বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ এবং ব্যাংকের তারল্য পরিস্থিতি নিয়ে ‘গুজব’ ছড়ানো হচ্ছে বলে সতর্ক করে সেই গুজবে কান না দিতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেছেন, “ব্যাংকে টাকা নেই বলে গুজব ছড়িয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে। অযথা গুজবে কান দিবেন না। বাংকে টাকার কোনো ঘাটতি নেই। উপার্জিত টাকা ঘরে রেখে বিপদ ডেকে আনবেন না। আমাদের বিনিয়োগ, রেমিটেন্স প্রবাহ এবং আমদানি-রফতানি পরিস্থিতি সবকিছু স্বাভাবিক রয়েছে।”
বিজয় দিবসের প্রাক্কালে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই আহ্বান আসে। রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যমগুলোতে তার ওই ভাষণ প্রচার করা হয়।
করোনাভাইরাস মহামারীর পর ইউক্রেইন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে পুরো বিশ্বেই যে এক সঙ্কটময় পরিস্থিতি বিরাজ করছে, সে কথা ভাষণে তুলে ধরেন শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, ২০২০ এবং ২০২১ - এই দুই বছরে বিশ্ব অর্থনীতিতে এক গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে, যার ফলে অনেক দেশের অর্থনীতিতে ধস নামে।
“আমাদের অর্থনীতিও ক্ষতির মুখে পড়ে। করোনাভাইরাস মহামারীর সেই ক্ষতি কাটিয়ে যখন আমাদের অর্থনীতি ঘুরে দাড়াতে শুরু করেছিল, ঠিক তখনই শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। আর এই যুদ্ধ শুধু অস্ত্রের যুদ্ধ নয়; সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভয়ঙ্কর অর্থনৈতিক যুদ্ধ।
“অর্থনৈতিক যুদ্ধের প্রভাব কোনো একক দেশের গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বব্যাপী। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ-পরবর্তী অর্থনৈতিক অবরোধ-পাল্টা অবরোধ বিশ্ব অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে।”
সরকারপ্রধান বলেন, সরকারের ‘সময়োচিত’ পদক্ষেপে মহামারীর ধাক্কা সামাল দেওয়া সম্ভব হলেও এরপর ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ এবং অর্থনৈতিক অবরোধ, পাল্টা অবরোধের কারণে বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল ও আমদানি-নির্ভর দেশগুলো সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল, ভোজ্য তেল, গম, চিনি, ভুট্টা, ডাল, রাসায়নিক সারসহ প্রায় সকল ভোগ্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।
“সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। পরিবহন খরচ বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। যে জাহাজ ভাড়া ছিল ৮০০ ডলার তার ভাড়া এখন ৩ হাজার ৮০০ ডলার; যে গম টন প্রতি ২০০ ডলারে পাওয়া যেত, তা ৬০০ ডলারে কিনতে হচ্ছে।
“আবার নিজস্ব চাহিদা মেটানোর জন্য কোন কোন দেশ বিনা নোটিশে পণ্য রপ্তানি বন্ধ করে দিচ্ছে। সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে আমরা পৃথিবীর যেখানেই আমাদের চাহিদার পণ্য পাওয়া যাচ্ছে, সেখান থেকেই তা সংগ্রহ করছি এবং যোগান দিচ্ছি।”
এই সংকটের মধ্যে ডলারের বিপরীতে মান হারিয়েছে টাকা। আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় চাপে পড়েছে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ।
শেখ হাসিনা বলেন, “আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে অনেকেই নানা মনগড়া মন্তব্য করছেন। তিন মাসের আমদানি খরচ মেটানোর মত রিজার্ভ থাকলেই চলে। বর্তমানে আমাদের পাঁচ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মত বৈদেশিক মুদ্রা মজুদ আছে।”
রিজার্ভ কমার যে আরও কারণ আছে, সে বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “করোনাভাইরাসের মহামারির সময় সব ধরনের ভারী যন্ত্রপাতি আমদানি, বিদেশ ভ্রমণ এবং অন্যান্য পণ্য আমদানি অনেকটা বন্ধ ছিল। সে সময় আমাদের রিজার্ভ বৃদ্ধি পেয়ে ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়।
“এই বিপুল পরিমাণ অর্থ অলস অবস্থায় না রেখে সেখান থেকে কিছু পরিমাণ অর্থ দিয়ে আমরা একটা বিশেষ তহবিল গঠন করেছি। সেই তহবিলের অর্থ দ্বারা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।”
সোনালি ব্যাংকের মাধ্যমে ২ শতাংশ হার সুদে এই ঋণ দেওয়া হচ্ছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “ঘরের টাকা সুদসহ ঘরেই ফেরত আসছে। এ অর্থ যদি বিদেশি ব্যাংক থেকে ঋণ হিসেবে নেওয়া হত, তাহলে ৪/৫ শতাংশ হারে সুদসহ ফেরত দিতে হত। আর তা পরিশোধ করতে হত রিজার্ভ থেকেই।
“আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস পাওয়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে আমরা বেশি দামে জ্বালানি তেল, ভোজ্য তেল, গম, ভাল, ভুট্টাসহ অন্যান্য পণ্য ক্রয় করে স্বল্পমূল্যে সাধারণ মানুষের কাছে বিক্রি করছি।”
প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণের শুরুতেই দেশে ও দেশের বাইরে বসবাসকারী বাংলাদেশের সকল নাগরিককে বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা জানান।
আওয়ামী লীগের শাসনে গত ১৪ বছরে দেশ আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং চলমান সঙ্কট থেকে উত্তরণে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের কথা তিনি বিস্তারিত তুলে ধরেন তার ভাষণে।
এ বছর স্বপ্নের পদ্মা সেতুর পাশাপাশি দক্ষিণাঞ্চলের সর্ববৃহৎ পায়রা সেতু উদ্বোধন এবং অনেকগুলো মহাসড়ক ৪ লেইনে উন্নীত করার কথা মনে করিয়ে দেন সরকারপ্রধান।
চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল, ঢাকায় মেট্রোরেল এবং বিমানবন্দর-কুতুবখালী এক্সপ্রেসওয়ের একাংশ খুব শিগগিরই যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে বলে তিনি জানান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমরা ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত-স্মার্ট বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলব। এজন্য প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০৪১ প্রণয়ন করে বাস্তবায়ন শুরু করেছি। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত থেকে আমাদের প্রজন্মের পর প্রজন্ম যেন রক্ষা পায় এবং উন্নত ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে পারে, সেজন্য আমরা আমরা ডেল্টা প্লান-২১০০ প্রণয়ন করেছি।”
সঙ্কট উত্তরণে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “সঙ্কট আসবে। সঙ্কটে ভয় পেলে চলবে না। জনগণের সহায়তায় আমরা করোনাভাইরাস মহামারী সফলভাবে মোকাবিলা করেছি। বর্তমান বৈশ্বিক মন্দাও আমরা মোকাবিলা করব, ইনশাআল্লাহ। এজন্য আপনাদের সহযোগিতা চাই।”