বাংলাদেশের রাজনীতিতে দফা বনাম বাস্তবতা

বাংলাদেশের রাজনীতিতে দফা বনাম বাস্তবতা

আল্লাহর সৃষ্টির সবকিছুর পেছনে কারণ রয়েছে। সংখ্যা ৪০ ইসলামী শিক্ষায় বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ; নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর ওহী প্রাপ্তি, মূসা (আ.)-এর ৪০ দিনের প্রশিক্ষণ এবং অন্যান্য নবীদের জীবনধারায় এটি পরিপক্বতা, ধৈর্য ও আল্লাহর নৈকট্যের প্রতীক।


বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকেও দেখা যায়, কোনো নতুন অভ্যাস গড়ে তুলতে বা নেতিবাচক প্রবণতা বদলাতে ধারাবাহিক প্রচেষ্টা দরকার, যা প্রায় ৪০ দিনের মতো সময়ে স্থায়ী রূপ নেয়। সুতরাং, জীবনের কোনো পরিবর্তন তাড়াহুড়ো করে সম্ভব নয়; সময়, ধৈর্য এবং নিয়মিত চর্চা ছাড়া সত্যিকারের রূপান্তর অর্জন করা যায় না, বিশেষ করে যদি আমরা যৌথ উদ্যোগে কোনো ভালো কাজ করতে চাই।


২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের পর আমরা সবাই একমত হয়েছি—বাংলাদেশকে সুন্দর করে গড়ে তুলতে হবে। কিন্তু শুধুমাত্র ভালো ইচ্ছে যথেষ্ট নয়; দরকার স্পষ্ট পদক্ষেপ এবং কার্যকর সংস্কার। গত এক বছরে অনেক কিছু হয়েছে, কিন্তু সংস্কার—যা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—প্রায় অসম্পূর্ণই রয়ে গেছে। দেশে দফার ছড়াছড়ি দেখলে মনে হয়, রাজনীতি মানেই কেবল দফা বানানোর প্রতিযোগিতা।


দফাগুলোতে বলা হয় কী করা হবে আর কী করা হবে না, বিশেষ করে ক্ষমতায় গেলে কী করা হবে—এ নিয়ে হৈচৈ লেগেই থাকে। কিন্তু প্রশ্ন হলো—যদি ক্ষমতায় যাওয়া না হয়, তখন কী হবে? এর কোনো রূপরেখা কি আমরা কখনো শুনেছি? না। মানে দাঁড়ালো, সব দফাই ক্ষমতার সঙ্গে শর্তযুক্ত। তাহলে জনগণের সামনে এসব প্রতিশ্রুতির মানেটা কী? ভোটের আগে আশ্বাস, বাস্তবে ব্যর্থতা—এটি কি বিভ্রান্তি, নাকি শুধু নাটক?


ইতিহাসে উদাহরণ স্পষ্ট। শেখ মুজিবের সময় ছিল ৬ দফা—সর্বোচ্চ স্পষ্ট ও লক্ষ্যভিত্তিক। স্বাধীনতার পর তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানোর কারণে স্বাধীনতার চেতনা বাস্তবায়িত হলো না। জাতি হারালো বিশ্বাস—বাকি সব হলো ইতিহাস।


বর্তমানের ৩১ দফা বা অন্যান্য দলের দফা—সবই বড়, কিন্তু বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্য নেই। চাঁদাবাজি, দুর্নীতি—যা দফায় নেই—ও বাস্তবে ঘটছে। এর মানে—দফা শুধু মঞ্চের বুলি; কাজ হচ্ছে উল্টো।


আমি বিএনপির উদাহরণ দিয়েছি, কিন্তু এখানে যেকোনো দলের নাম বসানো যায়। এমনকি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাজও ছিল সংস্কার আনা, কিন্তু তারা সেই সংস্কারকে বাদ দিয়ে প্রায় সবই করেছে—দুর্নীতি, লুটপাটসহ আরও কত কী। এতে স্পষ্ট হয়, শুধু নির্বাচিত সরকার নয়, রাজনীতির যে কোনো স্তরে স্বার্থপরতা ও দায়িত্বহীনতা রূপ নিচ্ছে।


দফা ও প্রতিশ্রুতির কাগজে লেখা সব ভালো শোনায়, কিন্তু বাস্তব কাজের সঙ্গে মিল নেই। চাঁদাবাজি, স্বার্থপরতা ও দুর্নীতি—এসব তখনও চলতে থাকে, যখন সরকার (নির্বাচিত বা অন্তর্বর্তীকালীন) দায়িত্ব নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। ফলোআপ ও বাস্তবায়ন ছাড়া, সব দফা কেবল মঞ্চের বুলি হয়ে যায়, আর জনগণ বিভ্রান্ত হয়।


আমার শিল্পকারখানার অভিজ্ঞতা এখানে প্রাসঙ্গিক। প্রতিদিনের টু-ডু লিস্ট তৈরি করতাম। দিনশেষে মিলিয়ে দেখতাম—যত দ্রুত সম্ভব গুরুত্বপূর্ণ মনে করা কাজগুলোও প্রায়ই করা হতো না, তবুও বড় সমস্যা হত না। এটি শিখিয়েছে—কোন কাজ সত্যিই জরুরি, আর কোন কাজ কেবল তাড়াহুড়োর কারণে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। ফলোআপ তখনই দরকার হয়; এটি শুধু আনুষ্ঠানিকতা নয়, আত্মসমালোচনার মাধ্যম।


রাজনীতিতেও একই প্রশ্ন প্রযোজ্য। রাজনৈতিক দলের দফা আসলে টু-ডু লিস্টের মতো—যা করা হবে, তা যদি বাস্তবে ফলোআপ না হয়, তবে তা কেবল শব্দের খেলা। ৩১ দফার ঘোষণার পর কি কোনো আপডেট বা বাস্তবায়ন হয়েছে? না। বাস্তবতা দেখায়—চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, স্বার্থপরতা চলছেই। ফলোআপ ও দায়বদ্ধতা ছাড়া, দফা কেবল কাগজে লেখা।


আমাদের মনে রাখা দরকার—আমরা ততক্ষণই স্মার্ট, যতক্ষণ অন্য কেউ আমাদের চালাকি ধরতে পারছে না। চোরও ততক্ষণ সাধু, যতক্ষণ সে ধরা পড়ে না। যদি সত্যিই সবাই দেশকে উন্নত করতে চায়, আর সবাই একমত হয়, তাহলে সমস্যা কোথায়? সময় যদি একটু বেশি লাগে, ক্ষতি কী? তাড়াহুড়ো কেন? নির্বাচনের ব্যস্ততায় রাজনীতিবিদদের মুখের জিভ শুকিয়ে গেছে। সংস্কারের অঙ্গীকার করা হয়েছে, কিন্তু পদক্ষেপ নেই। দফা বানানো হয়েছে অনেক, কিন্তু বাস্তবে কোনো দফাই মানা হয়নি। প্রতিশ্রুতির কাগজে লেখা আর বাস্তবের কাজ—আকাশ-পাতাল ফারাক।


সুতরাং প্রশ্ন উঠে—রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের আদৌ দেশের প্রয়োজন আছে কি? নাকি উল্টো, এই নেতা-কর্মীরাই দেশের মূল সমস্যা? জনগণ চায় সরাসরি উত্তর। তারা দেখেছে—যেখানে কথা আর কাজের মধ্যে ফারাক, সেখানে আস্থা চূর্ণ হয়। দফা বা নির্বাচনী ভাষণ সমস্যা সমাধান করতে পারে না; সত্যিকার পরিবর্তন আসে তখনই, যখন নেতা-কর্মীরা প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজ করবে, দায়িত্ব নেবে এবং নিয়মিত ফলোআপ করবে।


কিন্তু যদি ভণ্ড রাজনীতিবিদরা সংস্কারে অনাগ্রহী থাকে এবং নিজেদের স্বার্থকেই প্রাধান্য দেয়, তবে তারা কীভাবে জনগণের কল্যাণে আন্তরিকভাবে কাজ করবে? আজকের বাস্তবতা একেবারেই স্পষ্ট—দফা ও প্রতিশ্রুতি রয়েছে অগণিত, কিন্তু বাস্তব কর্ম, স্বচ্ছতা ও সততার চর্চা নেই বললেই চলে। দুর্নীতি ও স্বার্থপরতা যেন অঘোষিত নিয়মে পরিণত হয়েছে। জনগণ আর নাটক দেখতে চায় না; তারা চায় প্রমাণিত পরিবর্তন, সত্যিকারের কর্ম এবং দায়িত্বশীল নেতৃত্ব। অবশ্যই, একটি জাতির দীর্ঘকালীন রাজনৈতিক সংকট রাতারাতি সমাধান সম্ভব নয়। কিন্তু ৪০ দিনে না হোক, ৪০ মাসের আগেই সেই পরিবর্তনের যাত্রা শুরু হবে—এমন একটি আশা আমরা করতেই পারি।


রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। Rahman.Mridha@gmail.com

আর্কাইভ থেকে

আরও পড়ুন

বাংলাদেশ জন্মেছে জনগণের স্বপ্নে, কোনো পরিবারের জন্য নয়।
দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের সংকটে দেশ: বন্ড মার্কেট বিকাশের প্রয়োজনীয়তা ও দিকনির্দেশনা
দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার সমাধান- পরকালে, নাকি বিবেকের ময়দানে?
জাতিসংঘ: পতনের ছায়া নাকি পুনর্জাগরণের আলো?
পিআর পদ্ধতি কার্যকর করতে আগে দরকার প্রশাসনিক সংস্কার
হাটে জন বিক্রি আধুনিক দাসত্বের অন্ধকার ও রাষ্ট্রীয় দায়
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দফা বনাম বাস্তবতা
নরওয়ের অভিজ্ঞতা বনাম বাংলাদেশের বাস্তবতা: জবাবদিহিহীন রাজনীতির অন্তরায়
তরুণ প্রজন্মের চোখে আজকের বাংলাদেশ গুজব, বিভ্রান্তি আর অনিশ্চয়তায় ভরা
কেন শিবিরের বিরুদ্ধে এত প্রপাগান্ডা?