঘণ্টা রোদ পাওয়ার ব্যবস্থা করলে গোলাপ ভালো হবে।
পানি সেচের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে গাছের গোড়ায় পানি দাঁড়িয়ে না যায়। কচি পাতা ও কুঁড়ি ছাড়ার সময় একটু বেশি পানি দরকার। এ সময় সকাল সন্ধ্যা সেচ দেওয়া উচিত। ঝাঁঝরি দিয়ে ডাল-পালাসহ সমস্ত গাছটিই পানি দিয়ে ভিজিয়ে দিতে হবে।
সার প্রয়োগ: টব বসাবা একমাস পর থেকে ১৫ দিন বা এক মাস পর পর সার দিতে হয়। শীতের ঠিক পরেই অর্থাৎ মার্চের শেষে বা এপ্রিলের প্রথম দিকে টবের উপরের ৮/১০ সে. মি. মাটির স্তর তুলে দিয়ে খালি জায়গায় পচা গোবর সার ও নতুন ফাঁপা মাটি দিয়ে ভরে দিতে হয়।
এরপর খড় বা পাতা দিয়ে ঢেকে গ্রীষ্মের প্রখর রোদ থেকে গাছের শিকড়কে রক্ষা করতে হয়। শীতকালে গাছ ছাঁটার পর, প্রতি টবে ৩ মুঠো গুঁড়া গোবর সার ও ১ মুঠো স্টিমড্ হাড়ের গুঁড়া বা স্টেরামিল প্রয়োগ করতে হবে। এরপর পুরো শীতকাল ধরে ১ মাস অন্তর অন্তর ১ মুঠা করে স্টিমড্ বোন মিল বা স্টেরামিল প্রয়োগ করতে হবে।
গোলাপের ভালো ফুল উৎপাদনের জন্য পাতার সার ও ফলিয়ার স্প্রের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কয়েকটি রাসায়নিক সার মিশিয়ে এই সার প্রস্তুত করতে হয়। শীতকালে রৌদ্রোজ্জ্বল দিনের সকাল ৮টার মধ্যে ফলিয়ার স্প্রে করতে হয়।
দুই প্রকারের পাতা সার গাছে ব্যবহার করা হয়, ১টি গাছের স্বাস্থ্য ও ফুল ভালো করার জন্য অপরটি ট্রেস এলিমেন্টের জোগান দেওয়ার জন্য। যেমন- ইউরিয়া, ডাই-অ্যামোনিয়াম সালফেট ও ডাই-পটাশিয়াম ফসফেট প্রতিটি ১০ গ্রাম করে ১০ লিটার পানিতে গুলে স্প্রে দ্রবণ তৈরি করতে হবে।
ট্রেস এলিমেন্টের জন্য ম্যাগনেশিয়াম সালফেট ২০ গ্রাম, ম্যাঙ্গানিজ সালফেট ১৫ গ্রাম, ফেরাস সালফেট ১০ গ্রাম, বোরাক্স ৫ গ্রাম হারে মিশিয়ে প্রতি লিটার পানিতে উল্লেখিত মিশ্রণটির ২ গ্রাম করে গুলিয়ে স্প্রে করতে হবে। দুটি পাতা সারের সঙ্গেই কীটনাশক বা বালাইনাশক মিশিয়ে স্প্রে করা যায়। কিন্তু দুটি সার এক সঙ্গে মিশিয়ে স্প্রে করা যাবে না।
পাতার সার টবের গোলাপের জন্য অপরিহার্য এবং জমির গোলাপের জন্য উপকারী। স্প্রে করার সময় যেন পাতার দু’দিকেই ভালোভাবে লাগে সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। টবের গাছে সারা বছরই তরল সার প্রয়োগ করতে হবে। সঠিক মাত্রা বা প্রয়োগবিধি না জেনে রাসায়নিক সার ব্যবহার না করাই ভালো। কেননা, মাত্রায় বা ব্যবহারবিধিতে হেরফের হলে গাছের ক্ষতির আশঙ্কা থাকে।
রাসায়নিক তরল সারের পরিবর্তে গোবর ও সরষের খৈল ৪/৫ দিন পানিতে পচিয়ে তরল করে সপ্তাহে দু’একদিন করে ব্যবহার করা যায়। গাছের নতুন ডালপালা বাড়াতে এবং ফুলের আকার বড় করতে এ ধরনের তরল সার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তরল সারের অভাবে ছোট মাছপঁচা-পানি গাছের গোড়ায় দেওয়া যায়। দুর্বল গাছে প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হিসাবে ইউরিয়া মিশিয়ে সকাল-বিকাল পাতায় স্প্রে করলে গাছ তাজা হয়।
চুন-পানি প্রয়োগ: প্রতি লিটার পানিতে ১ চামচ গুড়ো চুন পরিষ্কার পানিতে ভালো করে গুলিয়ে পাতলা ন্যাকড়ায় ছেঁকে প্রতি ৩ মাস পর পর দিতে হয়। চুন-পানি দেওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে অন্য কোনো সার না দিয়ে শুধু পানি দিতে হয়।
অন্যান্য পরিচর্যা: মৃত ও রোগগ্রস্ত ডাল অপসারণের জন্য, গাছের উপযুক্ত আকৃতি প্রদানের জন্য, প্রতিটি ডালে ফুল আসবার জন্য এবং প্রয়োজনীয় রোদ পাবার জন্য নিয়মিত গাছ ছাঁটাইয়ের প্রয়োজন হয়। গোলাপ প্রচুর শাখা বিস্তারকারী গুল্ম জাতীয় গাছ।
গাছের ফুল দেওয়া শেষ হলেই গাছ ছেঁটে দিতে হবে। নিয়মিত গাছ ছাঁটাই করলে বেশি ও বড় আকারের ফুল পাওয়া যায়। বর্ষার পর অক্টোবর-নভেম্বর মাস ছাঁটাইয়ের জন্য ভালো সময়। সাধারণত ২০-২৫ সে. মি. (৮-১০ ইঞ্চি) বড় রেখে ডাল ছেঁটে দিতে হয়।
ডাল এমনভাবে কাটতে হবে যাতে থেঁতলে বা ছিঁড়ে না যায়। এ জন্য ধারালো ছুরি ব্যবহার করতে হয়। সাদা, হলুদ, হালকা হলুদ ও দো-রঙা জাতের গোলাপ গাছ খুব হালকা ছাঁট আর লাল জাতের গোলাপ গাছে শক্ত ছাঁট দিতে হয়। গাছ ছাঁটাইয়ের পর ডাইব্যাক রোগের আক্রমণ হতে পারে। সুতরাং গাছ ছাঁটাইয়ের আগে ও পরে কীটনাশক ও ছত্রাক নাশক দুইই প্রয়োগ করা দরকার।
রোগ ও পোকা দমন: শুঁয়ো পোকা বা অনিষ্টকারী অন্য যেকোনো পোকা দেখামাত্র মেরে ফেলা উচিত। লাল মাকড়সার আক্রমণ ও ডাইব্যাক রোগই বেশি মারাত্মক।
সেচের সময় টবে জল জমে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করলে লোহার শিক দিয়ে টবের মাটি ছিদ্র করে পানি বের হবার পথ করে দিতে হবে। এ কাজটা একটু সাবধানে করা দরকার যাতে শিকড়ের কোনো ক্ষতি না হয়। পানি দেওয়ার আগের দিন প্রতিবারই টবের মাটি বেশি করে এবং মাঝখানের মাটি কম করে খুঁচিয়ে দিতে হয়।
গ্রীষ্মকালীন পরিচর্যা: টব ছাদে বা পাকা স্থানে রাখলে পুরু খড় বিছিয়ে তার ওপর ইট বা কাঠের টুকরা রেখে সেগুলোর ওপর টব রাখা উচিত। গ্রীষ্মকালে প্রচণ্ড তাপের সময় পানি না দিয়ে রাতের দিকে যখন তাপমাত্রা কমতে থাকে (রাত ৮টার পর) ছাদের টবে তখন জল দেওয়াই ভালো। এ সময় পানির তাপমাত্রা আবহাওয়ার সঙ্গে মোটামুটি সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকে।
বর্ষাকালীন পরিচর্যা: টবের নিচের খড়কুটো, ইট সরিয়ে টবগুলো কেবল ছাদ বা পাকা স্থানেই রাখতে হবে এবং ঝড় থেকে টব ও গাছকে রক্ষার প্রস্তুতি নিতে হবে। টবের মাটি মাঝখানের দিকে উঁচিয়ে কোণাকৃতি করে দিলে পানি জমে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করতে পারবে না। অতিরিক্ত মাটি বর্ষা শেষে সরিয়ে ফেলতে হয়।