শরনার্থী হল এমন একজন ব্যক্তি যে তাঁর স্বদেশ বা মাতৃভূমিতে নাগরিকত্বের জটিলতায়, সাম্প্রদায়িকস সমস্যা, বিশেষ ধর্মে অবলম্বন করার কারণে জাতিগত সহিংসতা, রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে গুরুতর বিপদের সম্মুখীন অথবা বিপদের আশঙ্কায় রয়েছে। এক সহজ কথায় শরানার্থী এমন এক ব্যক্তি যে নিজের দেশেই সাংঘাতিক বিপদগ্রস্থ, নিরাপদ নয় অথবা প্রতিহিংসার ভয়ে নিজের দেশের আশ্রয়থাকতে অনিচ্ছুক। তবে জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী কেবল সে সমস্ত ব্যক্তিবর্গ অন্য একটি দেশে শরনার্থীর মর্যাদা হিসেবে আশ্রয় পাবে যারা জাতি, ধর্ম, নাগরিকতা, বিশেষ সম্প্রদায় অথবা রাজনৈতিক বিশ্বাসের কারণে নিজ মাতৃভূমিতে নিপীড়নের আশঙ্কার সম্মুখীন; এবং তার এই আশঙ্কা উত্তম সাক্ষ্য প্রমানের উপর প্রতিষ্ঠিত; এবং সেই কারণে তারা যে দেশের নাগরিক তার বাহিরে অবস্থান করছে; নিজের দেশের নিরাপত্তা পাচ্ছে না, অথবা উক্ত নিপীড়ণের আশঙ্কার দরুন নিজের দেশের আশ্রয় চাচ্ছেন না।
বর্তমান বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে করুন শরণার্থী সংকটে ভুগছে। আজ বিশ্বের প্রায় প্রতিটি প্রান্ত জাতিগত, ধর্ম, সাম্প্রদায়িকতা, রাজনৈতিক, সামরিক ও মতাদর্শগত নানা সংকটে মানুষের কাছ থেকে কেড়ে নিচ্ছে জাতি, পরিচয়, ভূ-খন্ড, বেঁচে থাকার অধিকার ও মানবিক মর্যাদা। এ সংকটে ইতোমধ্যে প্রায় ৭ কোটির ও বেশি মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়েছে। প্রায় ২ কোটি ২৬ লাখ মানুষ শরনার্থী হিসেবে জীবন কাটাচ্ছে। প্রায় ১ কোটি মানুষের কোন পরিচয় নেই। সিরিয়া, আফগানিস্তান, দক্ষিন সুদান ভেনিজুয়েলা, মিয়ানমার, সোমালিয়ায় অসংখ্যা নাগরিক ইতোমধ্যে বাস্তুচ্যুত হয়েছে । ভারতেও এন আরসির নামে লাখ লাখ মানুষ অনিশ্চয়াতার কবলে পড়তে যাচ্ছে।
আমাদের দেশেও শরনার্থীর সংখ্যা নেহাত কম নয়। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগ থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং সাম্প্রতিক সময়ে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ ভূ-খন্ডে শরানার্থী অভিজ্ঞতার স্থায়ী ছাপ রাখতে চলছে। দেশ বিভাগের পর বিহারি এবং বর্তমান সময়ে মায়ানমার থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গারা আমাদের দেশে আশ্রয় নিয়ে অবস্থান করছেন। মাঝখানে মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশিদের ভারতে শরনার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয়ার অভিজ্ঞতা তো রয়েই গেছে। দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে চলছে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের শরানার্থী হিসেবে প্রবেশের প্রক্রিয়া ।
১৯৯২ সালের শুরুতে মিয়ানমার সামরিক জান্তা সরকারের অত্যাচারে ২ লাখ ৫২ হাজার শরানার্থী বাংলাদেশে প্রবেশ করে। পরবর্তীতে জাতিসংঘ শরানার্থী বিষয়ক হাই কমিশনের (UNHCR) মধ্যস্থতায় ২ লাখ ৩৬ হাজার ৫৯৯ জন শরনার্থী স্বদেশে ফিরে গেলেও তাদের মধ্য থেকে অনেকেই আবার অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে থাকে। ফিরে আসা রেহিঙ্গাদের মধ্যে ৫০ হাজারের মতো অবৈধভাবে অবস্থান করছে কুতুবপালং শরনার্থী শিবির সংলগ্ন ৪/৫ টি পাহাড়ে।
স্থানীয়দের মতে, রোহিঙ্গাদের কারণে আশেপাশের বাংলাদেশি জনবসতিগুলোতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিসহ নানা সমস্যা সংকটের সৃষ্টি হচ্ছে। অন্যদিকে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের নিজ দেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিতে নারাজ। তাদের জন্য নেই কোন কর্মস্থান। আছে শুধু নির্যাতন আর অত্যাচার। মানবতার দিকে ভেবে আমাদের দেশে এ পর্যন্ত অনেক শরনার্থী আশ্রয় দেয়া হয়। কিন্তু ছোট দেশ হিসেবে এ দেশের অর্থনীতিতে এই চাপ কতোটা সহণীয় সে প্রশ্ন এখন প্রকট হয়ে ফুটে উঠেছে। আমার এতো কথা বলার কারণ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ৫৫/৭৬ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০০১ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী ২০ জুন পালিত হয় “বিশ্ব শরনার্থী দিবস ” ।
দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের পরপর বিশ্বব্যাপি নানা মেরুকরন, নানান রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কারণে দেশে দেশে শরনার্থীর সংখ্যা ক্রমবর্ধমান হারে বাড়তে থাকে। কিন্তু তখন পর্যন্ত শরনার্থীদের কোন সঠিক সংজ্ঞা নির্ধারিত হয়নি। শরনার্থীদের অধিকার কী কী এবং তাদের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব কর্তব্য কী হবে এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক কোন আইন বা সর্বজন গ্রহণযোগ্য কোনও সনদ ছিলো না। তবে ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্রে শরনার্থীদের ক্ষেত্রেও মানুষ হিসেবে বিভিন্ন ধরনের মানবাধিকার প্রাপ্য বলে স্বীকৃতি থাকে।
এ রকম একটি প্রেক্ষাপটে ১৯৫০ সালের ১৪ ডিসেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে পরিষদের একটি স্বতন্ত্র অঙ্গ হিসাবে Office of the United Nations High Commissioner for Refugee (UNHCR)প্রতিষ্ঠা করা হয় যা বিশ্বব্যাপী The UN Refugee Agency The UN Refugee Agency হিসেবে পরিচিত। এই সংস্থার কার্যক্রমকে একটি আন্তর্জাতিক বিধি বিধানের আওতায় আনার জন্য একটি আন্তর্জাতিক কনভেনশন ১৯৫১ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে স্বাক্ষরিত হয় যা আন্তজার্তিকভাবে “জাতিসংঘের শরনার্থী সনদ” হিসেবে পরিচিত।
ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আববায় আফ্রিকার ৩২ টি দেশ স্বাক্ষর করে গঠণ করে Organigation of African Union (OAU) Organiæation of African Union (OAU)নাম ধারণ করে। OAU সংস্থাটির প্রতিবছর ২০ জুন আন্তজার্তিক শরণার্থীদিবস (Internation Refugee Day Internation Refugee Day) পালন করতো। কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি শরণার্থী বাস ছিল আফ্রিকা। এ কারণে ঙঅট এর উদ্যোগে প্রতিবছর ২০ জুন পালিত হয়ে আসা শরনার্থী দিবসকেই জাতিসংঘ কর্তৃক বিশ^ব্যাপি সম্মিলিতভাবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বিশ্ব শরণার্থী দিবসের ইতিহাসে এভাবেই আফ্রিকার OAU সংস্থাটির নাম জড়িয়ে আছে।
প্রতিবারই শরনার্থী দিবসে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রে আশ্রয় নেয়া শরনার্থীদের নিয়ে আলোচনা করা হয়, চুক্তি সম্পাদিত হয়, হুশিয়াড়ি প্রদান করা হয়, শর্তারোপ করা হয়। কিন্তু অধিকাংশক্ষেত্রেই তা কাগজে কলমেই থেকে যায়। আলোর মুখ দেখতে ব্যর্থ হয়। আজ ২০ জুন বাংলাদেশের মত একটি ক্ষুদ্র ভূ- খন্ডের জন ঘনবসতিপূর্ণ দেশে প্রায় ১৩ লক্ষ রোহিঙ্গা শরনার্থীর বাড়তি বোঝা নিয়ে পালন করতে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক শরনার্থী দিবস-২০২০ অনেকে হয়তো বলবেন আমি কেন রোহিঙ্গাদের বোঝা বলছি। আমরাওতো ১৯৭১ এ ভারতে শরনার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছিলাম। কিন্তু সেতো ছিল স্বাধীনতার জন্য লড়াইয়ের শক্তি অর্জন করতে। স্বদেশের শত্রুমুক্ত ভূমিতে তাই ফেরার ছিল দৃঢ় প্রত্যয়। আর সকলে একসাথে স্বদেশভূমিতে ফিরেও এসেছিলাম। বাংলাদেশে শরনার্থী দিবস পালন করার তাগিদ এবং পরিসর প্রতিবছরই বিস্তৃত হচ্ছে। এর গুরুত্ব আমলে নেয়ারও সময় এসে গেছে। এ দিবসটি পালনের মূলত উদ্দেশ্য হলো বিশ্ব শরনার্থীদের স্মরন করার আহ্বান জানানো বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে। মূলত শরনার্থীদের অমানবিক অবস্থানের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয় এ দিবসটিতে।
উখিয়ার কুতুবপালং রোহিঙ্গা কমিউনিটি নেতা মুহিব উল্লাহ বলেন “যতই সাহায্য সহযোগিতা পাই না কেন? ভিন দেশে কি কারও ভালো লাগে? এই রোহিঙ্গা বস্তিতে কোন রকম থাকলেও মনটা রাখাইনে চলে গেছে। কবে আমরা দেশে ফিরতে পারবো সে আশায় আছি। জানিনা আল্লাহ আমাদের ওপর কতটুকো সহায় হন। আমরা এখনও স্বপ্ন দেখি রাখাইনে ফিরে যেতে।কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের লালু মাঝি, ফয়েজ মাঝি, সুফিয়া বেগম, টেকনাফ লেদা ক্যাম্পের দুদুমিয়া ও নয়া ক্যাম্পের শফিউল্লাহসহ সচেতন অনেক রোহিঙ্গা বলেছেন “শুধু শরনার্থী দিবস পালন করলেই চলবেনা। রেহিঙ্গারা একটি স্থায়ী সমাধান চায়। তারা চায় এমন পরিস্থিতি তৈরী হোক যাতে নিজ দেশে ফিরে যাওয়া সম্ভব হয়। তারা আর বাংলাদেশে বোঝা হয়ে থাকতে চায় না, তারা মনে করে আন্তর্জাতিকভাবে মিয়ানমারকে চাপ প্রয়োগ করে বাংলাদেশকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে।
একদিকে এসব শরনার্থীদের দেশে ফেরার ব্যাকুলতা আমাদেরকে যেমন মর্মাহত করে তেমনি অন্যদিকে উখিয়া ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নারী সাহারা খাতুনের ভয় আর উৎকন্ঠায় ভরা উক্তিটিও আমাদেরকে ভাবিয়ে তোলে। সাহারা খাতুন সহ অধীকাংশ রোহিঙ্গারাই এখন আর ফিরে যেতে চায় না তাদের সেই বিভীষিকাময় স্বদেশভূমিতে তাদের এই না ফেরার প্রবনতা আমাদের জন্য উৎকন্ঠার বিষয়। কক্সবাজারের উখিয়া ও টেনাফের পাহারের চুরায় এসব রোহিঙ্গার অবস্থান। তাদের শিবিরগুলো অরিক্ষিত থাকায় তারা সর্বত্র বিচরন করে বেড়াচ্ছে তাছাড়া তাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়টি দীর্ঘায়িত হওয়ায় রোহিঙ্গাদের দৈনন্দিন জীবনে সমস্যা ও বঞ্চনা বেড়ে চলছে। রোহিঙ্গা ও স্থানীয় জনগনের মধ্যে বৈষয়িক টানা পোড়েন ও সামাজিক দুরত্ব বাড়ছে। ফলে তাদের মধ্যে পারস্পারিক অসন্তোষ এবং তা থেকে প্রায়ই তারা সহিংসতায় জড়িয়ে পরে। তাছাড়া রোহিঙ্গারা নানা রকম অপরাধে জড়িয়ে পরার প্রবনতাও এখন দৃশ্যমান হচ্ছে। জন্ম নিবন্ধন সনদ ও জাতীয় পরিচয় পত্র সংগ্রহ করা, বাংলাদেশের পাসপোর্ট তৈরি করা এবং ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির তৎপরতার অপকর্মে তাদের লিপ্ত হওয়ার খবরও গনমাধ্যমে আসছে।
এই বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর একটি আবদ্ধ স্থানে কর্মহীন অবস্থায় বসবাস করার কারণে তাদের মধ্যে একধরনের হতাশাও লক্ষ করা যাচ্ছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে তা বাংলাদেশের জন্য অভ্যন্তনীর নিরাপত্তার ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে।যা আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে পারে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে আছে এইডস আক্রান্ত মানুষ। বাংলাদেশ এখন কলেরা মুক্ত হলেও তাদের মধ্যে রয়েছে সেই সমস্যা, অস্বাভাবিক জন্মহার সেই সাথে বন উজার হচ্ছে, পাহাড় কেটে ধ্বংস করছে তারা। দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক ঝুঁকিও আছে এর সাথে, হতে পারে আর্থ সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যা।
ক্ষুদ্র একটি রাষ্ট্র বাংলাদেশ। ইতিমধ্যেই অতিরিক্ত জনসংখ্যার ভারে অর্থনৈতিক কাঠামো দুর্বল। তার উপর আমাদের বনভূমি ও কৃষি জমি ক্রমাগত কমে যাচ্ছে। এসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা শরনার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার ব্যাপারে যে উদার মনোভাব দেখিয়েছেন তা বিরল। আবার একবার প্রমানিত হলো তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যোগ্য উত্তরসূরী। তাঁর এই মানবদরদী মনোভাব বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে। অর্জন করেছেন Mother Of Humanity উপাধি। এজন্য আমরা গর্বিত। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে এই বিপুল সংখ্যক মানুষের আশ্রয় ছাড়াও খাদ্য, বাসস্থানসহ মৌলিক চাহিদা পূরন আরও কঠিন ব্যাপার ।
এখনও জাতিসংঘ সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ত্রান সহায়তা দিচ্ছে। কিন্তু অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায় যে যতদিন যাবে ত্রান সহায়তার পরিমান কমতে থাকবে। আবার বেশিদিন হয়ে গেলে এসব শরনার্থীরা মূলধারার জনগোষ্ঠীর সাথে মিশে যাওয়ার প্রবনতাও বৃদ্ধি পেতে থাকে। রোহিঙ্গারা এমন সময় এসেছে আমরা কেবল নিম্ন আয়ের দেশের তকমা মুছে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে অগ্রযাত্রা শুরু করেছি মাত্র। এখন আমাদেরে সামনে রয়েছে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা। এই অবস্থায় আমাদের উপর অর্থনীতিতে বাড়তি ১১ লক্ষ রোহিঙ্গাদের অতিরিক্ত চাপ কোন ভাবেই সহনীয় হতে পারে না। আর এ কারনে উন্নয়নের সূচকে আমরা যদি পিছিয়ে যাই তার চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক আর কিছু হতে পারে কি? মনে রাখতে হবে বিষয়টা যেন এমন না হয় “ভাতের চেয়ে ডাল উঁচু”।
এতোসব সমস্যার মধ্যেও রোহিঙ্গা শিবিরে বৈশ্বিক কোভিড-১৯ সংক্রমন শরনার্থী শিবিরে দেখা দিয়েছে নতুন উৎকন্ঠা। কুতুবপালং ক্যাম্পে ১৪ই মে প্রথম ১ জন করোনা রোগী শনাক্ত হলে ক্যাম্পের চেয়াম্যান মোহাম্মদ রফিক বলেন- “শুরু থেকে যে বিষয়টি নিয়ে ভয়ে ছিলাম সেটাই হয়েছে, একজন করোনা সংক্রমিত হয়েছে। ঘিঞ্জি ক্যাম্পের বসতিদের মধ্যে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ভয় কাজ করছে। কেননা বেশিরভাগ রোহিঙ্গা জানেনা করোনা ভাইরাস সংক্রমন থেকে বাঁচতে হলে দুরত্ব বজায় রাখতে হবে, ঘন ঘন সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে, পরিষ্কার পরিছন্ন থাকতে হবে, মুখে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। এখানে লকডাউন এবং সামাজিক দুরত্ব মানা একেবারেই অসম্ভব প্রায়”।
কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্প বাংলাদেশের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। ক্যাম্পে এক বর্গ কিলোমিটারে ৬০ হাজার মানুষ বাস করে। ৩৪ টি ক্যাম্পে রয়েছে ১০ লক্ষ রোহিঙ্গা। এই ঘিঞ্জির এলাকায় একবার সংক্রমন ছড়ালে ভয়াবহ রূপ নিতে পারে বলে উৎকন্ঠা আমাদের সকলের। শংকা দেখা দিয়েছে সেখানে কর্মরত আন্তর্জাতিক ওদেশী সাহায্য সংস্থাগুলোর মধ্যেও। স্বাস্থ্য সচেতনতা মানতে বাড়ানো হয়েছে সেনাবাহিনী ও পুলিশের কড়া নজরদারী। কক্সবাজার শরনার্থী ত্রান ও প্রত্যাবাসন কমিশনের ( RRRC ) তথ্যমতে এ পর্যন্ত ৩৫ জন শরনার্থী করোনা আক্রান্ত এবং দুটি আশ্রয় শিবিরে প্রায় ১৫ হাজার কোয়ারিন্টিনে রাখা হয়েছে।ফলে শরণার্থী শিবির সহ সমস্ত কক্সবাজারবাসীর মধ্যে উৎকণ্ঠা বেড়েই চলছে।
সবমিলিয়ে বাংলাদেশে এই সমস্যাগুলো কিভাবে মোকাবেলা করবে সেটা ঠিক করাই এখন কঠিন চ্যালেঞ্জ। বিশ্লেষকদের মতে রোহিঙ্গা শরনার্থীদের নিয়ে এবার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে হবে। না হলে আসন্ন ভয়াবহ বিপদ। বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে আন্তর্র্জাতিক মহলের সাহায্য চেয়েছেন। আমার মতে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক আন্তর্জাতিক শরণার্থী সু-রক্ষা ব্যবস্থার অখণ্ডতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা প্রয়োজন। শরনার্থীরা বহণ করে বেড়ায় যুদ্ধ, সহিংসতা, ক্ষুধা, হতাশা ও মানসিক যন্ত্রণার বিভীষিকাময় স্মৃতি। তাই তাদের দুঃখ-কষ্ট আর দুর্দশাকে আমাদের অনুভব করতে হবে। বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে এগিয়ে আসতে হবে সর্বাগ্রে।
বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে শরনার্থী দিবসে এমন উদ্যোগ নেয়া এখন সময়ের দাবী। প্রথমত; রোহিঙ্গাদের উপর মিয়ারমারের অত্যাচার বন্ধ করতে হবে; দ্বিতীয়ত রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে; তৃতীয়ত সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাবাসন না হওয়া পর্যন্ত কঠোর আন্তর্জাতিক আইনের মাধ্যমে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। আর এমনটা বাস্তবায়নে প্রয়োজন চৌকস কূটনৈতিক তৎপরতা। বিশ^নেতৃবৃন্দের নজরে নিয়ে মিয়ানমারের উপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করতে সার্ক, আসিয়ান, বিমসটেক এবং ওআইসিকে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে প্রভাবিত করা। শরণার্থীদের স্থায়ী পুনর্বাসন করার উপায় সংবলিত প্রস্তাব নিয়ে শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। আশ্রয় প্রদানকারী দেশের প্রতি সহযোগিতার হাত সম্প্রসারিত করতে হবে।
এমনটি না হলে ভবিষ্যতে কোন দেশই শরনার্থীদের আশ্রয় দিতে উৎসাহিত হবে না। আর অবশ্যই এ উদ্যোগ নিয়ে ভুক্তভোগী দেশগুলোকেই কঠোর কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে। কেননা কথায় আছে, ‘‘না কাঁদলে মাও দুধ দেয়না’’। তবে একথা আমাদের সকলকেই স্মরন করতে হবে, “শরনার্থীদের প্রত্যাবর্তন না হওয়া পর্যন্ত ক্যাম্পের ভিতরে ও বাহিরে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, মানব পাচার রোধ করা, ক্যাম্পে বসবাসরত শিশুদের শিক্ষা, পুষ্টি ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা। পরিশেষে কোভিড-১৯ এর এই বৈশ্বিক মহামারীতে বিশ^ব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা পরিস্থিতিতে বিশ্ব শরনার্থী দিবস-২০ এর উপলব্দি হোক- প্রত্যেক শরণার্থী যেন আশ্রয় বঞ্চিত না হয়, তার মানবিক অধিকার ক্ষুন্ন না হয়। একই সাথে কিছু জ্ঞান পাপীদের কাছে প্রত্যাশা, কেবলমাত্র অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যে বিদেশ গিয়ে শরণার্থীর মর্যাদা দাবি করে বিশ্ব দরবারে নিজ জন্মভূমির মর্যাদা ক্ষুন্ন করবেন না।
সহকারী অধ্যাপক উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ
পটুয়াখালী সরকারি কলেজ, পটুয়াখালী