বাংলাদেশের বিখ্যাত চিকিৎসক এবং সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী। তিনি বর্তমান বিশ্বের মহা আতঙ্ক করোনাভাইরাস সম্পর্কে জনগণের মধ্যে সচেতনতা এবং সতর্কতার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন। যা ঢাকার একটি জনপ্রিয় সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। প্রখ্যাত এই চিকিৎসকের পরামর্শ নিঃসন্দেহে এই দুর্যোগময় মুহূর্তে মানুষের কাজে আসবে, তাই অর্থসংবাদের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো.....
বিশাল চীন আজকে করোনাকে প্রায় পরাজিত করেছে, নিয়ন্ত্রণ করে ফেলেছে। এটা একটা অসাধারণ সাফল্য। যেভাবে ওখানে প্রথম করোনার আক্রমণ শুরু হয়েছিল, যে হারে রোগী ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছিল তাতে করোনাকে জয় করাটা দুঃস্বপ্নের মতো মনে হয়েছিল। কিন্তু চীন সরকার ও তাদের জনগণের কঠোর প্রতিরোধের মুখে আজ করোনা পরাজিত হয়েছে। প্রমাণিত হলো, কভিড-১৯ মোটেই অপরাজেয় নয়। কাজেই করোনা নিয়ন্ত্রণে চীনের অনুসৃত পদ্ধতি শেষ পর্যন্ত পশ্চিমাসহ অন্য দেশগুলো অনুকরণ করতে বাধ্য হচ্ছে, হবে।
খারাপ খবর অনেক শক্তিশালী জনস্বাস্থ্যব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও শক্তিশালী পশ্চিমা দেশগুলোসহ পৃথিবীর প্রায় পৌনে ২০০ দেশ করোনা সংক্রমণের শিকার হয়েছে। ইউরোপের উন্নত দেশ ইতালি, জার্মানি, স্পেন আজ অসহায়ভাবে করোনার বিরুদ্ধে লড়ছে। এদিকে ইরানে করোনা অপ্রতিরোধ্য আক্রমণ চালাচ্ছে। দক্ষিণ কোরিয়া, জাপানের মতো অগ্রগামী দেশগুলো করোনাকে রুখতে পারেনি। তবে অদৃশ্য শক্তির বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধ চলছে। এর থেকে প্রধান শিক্ষা হচ্ছে; করোনা জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি বিরাট সমস্যা। কিন্তু এর অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া বিশাল। করোনায় ইতালির একক মৃত্যু সংখ্যা চীনকে ছাড়িয়েছে। ৩ লাখ ৮ হাজারের বেশি মানুষ সারা পৃথিবীতে আক্রান্ত। ১৩ হাজারের বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। দক্ষিণ কোরিয়ায় একটি বিরাট গির্জায় প্রার্থনারত ভক্তিমূলক সংগীত গাইতে গাইতে একসঙ্গে ২১৬ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন এবং কোরিয়ার কয়েকটি অঞ্চলে এক সপ্তাহের মধ্যে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এ দুঃসংবাদের মধ্য থেকেই আসল সত্য খবরগুলো সরকার, জনগণ এবং স্বাস্থ্যব্যবস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারী ও নীতিনির্ধারকদের বুঝতে হবে। সেজন্য সত্য খবরগুলো জানতে হবে। আমরা স্বীকার করি, মানুষকে ভয় দেখানো উচিত নয়। কিন্তু একই সঙ্গে এও সত্য, দেরি হওয়ার আগে সমস্যা সমাধানের সঠিক পথগুলো খুঁজে বের করতে হবে। যা চীন আমাদের শিখিয়েছে। তা থেকে অবশ্যই শিক্ষা নিতে হবে। তা না হলে ভবিষ্যতে আমাদের বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। বাস্তবতা কভিড-১৯ একটা অত্যন্ত ছোঁয়াচে ভাইরাস এবং দ্রুত সংক্রমণ ছড়াতে সক্ষম। এ ভাইরাস হাঁচি, কাশি, কথা ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষের দেহ থেকে বের হওয়ার পরে সঙ্গে সঙ্গে মরে যায় না। আমেরিকান নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল একটি প্রথম শ্রেণির মেডিকেল পত্রিকা। এক সপ্তাহ আগে এ পত্রিকায় একটি সমীক্ষা প্রকাশিত হয়েছিল। তাতে বলা হয়েছে, মানুষের দেহ থেকে বের হওয়ার পরও করোনাভাইরাস কয়েক ঘণ্টা থেকে দু-তিন দিন জীবিত থাকতে পারে। অথচ আমরা বহুদিন থেকেই জানি, জীবিত মানবকোষ ছাড়া এ ধরনের জীবাণু বাঁচতে পারে না। খুব জোরে কথা বললে, হাঁচি দিলে, চিৎকার করলে এবং কাশি দিলে এ জীবাণু অন্য মানুষের নাক, চোখ ও মুখে লাগলে দেহের ভিতর প্রবেশ করতে পারবে। সেখান থেকে শরীরের সবচেয়ে সংবেদনশীল অংশ বা অর্গান ফুসফুসে প্রবেশ করলে কভিড-১৯-এর নিউমোনিয়া ভয়ঙ্কর রূপ নিতে পারে।
অবশ্য শেষ পর্যন্ত কিডনি ও লিভারে ভাইরাস ঢুকে যেতে পারে । কিন্তু মনে রাখতে হবে, কভিড-১৯-এ মৃত্যুর হার ২ দশমিক ৫ থেকে সর্বোচ্চ ৪ ভাগ। এর মধ্যে বেশির ভাগ মৃত্যুর ধরন কভিড নিউমোনিয়ায়।
সবচাইতে বেশি মৃত্যু কাদের মধ্যে?
বেশি বয়স্ক, দুর্বল মানুষের মধ্যে এ ভাইরাস বেশি আক্রমণ ঘটাতে পারে। মৃত্যুর হারও বেশি। ষাটোর্ধ্ব দুর্বল মানুষ যাদের মধ্যে রোগ প্রতিরোধের শক্তি কম এবং যারা ডায়াবেটিস রোগী এবং সঙ্গে হার্টের অসুখ, ফুসফুসের রোগী, হাঁপানি ইত্যাদি রোগ যাদের মধ্যে আছে। আমেরিকার একটি সমীক্ষায় দেখা যায়, কভিড-১৯-এ আক্রান্ত হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা বয়স্কদের মধ্যে প্রায় ৬০ ভাগ এবং মৃত্যুর হারও তাদের মধ্যে বেশি।
রোগমুক্ত থাকতে হলে আপনাকে কী করতে হবে?
কভিড-১৯ ভাইরাস আপনার দেহে ঢুকতে দেওয়া যাবে না। এর জন্য সব ব্যবস্থা করতে হবে। যেহেতু আমরা একে অন্যের সঙ্গে দেখা হলে সাধারণত হাত মেলাই, চুম্বন ও কোলাকুলি করি। ভিড়ের মধ্যে যাই। ফলে জেনে না জেনে অন্যের গায়ে ছোঁয়াছুঁয়ি হয়ে যায়। এমনকি ধর্মীয় অনুষ্ঠান, ক্লাব, রেস্তোরাঁ কাঁচাবাজার ঘুরে কাছে থেকে কথা বলা, যেগুলোকে আমরা অত্যন্ত সাধারণ কাজ বলে মনে করি। কিন্তু এর সবই জীবাণু একে অন্যের মধ্যে ছড়াতে সাহায্য করে। কাজেই দেহে এ রোগ ছড়ানো বন্ধ করতে হলে এসব কাজ থেকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে। জানা-অজানা অবস্থায় মানুষ মুখে, চোখে ও নাকে বারবার হাত দেয়। এও করোনাভাইরাস ছড়ানোর সহায়ক।
কী কী করা যাবে না
১. একান্ত প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে যাবেন না। ২. ষাটোর্ধ্ব মানুষের বর্তমান অবস্থায় বাইরে যাওয়ার দরকার নেই। হাসপাতাল বা ডাক্তারের চেম্বারে না গিয়ে মোবাইল ফোনে পরামর্শ নিতে হবে। ৩. ভিড়ে যাওয়া যাবে না। সমুদ্রসৈকত ভ্রমণ, ক্লাব, রেস্তোরাঁয় যাওয়া যাবে না। বাড়ির খাওয়া অভ্যাস করুন। বিয়েবাড়ি, সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান পরিহার করুন। আপনারা জানেন, ইতিমধ্যে পবিত্র মক্কা, মদিনাসহ অন্যান্য মসজিদে জামাতে নামাজ নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে।
কী কী করতে হবে
১. ঘর থেকে বের হওয়ার সময় ভালো মাস্ক পরতে হবে। প্রয়োজনে কাপড় দিয়ে নিজের মাস্ক নিজেই তৈরি করে নিতে হবে এবং রোজ সন্ধ্যায় মাস্ক ধুয়ে পরিষ্কার করতে হবে। ২. হাত ধুতে হবে কব্জি থেকে ২ ইঞ্চি ওপর পর্যন্ত। অন্তত ২০ সেকেন্ড হাত ধুয়ে পরিষ্কার করতে হবে। এর মধ্যে যতবার হাত ধোয়া যায় ততই ভালো। হাত মেলানোর বদলে দূর থেকে হাত উঁচু করে অভিবাদন জানান। চুম্বন পরিহার করুন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সামাজিক দূরত্ব বলে যে একটি নতুন শব্দ চালু করেছে, সামাজিকতার কারণে কাছে আসা বন্ধ করতে হবে। এজন্য নাচ-গান, ক্লাব বা রেস্তোরাঁর অনুষ্ঠান পরিহার করার জন্য বলা হয়েছে। পুরনো টাকার নোট ও কয়েন ইত্যাদির মাধ্যমে করোনাভাইরাস ছড়াতে পারে। এ ক্ষেত্রে প্লাস্টিক কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন করতে পারলে সবচেয়ে ভালো হয়।
ভারতের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, দোকানের পান খাওয়া থেকে এ রোগ ছড়াতে পারে। সুতরাং এগুলো পরিহার করা উচিত। গুজবে কান দেবেন না। আমরা জানি, করোনায় মৃত্যুর হার ২ দশমিক ৪ ভাগের বেশি নয়। আমরা এও জানি, গুরুতর আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা শতকরা ১০-১৫ ভাগ। সুতরাং গুরুতর নয়, এমন রোগীর সংখ্যা ৮০-৮৫ ভাগ। চিকিৎসকরা ক্লোরোকুইন ব্যবহার করলে নিউমোনিয়ায় সুফল পাওয়া যায় বলে সংবাদ পাওয়া গেছে।
বিশেষ পরামর্শ-
১. যত বেশি মানুষ কোয়ারেন্টাইনে যাবেন তারা তত বেশি নিরাপদ থাকবেন। ২. নিজের বাড়িতেই থাকুন যদি অন্য কোনো করোনা রোগীর সঙ্গে আপনার সাক্ষাৎ বা ছোঁয়াছুঁয়ি হয়ে না থাকে। ৩. বাইরে যাওয়া কমানোর জন্য সপ্তাহে এক দিন বাজার করুন। মাস্ক ও হাত ধোয়ার কথা স্মরণে রাখবেন। সরকারকে ও স্বাস্থ্য বিভাগকে জনগণকে স্বাস্থ্য উপদেশ দিতে হবে। ৪. প্রয়োজনে চীনের পদক্ষেপগুলো বিবেচনায় আনতে হবে যাতে আমরা ভবিষ্যতে অনুশোচনা না করি। ৫. ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২২ মার্চ সারা ভারতে ‘জনতার কারফিউ’ ঘোষণা করেছিলেন, সকাল ৭টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বলা হয়েছে, টানা ১৪ ঘণ্টা সে দেশের ১৩০ কোটি মানুষ নিজ নিজ বাড়িতে স্বেচ্ছাবন্দিত্ব বরণ করেছেন। এর মাধ্যমে করোনাভাইরাস সম্পর্কে জনসচেতনতা বেড়েছে। আমাদের দেশের সরকারও এ ধরনের পদ্ধতি গ্রহণের বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে পারে। ৬. ভয় দেখানো যেখানে ক্ষতিকর, তেমনি অকারণে অতিসাহসিকতাও ক্ষতিকর হতে পারে। ৭. করোনাপীড়িত দেশসমূহ থেকে যারা বাংলাদেশে এসেছেন তাদের অনেককেই বিভিন্ন জেলায় কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে, তাদের নিবিড় পর্যবেক্ষণ করতে হবে। বিশেষ করে যারা রোগীর সঙ্গে ছিলেন তাদের মধ্যে কেউ কেউ রোগাক্রান্ত থাকতে পারেন, (হয়তো বা কম উপসর্গসহ)। এদের শনাক্ত করার ব্যবস্থা নিতে হবে। ৮. রোগ শনাক্তকারী কিটস পর্যাপ্ত পরিমাণে সংগ্রহ করতে হবে এবং প্রয়োজনে নিম্নতম স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ভবিষ্যতে সরবরাহ করতে হবে। ৯. সারা পৃথিবীতে যেভাবে করোনা সংক্রমণ ছড়াচ্ছে আমাদের চিকিৎসক ও নার্সদের প্রটেকশনব্যবস্থা আধুনিকায়ন করতে হবে। সম্ভাব্য রোগের জন্য বিছানাপত্র ইত্যাদির ব্যাপারে চীনকে অনুসরণ করা উচিত। ১০. পর্যাপ্ত ওষুধ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। গুরুতর রোগীর জন্য ভেনটিলেটর তৈরি অথবা আমদানির ব্যবস্থা করতে হবে। সাধারণত গুরুতর রোগীদের জন্য এ যন্ত্রের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি।
শেষ কথা : তিনটি উপসর্গ হলে ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। এগুলো হচ্ছে- জ্বরের সঙ্গে কাশি ও শ্বাসকষ্ট। শুধু হাঁচি-কাশি হলেই করোনা নয়, তার পরও আপনি যদি ভয় পেয়ে যান তাহলে ডাক্তারকে ফোন করতে দোষ কী?
লেখক : সাবেক রাষ্ট্রপতি ও রোগবিজ্ঞানের বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক।