বার্ষিক বাজেট প্রণয়নে অর্থ মন্ত্রণালয় চলতি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, সরকারের ভিশন-২০২১ ও ২০৪১ এবং জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য ২০৩০ সামনে রেখে ৮ শতাংশের অধিক জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নিয়ে অর্থ বরাদ্দ এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর নির্ধারণ করবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু গত জানুয়ারি থেকে বিশ্বব্যাপী নভেল করোনাভাইরাসের (কভিড-১৯) প্রাদুর্ভাব ও বিস্তৃতির ফলে সব দেশেই অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট ও চাহিদা বদলেছে, যা আমাদের দেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। প্রায় দুই মাস ধরে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর লকডাউনে থাকা, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, পেশাজীবী ও শ্রমিক এবং প্রান্তিক চাষীদের কর্মহীন হয়ে পড়ার প্রেক্ষাপটে এবারের বাজেটে কর্মসংস্থান, শিল্প ও কৃষি খাতে উৎপাদন, সার্ভিস সেক্টর সচল করাসহ দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতিসঞ্চার করার মতো উপাদান থাকতে হবে। সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতার আলোকে আরেকটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে লক্ষ রাখতে হবে, তা হলো স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ বাড়ানো এবং সে বরাদ্দ ব্যয়ের দক্ষ কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা।
এরই মধ্যে আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী ও আন্তর্জাতিক সংস্থা চলতি (২০১৯-২০) অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছে। আবার কেউ কেউ আমাদের প্রবৃদ্ধি ২০২১ সালে প্রায় ৯ শতাংশে উঠে যাওয়ার ভবিষ্যদ্বাণীও করছে। তবে একথা স্বীকার্য যে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নিজস্ব গতিতে চললে দেশের প্রায় ১৭ কোটি মানুষের অভ্যন্তরীণ ভোগ চাহিদা এবং দেশীয় শিল্প উৎপাদন ও আমদানির মাধ্যমে কর্মসংস্থান ও সরবরাহ চেইনের সদ্ব্যবহারের ফলে অর্থনীতির নিজস্ব শক্তিতেই প্রবৃদ্ধি হবে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে চলতি বছর প্রবৃদ্ধি যাই হোক, আগামী অর্থবছরে অন্তত ৬-৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির আশা করাও মন্দ নয়।
২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে যে বরাদ্দ রাখা হয়েছিল, তা মার্চ থেকে জুন ২০২০ পর্যন্ত অর্থনীতির আংশিক স্থবিরতা ও লকডাউনের কারণে বেশকিছু টাকা অব্যয়িত থেকে যাবে। বছরের শেষ প্রান্তে এসে তাড়াহুড়া করে অবিবেচনাপ্রসূত খরচেরও প্রয়োজন নেই। তবে স্বাস্থ্য, খাদ্য, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন, সমাজকল্যাণ প্রভৃতি মন্ত্রণালয়ের জন্য প্রয়োজনে অতিরিক্ত বরাদ্দ দিয়ে বর্তমান চাহিদা পূরণ করতে হবে। এসব বিবেচনায় নিয়ে চলতি বছরের সংশোধিত বরাদ্দ ও সম্ভাব্য খরচের তুলনায় আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট কমপক্ষে ৫০-৬০ হাজার কোটি টাকা বেশি হওয়া প্রয়োজন হবে। শোনা যাচ্ছে আগামী বাজেট হতে পারে ৫ লাখ ৬০ হাজার থেকে ৫ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার মতো। এরই মধ্যে এডিপি ঘোষণা করা হয়েছে ২ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা। লক্ষ রাখতে হবে চালু প্রকল্পগুলোয় যাতে অর্থসংস্থানের কমতি না হয়। বৈশ্বিক মন্দার সময় সরকারি ব্যয় সচল রাখা কিংবা প্রয়োজনে বাড়িয়ে দেয়া একটি উত্কৃষ্ট পন্থা।
স্থবির অর্থনীতিকে সচল করা এবং ক্ষতিগ্রস্ত খাতগুলোকে সহায়তা করার জন্য সরকার এরই মধ্যে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। খাতভিত্তিক এসব প্রণোদনা প্যাকেজের প্রায় সবটুকুই হলো সহজ শর্তে ঋণ প্রদান। ব্যাংক বন্ধ থাকার কারণে এসব ঋণ বিতরণ কার্যক্রম এখনো শুরু করা সম্ভব হয়নি। ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু হলেও রয়েছে যোগ্য ঋণগ্রহীতা নির্বাচনের গুরুত্বপূর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। লক্ষ রাখতে হবে দীর্ঘমেয়াদি ঋণখেলাপি উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীরা যাতে এ প্রণোদনা প্যাকেজের অপব্যবহার না করেন। কৃষি, পোলট্রি ও ডেইরি শিল্প এবং মাইক্রো ও এসএমই খাতের প্রণোদনা ঋণ প্রদান যত দ্রুত শুরু করা যায়, সে উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।
রফতানিমুখী শিল্প যেমন তৈরি পোশাক ও টেক্সটাইল, চামড়া, পাট ও পাটজাত দ্রব্য প্রস্তুত শিল্পের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ চাহিদাভিত্তিক শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জন্য প্রণোদনার প্রয়োজন হতে পারে। কারা এ প্রণোদনা পেতে পারেন, তা নির্বাচনের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, ব্যবসায়ী সংগঠন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও কমার্শিয়াল ব্যাংকের প্রতিনিধির সমন্বয়ে খাতভিত্তিক কমিটি গঠন করে অবিলম্বে কাজ শুরু করতে হবে। প্রণোদনা প্যাকেজের অর্থসংস্থানের কাজটি বাংলাদেশ ব্যাংক এর প্রসারিত আর্থিক নীতি অবলম্বনের মাধ্যমে করবে।
এখন বাজেটের সম্ভাব্য অর্থসংস্থানের বিষয়ে আলোচনায় আসা যাক। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বা এডিপির জন্য কী পরিমাণ বৈদেশিক সহায়তার সংস্থান করা যায়, তা দেখে থাকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ। আজকাল সাধারণত এডিপি বরাদ্দের ২০ থেকে ২৫ শতাংশের বেশি বৈদেশিক সহায়তা সংস্থান করা যায় না। তবে আসন্ন বাজেট পাস হয়ে যাওয়ার পরও উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোর সঙ্গে নেগোশিয়েট করে অতিরিক্ত বাজেট সহায়তার চেষ্টা করা যেতে পারে। বাজেটের খরচের প্রায় ৬৫ শতাংশ সংস্থান ধরা হয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর বাবদ অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহ থেকে। সেজন্য বাজেট প্রণয়নের সময় অর্থ বিভাগ রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেয়। সাধারণত বাজেট ঘাটতি ৫ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে সম্ভাব্য আয়-ব্যয়ের সমন্বয় করে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়। তাই বাজেটের আকার বড় হলে রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রাও বড় হয়। সাধারণত সরকারের সামনে উচ্চ প্রবৃদ্ধির আকাঙ্ক্ষা থাকে বিধায় সামর্থ্যের তুলনায় অর্জনের টার্গেটটিও উচ্চাভিলাষী হয়। ফলে দেখা যায়, রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা বিগত বছরের প্রকৃত রাজস্ব সংগ্রহের তুলনায় ৪০ শতাংশেরও অধিক ধরা হয়। বাস্তবে বড়জোর ১৬ থেকে ১৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হয়, যদি দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক সচল থাকে। কিন্তু প্রতি বছরই কোনো না কোনো প্রতিবন্ধকতার কারণে রাজস্ব সংগ্রহের স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হয়ে ওঠে না। এর ওপর বিভিন্ন সেক্টরে শুল্ক কর ও ভ্যাট ছাড় তো আছেই। এসব কারণে রাজস্ব টার্গেট বড় হলে শত চেষ্টা করেও অবাস্তব টার্গেট পূরণ করতে না পারায় ঘাটতির পরিমাণ বেড়ে যায়। এনবিআরকে তার কর্মকর্তাদের দুর্নীতি ও অদক্ষতাসহ নানা সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়। এমনকি কোনো কোনো অবিবেচক ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষ অজ্ঞতাবশত খোদ এনবিআর চেয়ারম্যানকেও রাজস্ব আহরণে তথাকথিত ব্যর্থতার জন্য দায়ী করেন।
২০১৯-২০ অর্থবছরে এনবিআরের রাজস্ব (সংশোধিত) লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ কোটি টাকা। এনবিআরের চেয়ারম্যান হিসেবে আমার ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়ন অভিজ্ঞতা, শিল্প উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর সঙ্গে ও বিভিন্ন থিংক ট্যাংক ও অর্থনীতিবিদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে, সর্বোপরি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর দিকনির্দেশনা নিয়ে ২০১৯-২০ অর্থবছরে যাতে সর্বোচ্চ কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা যায়, সেরূপ একটি শুল্ক কর ও ভ্যাট পলিসি প্রণয়ন করা হয়েছিল। ২০১২ সালে প্রণীত ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন বেশ কয়েক বছর স্থগিত থাকার পর ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে কতিপয় সংশোধনসহ ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে কার্যকর করা হয়। কিন্তু বছরের প্রথম থেকেই আমদানি-রফতানির ঋণাত্মক ও নিম্ন প্রবৃদ্ধি, অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ও ব্যবসা-বাণিজ্যে ধীরগতির কারণে রাজস্ব সংগ্রহে কাঙ্ক্ষিত গতি লক্ষ করা যায়নি। তার পরও ২০২০ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত রাজস্ব সংগ্রহের প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ অর্জিত হয়েছে। এর মধ্যে প্রশাসনিক আদেশের মাধ্যমে নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের কিছু অসংগতি দূর করা হয়েছে। ভ্যাট অনলাইন প্রকল্পের মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের বাধ্যতামূলক রেজিস্ট্রেশনের আওতায় আনা হয়েছে। এ বছর থেকেই বড় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ভ্যাট সংগ্রহে স্বয়ংক্রিয় ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) মেশিন স্থাপনের কার্যক্রম নেয়া হয়েছিল। সাধারণত মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত রাজস্ব সংগ্রহের প্রকৃত সময় ধরা হয়। যে সময়ে রাজস্ব সংগ্রহে কাঙ্ক্ষিত গতি আসতে পারত, সে সময়ে নভেল করোনাভাইরাস মহামারীর প্রাদুর্ভাব ও সংক্রমণের কারণে বাংলাদেশসহ বিশ্ব অর্থনীতি স্থবির হয়ে গেল। ফলে এনবিআরের একটি বিনিয়োগবান্ধব, ব্যবসাবান্ধব ও রাজস্ববান্ধব সুবিবেচনাপ্রসূত ফিসক্যাল পলিসির সুফল লাভ করা সম্ভব হবে না। এবার রাজস্ব ঘাটতি ৬০ থেকে ৭০ হাজার কোটি টাকা হতে পারে। এমনকি ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। বড় বড় প্রতিষ্ঠান ব্যবসা মন্দার কারণে ভ্যাট ও আয়কর জমা দিতে পারবে না। এপ্রিল-মে মাসের সুদ স্থগিত এবং জুনের ঋণের কিস্তি প্রদান স্থগিত হওয়ার কারণে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ভালো ব্যবসা করতে পারবে না। ফলে স্বাভাবিকভাবে এনবিআরের এলটিইউ (আয়কর) ও এলটিইউ (ভ্যাট) অফিস দুটোর রাজস্ব আহরণ কম হবে। অথচ এ অফিস দুটি মোট রাজস্বের প্রায় ৭০ শতাংশ জোগান দেয়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও দোকানপাট এবং শিল্পপ্রতিষ্ঠান জুনে চালু হলেও এ অর্থবছরে রাজস্ব আহরণ হবে না। তবে বকেয়া হিসেবে ২০২০-২১ অর্থবছরে এ বছরের কিছু রাজস্ব আহরণ হতে পারে।
উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষাপটে আসন্ন বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের কতিপয় পরামর্শ নিচে তুলে ধরা হলো:
১. বাজেটের আনুষঙ্গিক খরচ অথবা সরবরাহ ও সেবা খাতে যেসব খরচ হয়, এর পরিমাণ সব মন্ত্রণালয়ে কমিয়ে দেয়া যেতে পারে। গাড়ির জ্বালানি খরচসহ যাবতীয় কেনাকাটায় কৃচ্ছ্রসাধন অপরিহার্য।
২. সরকারি খরচে দেশে-বিদেশে ভ্রমণ বাবদ বাজেট সংকোচন করা যেতে পারে।
৩. স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধির পাশাপাশি ব্যয়ের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অনুশাসন থাকতে হবে। বর্তমান কভিড-১৯ চিকিৎসা ও ডাক্তারদের ব্যবস্থাপনা করতে গিয়ে স্বাস্থ্য খাতের দুর্বলতা প্রকট হয়েছে। উচ্চদামে অপ্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ক্রয় করে সরকারি হাসপাতালে বছরের পর বছর ফেলে রাখার রিপোর্ট যেমন রয়েছে, তেমনি বর্তমানে করোনার চিকিৎসা করতে গিয়ে প্রয়োজনীয় ভেন্টিলেটর, আইসিইউ যন্ত্রপাতি, অক্সিজেন ইত্যাদির অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীর নিয়োগ-বদলিতে রাজনৈতিক সংগঠনের ভূমিকা চিরতরে বন্ধ করতে হবে। ওষুধ কোম্পানি ও ডাক্তারদের মধ্যে একটি ওপেন সিক্রেট আঁতাতের কথা শোনা যায়, যা দূর করা প্রয়োজন।
৪. আসন্ন মন্দা ও দুর্ভিক্ষ অবস্থা মোকাবেলায় সামাজিক সুরক্ষা খাতের বরাদ্দ বৃদ্ধিসহ উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়ানো প্রয়োজন হতে পারে।
শোনা যাচ্ছে, আসন্ন ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা হতে পারে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা, যা এ বছরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১০ শতাংশ বেশি। ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রকৃত রাজস্ব আহরণের পরিমাণ আরো দুই মাস পর জানা যাবে। প্রকৃত আহরণের চেয়ে এবারের লক্ষ্যমাত্রাও ৪০ শতাংশের অধিক হতে পারে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের রাজস্ব নীতিমালা প্রণয়নের ক্ষেত্রে নিচের বিষয়গুলোর প্রতি দৃষ্টি দেয়া হলে বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও রাজস্ব সংগ্রহ দুটিতেই ইতিবাচক ফল পাওয়া যেতে পারে।
১. রাজস্বনীতির ধারাবাহিকতার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শুল্ক-কর ও মূসকহার কয়েক বছর বলবৎ থাকলে বিনিয়োগকারী ও ব্যবসায়ীদের পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে সুবিধা হয়।
২. প্রত্যক্ষ করের ক্ষেত্রে নতুন করারোপ বর্তমান পরিস্থিতিতে সফল হবে না, বরং চলতি করহার, কর অবকাশ সুবিধা সবই আগের মতো বহাল রাখা যেতে পারে। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে ব্যবসায়ী ব্যক্তিদের অনুপ্রবেশের কারণে এনবিআরের ওপর করপোরেট করহার কমানোর রাজনৈতিক চাপ আসতে পারে। করপোরেট করহার কমানো হলে কর রাজস্ব সংগ্রহে যে ঘাটতি হবে, তা অন্য কোনো উপায়ে স্বল্প সময়ে পূরণ করা সম্ভব হবে না।
৩. দীর্ঘ সময় লকডাউনের ফলে কর মামলা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে অনিচ্ছাকৃত বিলম্ব হতে পারে। এ ধরনের ক্ষেত্রে জরিমানা মওকুফসহ বিলম্বে কর পরিশোধের ব্যবস্থাসংবলিত দুর্যোগকালীন প্রাভাইসো অর্থ বিলের মাধ্যমে কিংবা অর্ডিন্যান্স জারি করে আইনি অন্তর্ভুক্তির প্রয়োজন হতে পারে। অন্যথায় করদাতাদের সঙ্গে অহেতুক ঝামেলা হবে।
৪. চলতি বছর রিয়েল এস্টেট ও অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অপ্রদর্শিত আয় স্বল্প ট্যাক্স প্রদানসাপেক্ষে আয়কর নথিতে প্রদর্শনের সুযোগ রাখা হয়েছিল। এবার এ সুযোগ আরো বৃদ্ধি করা যেতে পারে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশের অর্থনীতি গতিশীল করার জন্য নগদ পুঁজি কিংবা অর্থসংস্থানের একান্ত প্রয়োজন। ‘কালো টাকা’ অপবাদ নিয়ে প্রচুর টাকা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বাইরে আছে, যা সময় সময় বিদেশেও পাচার হয়। আসন্ন বাজেটে বিনা শর্তে নির্দিষ্ট হারে কর প্রদানসাপেক্ষে অপ্রদর্শিত আয় একটি নির্দিষ্ট সময়ের ভেতর বৈধ করার সুযোগ দেয়া যেতে পারে। ভবিষ্যতে যাতে দুর্নীতি দমন কমিশন উৎস খুঁজতে গিয়ে এরূপ করদাতাকে হয়রানি করতে না পারেন, সে প্রভিশনও আইনে থাকতে হবে।
৫. দীর্ঘদিন ধরে ইলেকট্রনিকসামগ্রী উৎপাদন, মোটরসাইকেল, সেলফোন, কম্পিউটারসামগ্রী ও যন্ত্রাংশ উৎপাদনে কর ও ভ্যাট অব্যাহতি কিংবা নিম্নহার বলবৎ রয়েছে। শুল্কহারেও ছাড় রয়েছে। এসব সুবিধা অব্যাহত রাখা যেতে পারে।
৬. বিনিয়োগ ও দেশের শিল্প বিকাশ ও অভ্যন্তরীণ চাহিদাসম্পন্ন দ্রব্য প্রস্তুতের সুবিধার্থে ক্যাপিটাল মেশিনারিজ ও যন্ত্রাংশ আমদানিতে যে শুল্ক কর সুবিধা রয়েছে, তা অব্যাহত রাখা যেতে পারে।
৭. বর্তমান পরিস্থিতিতে শুল্ক কর ও মূসকহার না বাড়িয়ে বরং রাজস্ব আহরণের স্বার্থে বর্তমান আইন বা অর্থ বিলে কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তা সংশোধন করা যেতে পারে।
৮. রাজস্ব আহরণে বিদেশী বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তাদের লাভ-লোকসান ও আর্থিক হিসাবের স্বচ্ছতা রয়েছে। সেজন্য দেশীয় কোম্পানিগুলোকে বিশেষ সুবিধা দিয়ে বৈষম্যমূলক আইন ও নীতি প্রণয়ন করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
৯. রাজস্ব আহরণে সেলফোন কোম্পানি ও সিগারেট প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলো গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। এ দুটো খাতে ভ্যাট ও করহার সর্বাধিক। বর্তমানে যা আছে, তা অব্যাহত রাখলে এসব প্রতিষ্ঠানের কোনো আপত্তি থাকবে না। উল্লেখ্য, সিগারেট প্রস্তুতকারী কোম্পানি কর্তৃক প্রদেয় রাজস্ব মোট রাজস্বের ১০ শতাংশেরও অধিক। চলতি বাজেটে সিগারেটের মূল্য তিন স্তরেই যথেষ্ট বৃদ্ধি করা হয়েছিল। আসন্ন বাজেটে তামাকজাত দ্রব্য ও সিগারেটের মূল্য না বাড়িয়ে পূর্ববৎ অবস্থা বলবৎ রাখা হলে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি পাবে। সিগারেট ও তামাকজাত দ্রব্য থেকে যে রাজস্ব আসে, তা আরএমজি খাতে প্রদেয় রাজস্বের ১৩ গুণেরও অধিক। এছাড়া গত দুই অর্থবছরে তামাক ও তামাকজাত দ্রব্য রফতানির যে সুযোগ দেয়া হয়েছে, এর ফলে এ দ্রব্যের রফতানি আশাতীত বৃদ্ধি পেয়ে রফতানি বহুমুখীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। সিগারেটের ক্ষেত্রে আবার দুটি বহুজাতিক কোম্পানি কর্তৃক রাজস্ব প্রদানের হার এ খাতের মূল রাজস্বের প্রায় ৯০ শতাংশ।
গত কয়েক বছর দেশীয় কোম্পানিগুলোকে নিম্নস্তরের সিগারেট প্রস্তুতের একচ্ছত্র সুবিধা দিয়ে বিদেশী বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে বৈষম্যমূলক প্রতিযোগিতায় ফেলার একটি অপচেষ্টা বিশেষ মহল কর্তৃক করা হয়েছিল, যা সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের দৃঢ়তার ফলে রোধ করা সম্ভব হয়েছে। আশা করি, এবারের বাজেটেও কোনো বৈষম্যমূলক নীতি গ্রহণ করা হবে না। বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ ও অব্যাহত রাখার স্বার্থেই তা করতে হবে।
পরিশেষে বলা প্রয়োজন, এবারের বাজেট প্রণয়নের আগে ক্রস সেকশন আলোচনার সুযোগ কম ছিল, তবে বাণিজ্য সংগঠন বা থিংক ট্যাংক থেকে লিখিত মতামত প্রদান করা হয়েছে। সব মতামত গ্রাহ্য করা না গেলেও অর্থনীতির গতিসঞ্চারের স্বার্থে এবং রাজস্ব প্রবৃদ্ধির পক্ষে জনকল্যাণমুখী মতামতগুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে বাজেট ও রাজস্বনীতি প্রণয়ন ও গ্রহণ করা যেতে পারে।
মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া
সাবেক সিনিয়র সচিব ও চেয়ারম্যান
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড