সরকারের পক্ষ থেকে প্রণোদনা দেওয়া সত্ত্বেও প্রত্যাশিত হারে রেমিট্যান্স আসছে না।
প্রবাসী কর্মীদের কর্মস্থল থেকে ব্যাংকগুলোর দূরত্ব বেশি এবং হুন্ডি ব্যবসায়ীদের থেকে নানা ধরনের সুবিধা পাওয়ার কারণেই প্রবাসী কর্মীরা এখনো হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাঠাতে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছেন।
এ কারণে সরকারের পক্ষ থেকে আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দেওয়া সত্ত্বেও প্রত্যাশিত হারে রেমিট্যান্স বাড়ছে না। এ অবস্থায় সংসদীয় কমিটির পক্ষ থেকে হুন্ডি ব্যবসা বন্ধ ও রেমিট্যান্স বৃদ্ধির জন্য ইনসেনটিভসহ প্রবাসীদের অন্যান্য সুবিধা প্রদানে একটি প্রস্তাবনা বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর সুপারিশ করা হয়েছে। বুধবার সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে রেমিট্যান্স বাড়ানো নিয়ে আলোচনা করা হয়। বৈঠকে কমিটির আমন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। বৈঠকে কমিটির সভাপতি ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ সভাপতিত্ব করেন। এ সময় কমিটির সদস্য প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদ, মোয়াজ্জেম হোসেন রতন, মৃণাল কান্তি দাস, পংকজ দেবনাথ এবং হাবিবুর রহমান উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকের কার্যপত্রে দেখা গেছে, এর আগের বৈঠকে রেমিট্যান্স প্রবাহ না বাড়ার কারণ নিয়ে আলোচনা করে সংসদীয় কমিটি। ওই বৈঠকে বাংলাদেশ জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) মহাপরিচালক শহীদুল আলম বলেছিলেন-ইউক্রেন যুদ্ধ, ব্যাংক রেট ও হুন্ডির রেটের ব্যাপক ব্যবধানের কারণে বৈধপথে টাকা আসার পরিমাণ কমে গেছে। সে সময় কমিটির সভাপতি ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ প্রণোদনা ২ দশমিক ৫ শতাংশের স্থলে ৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করেছিলেন। ওই বৈঠকের সুপারিশ অনুযায়ী, বুধবারের বৈঠকে হুন্ডি ব্যবসা বন্ধ এবং রেমিট্যান্স বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকারি চ্যানেলে টাকা পাঠানোর সুবিধার জন্য প্রবাসীদের ইনসেনটিভসহ অন্যান্য সুবিধা প্রদানের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা হয়। পরে কমিটির পক্ষ থেকে হুন্ডি ব্যবসা বন্ধ এবং রেমিট্যান্স বাড়াতে সরকারি চ্যানেলে টাকা পাঠানোর সুবিধার জন্য প্রবাসীদের ইনসেনটিভসহ অন্যান্য সুবিধা প্রদানের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর জন্য মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করা হয়। এছাড়া বৈঠকে প্রবাসীদের বৈধ চ্যানেলের মাধ্যমে টাকা পাঠানোর জন্য উৎসাহীকরণ এবং তাদের কর্মস্থলের কাছাকাছি প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে মানি এক্সচেঞ্জ স্থাপন করা যায় কিনা সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়।
কার্যপত্রে দেখা গেছে, বৈঠকে বৈধ চ্যানেলে টাকা কম আসার কারণ তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়, ব্যাংকগুলো প্রবাসী কর্মীদের কর্মস্থল থেকে অনেক দূরে হওয়ায় তারা সময় ও টাকা খরচ করে ব্যাংকে গিয়ে টাকা পাঠাতে আগ্রহ কম দেখায়। অপরদিকে হুন্ডির সঙ্গে যারা জড়িত তারা উলটো প্রবাসী কর্মীদের বাসা বা কর্মস্থলে গিয়ে অর্থ সংগ্রহ করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মাসের বেতন না হওয়ার আগেই নিজেদের থেকে টাকা পাঠিয়ে দেয়। বেতন পেলে কর্মীরা তা পরিশোধ করেন। হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠানো তাদের জন্য ‘সহজ’ হওয়ায় তারা বৈধ চ্যানেলের পরিবর্তে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠাতে বেশি আগ্রহী হন। বাংলাদেশি কর্মীরা কাজ করেন এমন অনেক দেশের দোকানে দোকানে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের (বাংলাদেশি) আড়ালে হুন্ডি ব্যবসা করা হয় বলে বৈঠকে অভিযোগ করা হয়।
পাঁচ মাসে ৭০ থেকে ৯০ হাজার কর্মী বিদেশে গেছেন : বৈঠকের কার্যপত্র থেকে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে ৭০ থেকে ৯০ হাজার কর্মী বিদেশে গেছেন। মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, জুলাইয়ে ৭৩ হাজার ৯৭১ জন, আগস্টে ৯১ হাজার ৩৮৮ জন, সেপ্টেম্বরে ৮৮ হাজার ৩০৪ জন, অক্টোবরে ৭৫ হাজার দুজন এবং নভেম্বরে (২৪ নভেম্বর পর্যন্ত) ৬৩ হাজার ৬০৬ জন কর্মী বিদেশে গেছেন। এদিকে সরকারি রিক্রুটিং এজেন্সি বোয়েসেলের মাধ্যমে জুলাইয়ে এক হাজার ২১৯ জন, আগস্টে এক হাজার ৪৫৯ জন, সেপ্টেম্বরে এক হাজার ১৭৩ জন, অক্টোবরে এক হাজার ১১৬ জন ও নভেম্বরে এক হাজার ২৪৮ জন বিদেশে গেছেন।
মালয়েশিয়ায় কর্মসংস্থানের ধীরগতির কারণ : বৈঠকে মালয়েশিয়ায় কর্মসংস্থানের ধীরগতির কারণ তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়-মালয়েশিয়া হাইকমিশন থেকে প্রতিদিন গড়ে এক হাজার ১৩৬ জনের সত্যায়ন করা হয়। ২৪ জুলাই থেকে ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত এক লাখ ৩৫ হাজার ২২৯ জন কর্মীর সত্যায়ন করা হয়েছে। এছাড়া সত্যায়নের অপেক্ষায় আছে ২৬ হাজার ৫৯১ জন। রিক্রুটিং এজেন্টের আবেদনের ভিত্তিতে মন্ত্রণালয় থেকে নিয়োগ অনুমতি দেওয়া হয়েছে এক লাখ ১৩ হাজার ৩৬৯ জনের। বর্তমানে ১১টি আবেদনের বিপরীতে এক হাজার ৮১২ জনের নিয়োগ অনুমতি অপেক্ষায় আছে। ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিএমইটি থেকে ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স দেওয়া হয়েছে ৩০ হাজার ৯৮৬ জনের। বিএমইটিতে কোনো অনিষ্পন্ন আবেদন নেই। ধারণা করা হচ্ছে, এজেন্ট ও মালয়েশিয়া প্রান্তের কারণে কর্মী যাওয়ার ধীরগতির প্রধান কারণ। মালয়েশিয়া গমনেচ্ছু কর্মীদের কাছ থেকে বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্সির অর্থ গ্রহণের পরিমাণ কমাতে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করে সংসদীয় কমিটি।
কমিটির আগের বৈঠকে জানানো হয়েছিল, মালয়েশিয়ার অভিবাসন ব্যয় ৩ লাখ ৮০ হাজার থেকে ৪ লাখ পর্যন্ত। অভিবাসন ব্যয় অত্যধিক হওয়ার জন্য বিদেশে কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে খারাপ প্রভাব পড়বে। মধ্যপ্রাচ্যে অভিবাসন ব্যয় বাড়তে শুরু করবে। কমিটি মালয়েশিয়া কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে ২৫টি রিক্রুটিং এজেন্সি নির্বাচনে নির্দিষ্ট মানদণ্ড দরকার বলে প্রস্তাব করে। কিন্তু সেটা না করে কর্মী নেওয়ার ক্ষেত্রে অসাধু পদ্ধতি অবলম্বন করা হয় বলে অভিযোগ।
অর্থসংবাদ/কেএ