মঙ্গলবার (২৩ জুন) ‘করোনাকালে স্থানীয় সরকারের ভূমিকা ও বাজেট ২০২০-২১’ শীর্ষক এক অনলাইন আলোচনা এ কথা বলেন অর্থনীতিবিদ বিশ্লেষক ও খাত সংশ্লিষ্টরা। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কর্মরত নাগরিক সমাজের সংগঠন ও নেটওয়ার্ক, স্থানীয় সরকার প্লাটফর্ম, স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ এবং সংশ্লিষ্ট প্র্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে গঠিত জোট ‘গভর্ন্যান্স অ্যাডভোকেসি ফোরাম’ এ সভার আয়োজন করে।
ফোরামের চেয়ারপারসন ও পিকেএসএফের চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদের সভাপতিত্বে এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন ও সঞ্চালনা করেন ফোরামটির সমন্বয়কারী ও ওয়েভ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মহসিন আলী। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. এম এম আকাশ, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. কাজী মারুফুল ইসলাম, লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. ফেরদৌস আরফিনা ওসমান, পটুয়াখালীর দুমকী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হারুন-অর-রশীদ হাওলাদার, মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার শ্রীকোল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এম এম মোস্তাসিম বিল্লাহ সংগ্রাম, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের সমন্বয়কারী জিয়াউল করিম প্রমুখ। আরও বক্তব্য রাখেন উপস্থিত নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা।
আলোচনায় বক্তারা বলেন, করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর থেকেই মাঠ পর্যায়ে সম্মুখসারির যোদ্ধা হিসেবে অন্যান্যদের মতো সক্রিয় রয়েছেন স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিরাও। তৃণমূল পর্যায়ে সরকারের ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দেয়া ও জনগণের পাশে থেকে তাদেরকে সাহস ও প্রয়োজনীয় সহায়তা দিয়ে যাচ্ছেন তারা। যদিও জনপ্রতিনিধিদের ত্রাণ আত্মসাতের কাহিনীর সঙ্গেই আমরা বেশি পরিচিত। এ প্রেক্ষিতে অর্থমন্ত্রী ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য যে জাতীয় বাজেট ঘোষণা করেছেন, তাতে দেখা যাচ্ছে, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন খাতে প্রস্তাবিত বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৩৯ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা, যা আগের বছরের প্রকৃত বরাদ্দের ছিল ৪০ হাজার ৪৭৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ আগের বছরের চেয়ে এবার প্রকৃত বরাদ্দ হ্রাস পেয়েছে।
তারা আরও বলেন, একইভাবে উন্নয়ন বরাদ্দের ৩৩ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা, যা আগের বছরে ছিল ৩৫ হাজার ২১১ কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রেও বরাদ্দ কমেছে। চলমান প্রেক্ষাপটে অর্থবছরের থেকেও কম বাজেট নিয়ে আগামী অর্থবছরে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহের বর্তমান ভূমিকা বৃদ্ধি করা দূরে থাক, চলমান কার্যক্রম অব্যাহত রাখাই কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। তাই করোনা মোকাবিলা ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের উদ্দেশ্যে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহের জন্য প্রকৃত উন্নয়ন বরাদ্দ অন্তত ৪ শতাংশে উন্নীত করা দরকার।
কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, বর্তমানে মানুষ যেমন করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে, তেমনি অর্থনৈতিকভাবেও আক্রান্তের শিকার। কিন্তু বাজেট হয়েছে গতানুগতিক। স্থানীয় সরকারের গুরুত্ব সম্পর্কে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকেও নানা কথা বলা হলেও তার বাস্তবায়ন হচ্ছে না। কিন্তু এবারের মহামারি যেহেতু সাধারণ মহামারি নয়, তাই সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এক্ষেত্রে স্থানীয় সরকারের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি।
অধ্যাপক ড. এম এম আকাশ বলেন, এ বাজেটে যে প্রস্তাবনা তা শেষ পর্যন্ত ঠিক থাকবে কি-না সে বিষয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। তাই একটি অন্তর্বর্তীকালীন বা দুর্যোগকালীন বিশেষ বাজেট করতে পারত সরকার। করোনার কারণে যে বিশেষ বরাদ্দ প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, তা কীভাবে বাস্তবায়ন হবে ফোকাস করা দরকার ছিল। সহায়তার জন্য নতুন দরিদ্র মানুষের তালিকা সঠিকভাবে করতে হবে, সেখানে স্থানীয় সরকারের গুরুত্বের বিকল্প নেই। শুধু আমলাতন্ত্র দিয়ে এটা সম্ভব নয়, সরকারকে এটা বুঝতে হবে। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা বজায় রেখে সরকারি সহায়তাগুলো তদারকির দায়িত্ব দিতে হবে।
ড. কাজী মারুফুল ইসলাম বলেন, করোনা দুর্যোগের যে ধরন তা দেশে বিদ্যমান দুর্যোগ সংক্রান্ত আইনি বা ব্যবস্থাগত কাঠামোর ভেতরে সংকুলান করা সম্ভব নয়। এ দুর্যোগের সঙ্গে স্থানীয় সরকারের যে আইনি কার্যক্রম তা কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ বিবেচনা করা দরকার। এ মুহূর্তে যে খাদ্য বা অন্যান্য সহায়তা দরকার তা সরকার প্রশাসন বা অন্যান্য মাধ্যমে শুরু করেছে। তাই এ প্রেক্ষাপটে ভবিষ্যতে কী করতে পারে স্থানীয় সরকার সেদিকে সকলের দৃষ্টিপাত করা দরকার। সেজন্য দরকার নতুনভাবে গবেষণার মাধ্যমে সুপারিশ তৈরি করা।
ড. ফেরদৌস আরফিনা ওসমান বলেন, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোতে নতুন করে করোনা প্রতিরোধ কমিটি না করে বিদ্যমান যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি রয়েছে সেটাকেই আরো শক্তিশালী করে কাজে লাগানো যেত। এরকম দুর্যোগ নিয়ন্ত্রণে দেশের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার সঙ্গে সমন্বয় করা দরকার ছিল। জাপান এভাবে সাফল্য পেয়েছে। এবারের জাতীয় বাজেট দেখে মনে হয় না যে আমরা আপদকালীন অবস্থায় আছি। এ সময়ে স্বাভাবিকভাবেই স্থানীয় সরকারের রাজস্ব আহরণ কমে যাবে, যদিও স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন কারণে তাদের কাজ ও দায়িত্ব বাড়বে। তাই এক্ষেত্রে তাদের জন্য বরাদ্দ বৃদ্ধির কথা সরকার ভাবতে পারে।
হারুন-অর-রশীদ হাওলাদার বলেন, মাঠ পর্যায়ে প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে বৈষম্য না রেখে ভারসাম্য এনে ‘টিমওয়ার্ক’ গড়ে তুললে করোনাসহ যেকোনো দুর্যোগ সহজে মোকাবিলা করা সম্ভব। এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর দফতর বা মন্ত্রিপরিষদ থেকে নির্দেশনা আসতে হবে। করোনাকালে যে ব্যাপক মানুষ গ্রামে চলে গেছে তাদের জন্য কর্ম সৃষ্টি অতি জরুরি। সরকার যে গ্রামে শহরের সুবিধা নিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করেছে, সেটি বাস্তবায়নের জন্যও স্থানীয় সরকার শক্তিশালী করার কোনো বিকল্প নেই। রাজস্ব বিবেচনায় স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে বার্ষিক উন্নয়ন বরাদ্দের অংশ দিলে প্রতিষ্ঠানগুলো রাজস্ব বৃদ্ধির ব্যাপারে আরো উৎসাহিত হবে