শিশুর জন্মের শুরুতেই সে তার মাতৃগর্ভে যেভাবে বড় হতে থাকে তাতে দেখা যায় বিশ্বের সব মাতৃগর্ভে সব ধরনের সুযোগ সুবিধা এক এবং অভিন্ন। শিশুর জন্মের শুরুতেই শুরু হয় চ্যালেঞ্জ। প্রথম চ্যালেঞ্জ তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে শেখা। মাতৃগর্ভে শিশু ৩৭.৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে বড় হতে থাকে। শিশুর পুষ্টি মায়ের থেকে পেয়ে থাকে সমপরিমাণে। এখন যে শিশুটির জন্ম বাংলাদেশের গ্রামের পরিবেশে হচ্ছে আর যে শিশুটির জন্ম কোনো প্রাইভেট হাসপাতালে হচ্ছে তাদের জন্মের শুরুতে রয়েছে বিরাট চ্যালেঞ্জ। কারণ নামিদামি হাসপাতালের রুম টেম্পারেচার মাতৃগর্ভের তাপমাত্রার সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করা রয়েছে। যার ফলে ক্ষেত্রবিশেষে বাচ্চার ডেলিভারির সময়ই জীবনের চ্যালেঞ্জ শুরু। তারপর যদি তাপমাত্রা প্রচণ্ড ঠাণ্ডা বা প্রচণ্ড গরম হয় এবং যদি তাপমাত্রার ভারসাম্য রক্ষণাবেক্ষণ করার মতো সুযোগ না থাকে তবে জন্মের শুরুতেই শিশুর জীবনে চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা শুরু হয়।
এতক্ষণ পর্যন্ত কে হিন্দু, কে মুসলিম, কে খ্রিষ্টান, কে বৌদ্ধ, কে ইহুদি, কে গরিব, কে ধনী তা নিয়ে কোনো কথা নেই। কিন্তু জন্মের পরপরই পারিপার্শ্বিকতার কারণে একের পর পরিবর্তন এবং পরিবর্ধন শুরু হতে থাকে। কিছু পরিবর্তন পূর্বনির্ধারিত। আর কিছু পরিবর্তন অ্যাডজাস্টবল যেমন ইচ্ছে করলে বা সামর্থ্য থাকলে শিশুর ডেলিভারি তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। শিশুকে দারিদ্র্মুক্ত করতে হলে কোনো বড় লোকের পরিবারে পালিত পুত্র হিসেবে দেওয়া যেতে পারে, ধর্মের পরিবর্তনও করা সম্ভব যদি হিন্দু শিশুকে প্রথম থেকেই মুসলিম করতে কেউ চায় তাহলে যে কোনো মুসলিম পরিবারে পালিত পুত্র হিসাবে দেওয়া যেতে পারে। এসব পরিবর্তনে রয়েছে চ্যালেঞ্জ।
এখন প্রশ্ন আমরা কি চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে প্রস্তুত? নাকি যেখানে যেভাবে আছি তার উপর অ্যাডজাস্ট করে চলতে হবে বা যেমন চলছে তেমন করে চলতে হবে? কিছু কিছু পরিবর্তনে শুরু থেকে ‘রাইট ফার্স্ট টাইম কনসেপ্ট-এর’ ব্যবহার করতে পারি। এখন প্রশ্ন হতে পারে ’রাইট ফার্স্ট টাইম’ কী এবং যা এখন ’রাইট ফার্স্ট টাইম’ তা পরে যে পরিবর্তিত হবে না তারই বা কি নিশ্চিত গ্যারান্টি রয়েছে? সচেতন জাতি সব সময় খোঁজে সমাধান যার ফলে অ্যাডজাস্ট করে চলা শিখতে হবে এবং ‘রাইট ফার্স্ট টাইম কনসেপ্টের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে ‘রাইট ফ্রম মি’। সব সময় নিজ থেকে সঠিক এবং শুরু থেকেই সঠিক হবার মন মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে।
মানুষ হিসেবে আমাদের যে দায়িত্ব-কর্তব্য সেটা কি আমরা সঠিকভাবে পালন করতে সক্ষম হয়েছি পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে? এক কথায় বলা যেতে পারে, না। কারণ মাতৃগর্ভে শিশুর সময়টিতে আমাদের সরাসরি কোনো ইন্টারফেয়ারস নেই, কোনো তুলনা নেই। শিশু তার মতো করে ধীরে ধীরে গ্রো হয়।
জন্মের শুরুতেই যতো ঝামেলা, বোঝা তার উপর আমরা চাপিয়ে দিতে থাকি। এই চাপিয়ে দেবার পুরো দায়িত্ব আমাদের (বাবা-মা, পরিবেশ, পরিস্থিতি, স্কুল, কলেজ, সমাজ, রাষ্ট্র ইত্যাদি)। এখন আমাদের নিজেদেরই রয়েছে গোড়ায় গলদ, কারণ যাদের (শিশুদের) সমস্যা নিয়ে আমি লিখছি, আমরা নিজেরাও কোনো এক সময় এদের মতো শিশু ছিলাম। আমাদেরই লালন পালন সঠিকভাবে হয়নি (রাইট ফার্স্ট টাইম এবং রাইট ফ্রম মি)।
আমি মোটামুটি অনেক কিছু ভেবেছি, অনেক কিছু দেখেছি। সব কিছু ঘাটাঘাটির পর দেখি শিশুর জন্মের শুরুতেই ন্যাটা জড়িত। যত বেশি শাস্ত্র-গ্রন্থ পড়ছি ততই দূরে সরে যাচ্ছি। মানুষ হিসেবে কী করছি? সেটাই ভাবছি এখন! কেন যেন মনে হচ্ছে আমরা শিশুকে শুরু থেকেই বদ্ধ খাচায় আটকে ফেলছি! আমাদের খুব তাড়া কীভাবে এবং কত তাড়াতাডি তাদের জীবন গড়তে হবে সেটা নিয়ে।
আমরা বয়স্করা নিজেদের পাপ-পূণ্য, ভালো-মন্দ, জানা-অজানা সব কিছুর বোঝা শিশুদের উপর চাপিয়ে দিচ্ছি। যার ফলে তাদের নিজেদের যে একটি মতামত গড়ে উঠবে সে সুযোগ তারা কখনও পাচ্ছে না যেমনটি আমরাও পাইনি। অথচ মনোবিজ্ঞানী থেকে শুরু করে কত মনীষীরই না জন্ম হয়েছে, কিন্তু কই কেউ তো বিষয়টি নিয়ে ভাবছেন না?
কেন শিশুর জন্মের পর তাদের কমপক্ষে আরও দুই থেকে পাঁচ বছর সময় দেওয়া হচ্ছে না যাতে করে তারা তাদের নিজেদের মতো করে একটি প্লাটফর্ম তৈরি করতে পারে? কেন এত তাড়া? এই তাড়ার ফলাফল যা এ অবধি পেয়েছি বা পাচ্ছি তাতে কি তেমন কোনো ক্রিয়েটিভ সাড়া পাওয়া সম্ভব হয়েছে?
আমার মনে হয় আমরা কোথাও কিছু মিস করছি। যে ফুল আঁধার রাতে ফোটে সে ফুল সকাল হতেই ঝরে যায়। যে চিন্তা অন্ধকারে আসে সেটা আলো উঠার আগেই বিলীন হয়ে যায়। কিন্তু কেন তাকে নিয়ে আমরা ভাবিনে?
আমি একটি বিষয়ে বেশ ভাবছি সেটা হলো গত ২০-২৫ বছর প্রযুক্তির পেছনে যে সময় ব্যয় করা হয়েছে তার ১০% সময় ব্যয় করা হয়নি অন্যান্য বিষয়ের উপর। আমরা গোটা বিশ্বের মানুষ একদিকে চলতে পছন্দ করি ঝরনার মতো। ঝরনা পাহাড় থেকে ঝরে নিচের দিকে বয়ে সরাসরি গিয়ে মেশে সাগরে।
কিন্তু আমরা ঝরনা নই, আমরা হিউম্যান, জন্মের শুরুতে জীবন গঠনে যে চ্যালেঞ্জ লক্ষণীয় সেটাকে কেন সঠিকভাবে ম্যানেজ করতে আমরা ব্যর্থ হচ্ছি? কারণ ছোটদের উপর বড়দের প্রভাব, বিশেষ করে শিশুর উপর আমাদের অকর্ম, কুকর্ম, ব্যর্থতা, সফলতা চাপিয়ে দেবার ফলে নতুন ইনোভেটিভ চিন্তায় বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এর থেকে রেহাই পেতে দরকার শিশুদের উপর অত্যাচার বন্ধ করা। তাদেরকে তাদের মতো করে বড় হবার সুযোগ করে দেওয়া। শিশুর ওপর কোনো কিছুই জোর করে চাপিয়ে দেওয়া উচিত নয়।
আমাদের সমাজে সন্তানের অভিভাবক সন্তান জন্মের আগেই অনাগত সন্তানদের নিয়ে নিয়ত তথা দৃঢ়সংকল্প করেন যে সন্তানকে হাফেজ, আলেম বা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ইত্যাদি বিশেষ কিছু বানাবেন।
ভালো কাজের জন্য নেক নিয়ত বা সদিচ্ছা থাকা ভালো। তবে এসব ক্ষেত্রে বদ্ধপরিকর হওয়া ঠিক নয়। অনেককে দেখা যায় তাঁর লক্ষ্য পূরণে শিশুর রুচি, প্রকৃতি, পছন্দ, ইচ্ছা এবং সামর্থ্যের বাইরে বোঝা চাপিয়ে দেন। আসলে আমাদের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত সন্তানকে তার মতো করে ভাবতে শেখানো।
সন্তান জন্মের আগে বা পরে তাকে হাফেজ, আলেম বা বিশেষ কিছু বানানোর নিয়ত না করে বরং সে যা হতে পারবে তাকে তা-ই বানাতে সাহায্য করা উচিত।
শিশুর উপর শিক্ষা চাপিয়ে দেওয়া ও শাস্তি দেওয়া সামাজিক অপরাধ। আমাদের সমাজে অধিকাংশ শিশু শারীরিক শাস্তি ও মানসিক নির্যাতনের শিকার।
এটি সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়ের কুফল। শিশুর অভিভাবকেরা নিজেরা এর সঙ্গে সরাসরি জড়িত এবং তাঁরা শিক্ষকসহ অন্যদের এ বিষয়ে উৎসাহ প্রদান ও সহযোগিতা দান করে থাকেন। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। কারণ মাসুম (নিষ্পাপ) শিশুদের শাসনের নামে এমন শাস্তি প্রদান সম্পূর্ণ হারাম। শিশুর জন্য চাই আনন্দঘন শিক্ষার পরিবেশ ও আদর্শ শিক্ষক।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খেলাধুলা ও আনন্দ-বিনোদনের আয়োজন থাকা উচিত। শুধু পাঠদান বা অধ্যয়ন ও পুস্তক মুখস্থ করার নামই শিক্ষা নয়। শিক্ষা হলো বিশ্বাস ধারণ, আশা লালন ও ভালোবাসা বিতরণের অনুরাগ সৃষ্টি করা। নৈতিক শিক্ষাই আসল শিক্ষা। সত্যতা, সততা, সহিষ্ণুতা, মানবিকতা ও পরোপকার হলো সু-শিক্ষার দর্শন। তারা কী শিখবে এটা নির্ধারণ না করে বরং জানুন তারা কী এবং কেন শিখতে বা জানতে চায়। আমাদের দায়িত্ব পুশ বা পুল করা নয়। আমাদের দায়িত্ব বিশ্বাস ধারণ, আশা লালন ও ভালোবাসা বিতরণের অনুরাগ সৃষ্টি করা। দ্যি সুনার দ্যি বেটার।
লেখক: সাবেক পরিচালক, প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট