পুঁজিবাজারে যখন কোনো বড় ধরণের সংকট হয়েছে, আপনি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের পক্ষে দাঁড়িয়ে এমন একটি সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যা প্রথমে সবাই সমালোচনা করলেও পরবর্তীতে সবাই স্বীকার করে আপনার সিদ্ধান্তই সঠিক। যেমন গত বাজেটে প্রত্যেক তালিকাভুক্ত কোম্পানিকে তার রিটেইনেড আর্নিংস এবং রিজার্ভ থেকে ক্যাশ ডিভিডেন্ড দিতে আইনের মাধ্যমে বাধ্যতামূলক করেছেন। আপনি ঠিকই বুজতে পেরেছিলেন, ম্যাক্সিমাম তালিকাভুক্ত কোম্পানি বিশেষ করে ব্যাংকের স্পনসর, পরিচালকেরা নিজেদের স্বার্থে এই প্রস্তাবের চরম বিরোধিতা করেছিল। কারণ এইসব পরিচালক সব সময়ই বোনাস শেয়ার দিতে পছন্দ করে তাদের নিজেদের স্বার্থে। এতে তারা নিজেরা লাভবান হয় এবং বিনিয়োগকারী সব সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আপনি ব্যাংক পরিচালকদের বলেছিলেন, শুধুমাত্র আপনাদের স্বার্থ দেখলে আমার হবে না, আমাকে লাখো বিনিয়োগকারীর স্বার্থ দেখতে হবে। আপনার সিন্ধান্তের সুফল পেতে শুরু করেছে বিনিয়োগকারীরা। এই পর্যন্ত যে কয়টি ব্যাংক ডিভিডেন্ড ঘোষণা করেছে, তাদের সবাই ক্যাশ ডিভিডেন্ড দিয়েছে। আপনার প্রতি লাখ বিনিয়োগকারী কৃতজ্ঞ।
গত ১৪ ও ১৫ জানুয়ারী, শেয়ারবাজার এ আস্থা এবং তারল্য সংকটের কারণে যখন বাজারে শেয়ার প্রাইস ফ্রি-ফল হচ্ছিলো, বাজার তখন ক্রেতাশূন্য হয়ে পড়েছিল, তখন আপনি বঙ্গবন্ধুকন্যা ১৬ই জানুয়ারী সকালে সংশ্লিষ্ট কয়েকজনকে নিয়ে পুঁজিবাজারে ফ্রি-ফল ঠেকানোর জন্য তৎক্ষণাৎ করণীয় কয়েকটি সিদ্ধান্ত দিয়াছিলেন, তাও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে।যেটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যারা পুঁজিবাজারের স্বার্থে জড়িত। তাদের আর্থিক সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ২০০ কোটি টাকা প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে অত্যন্ত সহজ শর্তে মাত্র ৫ শতাংশ সুদে ৫ বছরের জন্য ভালো শেয়ারে বিনিয়োগ করতে হবে, এই শর্তে এবং ৫ বছরের মধ্যে কোনো লস হলেও ওই প্রতিষ্ঠানকে কোনো মন্দ ঋণ সঞ্চিতি করতে হবে না। এটি ছিল অত্যন্ত একটি সঠিক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত পুঁজিবাজারের জন্য যা ইতিপূর্বে আর কখনো হয়নি। অনেক অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছে এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর এই টাকা নেয়ার এবং বিনিয়োগ করার ব্যাপারে তখন কোনোগুরুত্ব দেয়নি।এইটা ছিল মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর তারল্য সংকট নিরসনে আপনার একটি সঠিক সিদ্ধান্ত এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দীর্ঘ মেয়াদী বিনিয়োগে সুযোগকরে দিয়াছে। এটাই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় ছিল।
এরপর করোনাভাইরাস আতঙ্কে যখন ক্রমাগত শেয়ার বিক্রির চাপ, বিদেশী পোর্টফোলিওতে শেয়ার বিক্রির চাপ, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান মার্জিন রুল মেনে বিনিয়োগকারীর একাউন্ট এফোর্স সেল, সবমিলে লাখ বিনিয়োগকারী যখন দিশে হারা, তখন ১৮ই মার্চ মাননীয় অর্থমন্ত্রীকে নিয়ে আপনার দেয়া পুঁজিবাজার সংক্রান্ত সব সিদ্ধান্ত বিনিয়োগকারীকে উজ্জীবিত করেছে, ফ্রি-ফল বন্ধ হয়েছে। ইনশাআল্লাহ যাদেরকে ২০০কোটি টাকা প্রদান করা হয়েছে পর্যায়ক্রমে তারা বিনিয়োগ শুরু করেছে।ব্যাংকগুলো ক্যাশ ডিভিডেন্ড দেয়া শুরু করেছে এবং ক্যাপিটাল মার্কেট ইনশাআল্লাহ স্ট্যাবল হতে শুরু করেছে।
আমরা যারা পুঁজিবাজারের সাথে জড়িত, লিস্টেড কোম্পানির পরিচালকেরা, বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ সিকিউরিটিস এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন, স্টক এক্সচেঞ্জ, ব্রোকার-ডিলার, মার্চেন্ট ব্যাঙ্ক যদি সবাই সঠিক সময় সঠিক ভূমিকা পালন করে তাহলে ইনশাআল্লাহ একটি স্ট্রং এবং স্ট্যাবল পুঁজিবাজার গড়ে উঠবে, তাতে উপকৃত হবে সৎ উদ্দেক্তা যারা তাদের প্রতিষ্ঠানের জন্য পুঁজিবাজার থেকে টাকা সংগ্রহ করে এগিয়ে যেতে পারবে। ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে না নেওয়ায় ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমান হ্রাস পাবে। দেশ এবং অর্থনীতি উপকৃত হবে।
মাননীয় অর্থমন্ত্রী সরকার প্রধানকে পুঁজিবাজার ক্রাইসিস মুহূর্তে আপনার প্রাগমাটিক সুপারিশ দেয়ার জন্য, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। ব্যাংক ব্যবস্থা ভালো থাকলে পুঁজিবাজার ভালো থাকবে, ব্যাংকের সুশাসন ফিরিয়ে আনতে হবে। ব্যাংক পরিচালনা পরিষদ থেকে ব্যাংক ব্যবস্থাপনাকে সম্পূর্ণ আলাদা করতে হবে। দক্ষ ব্যাংক ব্যবস্থাপনাকে সম্পূর্ণ আলাদা করতে হবে। দক্ষ ব্যাংক ব্যবস্থাপনা টিম গড়ে তুলতে হবে। লোন দেয়ার ব্যাপারে পরিচালকদের হস্তক্ষেপ সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে। লিস্টেড কোম্পানি বিশেষ করে ব্যাংকের ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ স্বতন্ত্র পরিচালকের দায়িত্ব হচ্ছে ক্ষুদ্রবিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা করা। কোনো লিস্টেড কোম্পানি এবং এর পরিচালকদের ইচ্ছাই যেন স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দেয়া না হয়।
বর্তমানে আমরা যেটা দেখতে পাই, বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের স্বতন্ত্র পরিচালক এই প্রতিষ্ঠানের স্পনসর পরিচালকদের ইচ্ছা অনিচ্ছাই নিয়োগ দেয়া হয়ে থাকে। এতে এই স্বতন্ত্র পরিচালকরা ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা করতে পারে না। এতে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কোনো সুশাসন থাকে না। সবাইকে বুঝতে হবে, ব্যাংকের পরিচালকদের টাকায় ব্যাংক পরিচালিত হয় না, ব্যাঙ্ক পরিচালিত হয় ডিপোসিটরদের টাকায়। অতএব , ডিপোজিটরদের টাকা রক্ষা করার জন্য মাননীয় অর্থমন্ত্রীকে অত্যন্ত কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। যারা ইচ্ছাকৃত খেলাপি তাদেরকে আইনের আওতায় এনে কঠোরভাবে বেবস্থা নিতে হবে।দেউলিয়া আইন যুগোপযুগী করতে হবে। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের লাইফস্টাইল হাত দিতে হবে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে যেভাবে খেলাপিঋণের বিরুদ্ধে একশন হচ্ছে, ঠিক সেইভাবে ব্যাবস্থা নিতে হবে। ভারতের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারাম যে পক্রিয়ার মাধ্যমে খেলাপিঋণ আদায় করেছেন এবং মার্জারের মাধ্যমে দুর্বল ব্যাঙ্কগুলোকে শক্তিশালী করে, ডিপোজিটরদের আস্থা অর্জন করেছেন সেভাবে অগ্রসর হতে অনুরোধ করবো।
ব্যাংক ব্যাবস্থাপনাকে যদি সুশাসনে আনা যায়, খেলাপি আদায় করা যায়, ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে যদি দীর্ঘ মেয়াদিঋণ বন্ধ করে উদ্যোক্তাদেরকে যদি পুঁজিবাজারে নিয়ে আসা যায় তাহলে ব্যাংকও টিকবে, পুঁজিবাজারও ভালো হবে। এই মুহূর্তে মাননীয় অর্থমন্ত্রী যে কাজটি পুঁজিবাজারের স্বার্থে জরুরিভাবে করতে পারেন সেটি হলো কোম্পানি বাইব্যাক আইন। অর্থাৎ যে সকল ব্যাংক অত্যন্ত স্ট্রং যাদের রিসার্ভ ভালো, গ্রোথ ভালো, ইপিএস ভালো, সে সকল কোম্পানি বাজার যখন খারাপ থাকে, তখন কোম্পনি যদি মনে করে, তার শেয়ারটি এই দামে ক্রয়-বিক্রয় ঠিক না, তখন কোম্পানি তার রিসার্ভ এবং রিটেইনেড আর্নিংস থেকে বাজার শেয়ার কেনার ঘোষণা দিয়ে শেয়ারটি বাজারে স্ট্যাবল করতে পারে এবং দরপতন ঠেকাতে পারে। এতে বিনিয়োগকারী উপকৃত হয়। সেই কোম্পানির উপর বিনিয়োগকারীর আস্থা অনেক বেড়ে যায়। সকল উন্নত দেশের পুঁজিবাজারে এই আইন প্রযোজ্য আছে। মাননীয় অর্থমন্ত্রীকে অনুরোধ করবো, জরুরিভাবে এই আইনটি অবিলম্বে একটি অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে কার্যকরী করে পরবর্তীতে মহান জাতীয় সংসদে পাস করে নেয়ার জন্য অনুরোধ করছি।এটা পুঁজিবাজারকে স্ট্যাবল করতে অংকে সাহায্য করবে।
মাননীয় অর্থমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রণালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ সিকিউরিটিস এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ, ব্যাংকার্স এসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ, এসোসিয়েশন অফ ব্যাংকার্স অফ বাংলাদেশ, স্টকডিলার, ব্রোকার আমরা যে যেখানেই আছি, বিশেষ করে আমরা যারা পুঁজিবাজার এবং অর্থিনীতি নিয়ে কথা বলি, আমরা আমাদের যার যার অবস্থান থেকে পুঁজিবাজারকে স্ট্যাবল করার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একসাথে কাজ করি। আমরা যেন গুজব ছড়িয়ে পুঁজিবাজারকে ক্ষতিগ্রস্ত না করি। ইনশাআল্লাহ, আমরা যদি যার যার অবস্থান থেকে একসাথে কাজ করি তবে পুঁজিবাজার অবশ্যই স্ট্যাবল হবে, লাখ বিনিয়োগকারী, উদ্যোক্তা, শিল্পের উদ্যোক্তা এবং অর্থনীতি লাভবান হবে।
আমি একটি স্মৃতিসারণ করতে চাই, আপনারা সবাই জানেন ২০০৯-২০১০ আমি যখন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রেসিডেন্ট ছিলাম তখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একটি সিদ্ধান্ত আমাকে এবং দেশবাসীকে অনুপ্রাণিত করেছিল। তা হলো, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক যখন আমাদের এখানকার কোনো কোনো ব্যক্তি বিশেষের ষড়যন্ত্রে পদ্মা সেতুতে টাকা দেয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। তখন আমাদের দৃঢ় চেতা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশের স্বার্থে, সাধারণ জনগণের স্বার্থে আল্লাহর উপর ভরসা করে জনগনকে সাথে নিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তখন অনেক বুদ্ধিজীবী এবং অর্থনীতিবিদ এটাকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একটি ইম্যাচিউরড এবং আবেগি সিদ্ধান্ত বলেছিলেন। কিন্তু আমি সেই দিন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে এই সিদ্ধান্তের জন্য স্বাগত জানিয়ে একটি প্রেস কনফারেন্সের মাধ্যমে দেশি-বিদেশিবিনিয়োগকারীর পক্ষ থেকে, বিশেষ করে প্রবাসী বাংলাদেশিদের পক্ষ থেকে অর্থায়ন করার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। বাস্তবতা হলো, পদ্মাসেতু দৃশ্যমান এবং শেষ পর্যায়ে।
মো: রকিবুর রহমান
সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বর্তমান পরিচালক
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ লিমিটেড