খেলাধুলার প্রতিযোগিতা তো সর্বজনস্বীকৃত। খেলাধুলায় দুটি দলের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সৃষ্টি হয়, সৃষ্টি হয় বিনোদনের, গড়ে উঠে উত্তেজনা, উদ্দীপনা এবং সবশেষে জয়-পরাজয়ের মধ্য দিয়ে শেষ হয় তার বহিঃপ্রকাশ। বিজয় অর্জনে দরকার সাহসিকতার এবং খেলতে দরকার সহযোগিতার। যুগ যুগ ধরে খেলাধুলোর মধ্য দিয়ে নির্ধারিত হয় সেরাদের মধ্যে সেরা যাকে বলে বিশ্বসেরা। আবার কখনও বা বিশ্বরেকর্ড ধারণকারী হিসেবে অনেকের নাম ফুটে উঠে।
পৃথিবী সৃষ্টির পর শুধু দৌড়ের উপর কতবার বিশ্বরেকর্ড হয়েছে তা-কি আমরা জানি, বা কতবার তা ভেঙ্গে নতুন রেকর্ডের সৃষ্টি হয়েছে? তবে এ মুহূর্ত পর্যন্ত উসাইন বোল্টের রেকর্ডই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ রেকর্ড। অতিসত্ত্বর চীনে শুরু হতে যাচ্ছে উইন্টার অলিম্পিক, দেখা যাক এমন কেউ আছে কি বিশ্বে যে এযুগের রেকর্ড ভঙ্গ করে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করে?
আজ আমি টেনিসের জগৎ এবং তার রেকর্ড এবং ভবিষ্যৎ রেকর্ড নিয়ে আলোচনা করব। অন্যান্য খেলাধুলোর মতো টেনিসেও বিশ্বরেকর্ড বা খ্যাতি অর্জন করা সম্ভব।
কথায় বলে ‘everything is impossible until someone makes it possible’ যেমন পৃথিবী সৃষ্টির পর পুরুষদের মধ্যে প্রথম যিনি টেনিসে সবচেয়ে বেশি গ্রান্ড স্ল্যাম (গ্র্যান্ড স্ল্যাম হলো চারটি স্ল্যাম টুর্নামেন্ট, যে টুর্নামেন্টগুলোকে বেশি পয়েন্ট, ঐতিহ্য, প্রাইজমানি ও জনপ্রিয়তার ভিত্তিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ টেনিস ইভেন্ট হিসেবে বিবেচনা করা হয়। গ্র্যান্ড স্ল্যামকে মেজরও বলা হয়। গ্র্যান্ড স্ল্যামগুলো হলো অস্ট্রেলিয়ান ওপেন, ফ্রেঞ্চ ওপেন, উইম্বলডন এবং ইউএস ওপেন) জয়লাভ করেন তিনি হলেন রজার ফেডেরার কিন্তু মজার ব্যাপার হলো বর্তমানে তিনজন বিশ্বের সেরা খেলোয়াড় ২০টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম শিরোপা অর্জন করেছেন এবং তারা তিনজনই টেনিসের জগতে কিংবদন্তি চলমান খেলোয়াড়। তাদের তিন জনেরই নতুন বিশ্ব রেকর্ড তৈরির সম্ভাবনা রয়েছে। এবারের বছরের শুরুতে যে গ্র্যান্ড স্ল্যামটি শুরু হয়েছে সেটা হলো অস্ট্রেলিয়ান ওপেন। ভাবতেই অবাক লাগে একবার নয়, দুই বার নয়, ২০ বার গ্র্যান্ড স্ল্যাম বিজয়ী বর্তমান তিনজন রয়েছে একই সারিতে এবং তিনজনই অ্যাক্টিভ খেলোয়াড় এবং তাঁরা হলেন রজার ফেডেরার, রাফায়েল নাদাল এবং নভাক জোকোভিচ। এবারের অস্ট্রেলিয়ান ওপেনে এই তিন জনের মধ্যে শুধু নাদাল খেলছেন। রজার ইনজুরির কারনে যোগ দিতে পারেন নি, অন্যদিকে জোকোভিচ করোনা ভ্যাকসিন না নেবার কারনে অস্ট্রেলিয়ান সরকার তাঁর ভিষা বাতিল করে দেয়।
যেহেতু খেলাধুলোয় রয়েছে প্রতিযোগিতা সেহেতু পুল এবং পুশ কনসেপ্টটি ভীষণভাবে কাজ করে এখানে, যার ফলে টেনিসের জগতে বিশ্বের তিনজন নাম করা সুপারস্টার রজার ফেডেরার, রাফায়েল নাদাল এবং নভাক জোকোভিচ পরস্পর পরস্পরকে সারাক্ষণ পুল এবং পুশ করার কারণেই এমনটি অবিরল ঘটনা ঘটেছে।
বর্তমানের টেনিসে যা বেশি লক্ষণীয় তা হলো শারীরিক যোগ্যতা। যেহেতু রজারের বয়স চল্লিশের উপরে শারীরিক দিক দিয়ে আগের মতো পারদর্শিতা দেখাতে পারছেন না। তারপরও শুধু পদবির কারণে নয়, তাকে টেনিস কোর্টে সবাই দেখতে চায়, কারণ তিনি কিংবদন্তী এবং টেনিসে সেরাদের মধ্যে সেরা।
নাদালের বয়সও কম নয়, তারপর তার যে খেলার স্টাইল তাতে শারীরিক দক্ষতা বেশি গুরুত্বপূর্ণ, সেক্ষেত্রে বলা কঠিন কী অবস্থা তার। তবে জোকোভিচের বর্তমান খেলার কৌশল, শারীরিক দক্ষতা এবং খেলার পারফরমেন্স দেখে মনে হচ্ছে তিনিই ভবিষ্যৎ টেনিসের সর্বকালের সর্বশেষ বিশ্ব গ্রান্ড স্ল্যাম রেকর্ডধারী হয়ে থাকবেন কমপক্ষে কয়েক যুগেরও বেশি সময় ধরে। কতদিন এই রেকর্ড ধরে রাখবেন সেটা নয়, প্রশ্ন এখন কত বছর ধরে রাখবেন? বর্তমান নতুন প্রজন্মদের খেলা দেখে যতটুকু মনে হচ্ছে তাতে বলতে চাই বার বার একই খেলোয়াড় সেরা ট্রফি জয়ী হবে বলে মনে হচ্ছে না। কারণ প্রতিযোগিতার যুগে বলা মুশকিল কে, কখন কাকে, কীভাবে পরাজিত করে!
আমি কিছুদিন আগে লিখেছি টেনিস এবং রজার ফেডেরার এবং জোকোভিচকে নিয়ে। যেমন উল্লেখ করেছি যা-ই হোক না কেন, আর যে যা-ই ভাবুন না কেন কিছুই যায় আসে না। কারণ রজার ফেদেরার টেনিস ক্যারিয়ারও একদিন শেষ হবে, প্রশ্ন কবে, কখন এবং কোথায়? তবে রজার ফেদেরারের টেনিসের ওপর যে আসক্তি তা শুধু তার খেলা দেখলেই বোঝা যায়।
রজার শুধু বিশ্বের সেরা টেনিস খেলোয়াড়ই নন, তিনি একটি আনন্দঘন মুহূর্ত। তিনি সবার হৃদয়ের এক ভালোবাসা। একদিন টেনিস জগৎ তাকে ছাড়া টেনিস খেলবে, হয়তো তার কথাও ভুলে যাবে সময়ের সঙ্গে। নতুন চ্যাম্পিয়নের জন্ম হবে ঠিকই, তবে আমার মনে হয় রজার ফেদেরার সবার হৃদয়ে টেনিসের আইকন হয়ে বেঁচে থাকবেন দুনিয়াতে।
তবে যে বিষয়টি এখন তুলে ধরব যা হয়ত নতুন ইতিহাসের এক পূর্বাভাস। সেটা আবার কী? রজার বা নাদাল যত সহজে বিশ্ববাসীর মন জয় করেছে জোকোভিচের পক্ষে সেটা ততো সহজ হয়ে উঠেনি। কারণ একটাই সেটা হলো জোকোভিচের জন্ম হয়েছে ইস্ট ব্লকে। পশ্চিমা দেশগুলো খুব সহজে ইস্ট ইউরোপের কারও প্রতিভা মেনে নিতে এখনও অভ্যস্ত হয়নি, বিশেষ করে টেনিসের উপর।
কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে বলে মনে হয় না। কারণ জোকোভিচ ২০টি গ্রান্ড স্ল্যাম শিরোপা জিতে যদি ২১তম শিরোপাটা অর্জন করতে পারে তখন ক্ষণিকের তরে সব ভুলে বিশ্ব তাকেই বরণ করবে সর্বকালের সেরা টেনিস খেলোয়াড় হিসাবে। জোকোভিচ যদি এভাবে খেলতে থাকেন তাহলে কম করে হলেও আরও ৪-৬টা গ্রান্ড স্ল্যাম শিরোপা অর্জন করবেন বলে আমি বিশ্বাস করি। প্রশ্ন কে, কবে, কখন তাকে ব্রেক করে নতুন বিশ্ব রেকর্ড সৃষ্টি করবে? লিখাটিতে সব খেলার মাঝে টেনিস কেন এত বেশি করে উঠে এল? এমন প্রশ্ন হতেই পারে। আমার ছেলে-মেয়ে এর ওপর ডেডিকেটেড এবং মোটিভেটেড বিশেষ করে আমার ছেলে জনাথান মৃধা। খুব ইচ্ছে ছিল সে বাংলাদেশের হয়ে টেনিস খেলবে, সেখানে বাংলার পতাকা উড়বে, কিন্তু রাষ্ট্রের সহযোগিতার অভাবে সুইডেনের হয়ে খেলে চলেছে।
এখন আমার ভাবনা থেকে যেটা বলতে চাই সেটা হলো আমরা কবে লাল সবুজের পতাকা দেখতে পাবো বিশ্বঙ্গণে। কীভাবে সেটা সম্ভব! নতুন করে ইনোভেটিভ হতে হবে তার জন্য? শুধু কানাডার পরিকাঠামো ফলো করলেই আমার বিশ্বাস খেলাধুলোর ওপর বিশেষ করে ফুটবলের সফলতা আনা সম্ভব। যেদেশে বাংলাদেশের অর্থে বেগম পাড়া গড়ে উঠেছে এবং যারা এর পেছনে জড়িত তারা অতি সহজে কানাডাকে ফলো করতে পারে। কানাডা লেখাপড়ার সঙ্গে খেলাধুলোর গুরত্ব দিয়েছে এতবেশি যে তাদের প্রতিটি জাতীয় একাডেমি থেকে সৃজনশীল খেলোয়াড তৈরি করছে গত দশ বছর ধরে। বর্তমান বিশ্বের সকল খেলাধুলোয় কানাডার অবদান লক্ষণীয়।
আমরা ফুটবল হ্যান্ট একাডেমির কাজ শুরু করেছি। ধীর গতিতে চলছে আমাদের কাজ রাষ্ট্রের পরিকাঠামোর দুর্বলতার অভাবে। লেখাপড়ার সঙ্গে খেলাধুলার সম্পৃক্তি ঘটাতে না পারলে কোয়লিটি সম্পন্ন জীবন, শিক্ষা এবং ফুটবলকে বিশ্বঙ্গনে আনা সম্ভব হবে না।
জন্মের সূচনালগ্ন থেকে বাংলাদেশ এক স্বপ্নতাড়িত দেশ। স্বাধীন দেশ হিসেবে সোনার বাংলা গড়ার যে স্বপ্ন আমরা দেখেছিলাম, স্বাধীনতার এত বছর পরেও সেই স্বপ্ন অর্জিত হয়নি। এটা অনস্বীকার্য যে, দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য একটা দক্ষ ও সুশিক্ষিত নাগরিকসমাজ গঠন করতে হলে যে কার্যকর শিক্ষা, কর্ম, খেলাধুলা সহ নৈতিকতার প্রয়োজন আমরা তা এখনো গড়ে তুলতে সক্ষম হইনি। দেশের প্রতিটি উন্নয়ন-রূপকল্পের ভিত্তিমূলেই রয়েছে বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নের প্রতিধ্বনি। কিন্তু স্বপ্নকে বাস্তবে রূপান্তর করতে সবার সক্রিয় উদ্যোগের প্রয়োজন।
২০৩৪ সালের ফুটবল বিশ্বকাপে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হওয়া সম্ভব। সম্ভব হবে না এমনটি না ভেবে বরং ভাবতে হবে কিভাবে এই স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করা যায়। প্রিয় দেশবাসী আসুন শুধু চার বছর পরপর একমাস শয়নে স্বপনে বা জাগরণে নয়, এবার সত্যিকারে ফুটবল খেলি এবং আসুন খেলি প্রতিযোগিতার মাঝে।
এই মুহূর্তে দূর পরবাস থেকে আমি ৬৮ হাজার গ্রামের কথা ভাবছি। ভাবছি ৬৪টি জেলার কথা। আমি নতুন প্রজন্মের কথা ভাবছি, আমি সোনার বাংলার কথা ভাবছি। আমি মানুষের কথা ভাবছি। আমি তোমাদের কথা ভাবছি। তোমারা চেষ্টা করলে অবশ্যই পারবে। চলছে এখন জাগ্রত জনতার একান্ত প্রচেষ্টা সোনার বাংলা গড়ার। আমার মতো তোমাদের মাঝে নতুন চেতনার বন্যা আসুক। তোমরাও একদিন অনেক বড় হবে আর তোমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্যে আমার মতো করে এমনি আশার কথা শোনাবে এবং সেটাকে বাস্তবে রূপ দিতে ঝাপিয়ে পড়বে। আমি ক্রীড়া জগতে লাল সবুজের পতাকা উড়তে দেখতে চাই। আমি শুনতে চাই আমার জাতীয় সঙ্গীত আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।
লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন।rahman.mridha@gmail.com